ভূমিকা
বছরখানেক আগে ইংল্যান্ডের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন হিজাব বিষয়ে একটি জঘন্য ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘হিজাব পরিহিত মহিলাদেরকে ডাকবক্সের মতো লাগে।’ এ কারণে সংসদে তাকে বিরোধী পক্ষের বেশ তোপের মুখে পড়তে হয়েছিলো, জবাবদিহিতা করতে হয়েছিলো। এর কিছুদিন পর নব্বই শতাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও হুবহু একইরকম মন্তব্য করেন হিজাব বিষয়ে। তিনি বলেন, ‘হাত মুখ ঢাকা নারীদেরকে জীবন্ত টেন্ট বা তাবু মনে হয়। এভাবে চলাফেরা করার কোন যৌক্তিকতা নাই।’ এমন বক্তব্যের কারণে আশ্চর্যজনকভাবে তাকে কোনধরণের জবাবদিহিতা বা সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়নি।
আবার ধরুন, ফ্রান্স বা বেলজিয়াম যদি মুসলিম নারীদের হিজাব/নিকাব নিষিদ্ধ করে আইন পাশ করে, তাহলে যেমন অবাক হওয়ার কিছু থাকে না, তেমনই মিশর বা মরক্কোর মতো মুসলিম প্রধান দেশেও হিজাব নিষিদ্ধের আইন দেখে আমাদেরকে অবাক হওয়া বাদ দিতে হবে। কেন বাদ দিতে হবে সেটাই এই লেখার আলোচ্য বিষয়।
বিগত কয়েক দশক ধরে ইসলামবিদ্বেষ (যার একাডেমিক পরিভাষা হলো ইসলামোফোবিয়া। সংগত কারণেই এই লেখায় আমি এই পরিভাষাটি এড়িয়ে চলবো) একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে মুসলিমদের জন্য। আমরা যখন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে ইসলামবিদ্বেষ ব্যাপারটাকে কল্পনা করি, তখন স্বাভাবিকভাবেই এমন কোনো রাষ্ট্র বা সমাজের কথা ভাবি যা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ না; মুসলিমরা সেখানে সংখ্যালঘু এবং অবশ্যই সেটা পশ্চিম, ভারত, কিংবা চীন। কিন্তু ইসলামবিদ্বেষ, কোনরকম কমতি না রেখে সমানভাবে মুসলিম সংখাগরিষ্ঠ সমাজ ও রাষ্ট্রেও যে খুব ভালোভাবেই বিদ্যমান আছে, সেটা আমাদের কল্পনায় সাধারণত আসে না। ফলত একে মোকাবেলার জন্য সচেতনভাবে সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কোন তৎপরতা গড়ে উঠেনি।
ইসলামবিদ্বেষ: পশ্চিমে ও অ-পশ্চিমে
পশ্চিমা সমাজে ইসলামবিদ্বেষ আর অ-পশ্চিমা মুসলিম সমাজে ইসলামবিদ্বেষের ধরণ-ধারণ-প্রকার-প্রকৃতি এক হবে না, এটাই স্বাভাবিক। উভয়ের মাঝে সামঞ্জস্যের পাশাপাশি অসামঞ্জস্যও আছে অনেক। বরং মুসলিম সমাজে ইসলামবিদ্বেষ অনেক বেশি ডাইনামিক এবং বহুমাত্রিক। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিদ্যমান। কিন্তু একটা চূড়ান্ত বিন্দুতে গিয়ে উভয়েই মিলিত হয়েছে। তা হলো মুসলিম পরিচয়কে কোনঠাসা করে রাখা এবং সামাজিকভাবে একে গুরুত্বহীন বানানো।
ডক্টর সালমান সায়্যিদের মতে— ইসলামবিদ্বেষ হলো একজন মুসলিমের রাজনৈতিক পরিচয়ের (identity) অস্তিত্বকে অসম্ভব করে তোলা। আজকের দিনে মুসলিম হওয়ার সবচে বড় চ্যালেঞ্জ হলো তার জন্য জ্ঞানতাত্ত্বিক (epistemologica) ও রাজনৈতিক (political) পরিসরে তার পরিচয়ের কোন স্থান নেই।
একইভাবে তালাল আসাদ দেখিয়েছেন, মুসলিমরা পশ্চিমা সেকুলার সমাজে কিভাবে একইসাথে উপস্থিত ও অনুপস্থিত থাকে। উপস্থিত থাকে এই হিসাবে যে, তারা অভিবাসী হিসাবে পৃথিবীর প্রাচীন একটি মহাদেশ ইউরোপে যায় এবং ইউরোপের জন-জীবনে অংশগ্রহণ করে (কর্মক্ষেত্র,শিক্ষা,গণমাধ্যম ইত্যাদিতে)। আবার একইসাথে অনুপস্থিত থাকার অর্থ হলো, মুসলিমদেরকে মনে করা হয়, তারা এমন এক মূল্যবোধের ধারক বাহক, যা ইউরোপের তথাকথিত ‘পবিত্র নীতিমালাগুলো’র সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না কোনভাবেই। এই হিসেবে মুসলিমরা ইউরোপে আছে বটে, কিন্তু তারা ইউরোপের না। এভাবে তার আইডেন্টিটি ও অস্তিত্বকে বিপন্ন করা হয়।
উপরোল্লিখিত দুইজনের বক্তব্যকে সামনে নিয়ে আমরা দেখতে পাই, এটা কেবল পশ্চিমা সমাজে বিদ্যমান মুসলিমদের কথা বলছে না, বরং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজেও একই চিত্র দেখা যায়—মুসলিমদের রাজনৈতিক পরিচয়কে অসম্ভব করে তোলা এবং তাকে রাষ্ট্রীয় পরিসরে অনুপস্থিত রাখা। এ থেকে বুঝা যায় যে, ইসলামবিদ্বেষ মৌলিকভাবে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ বনাম সংখ্যালঘুর সাথে সম্পৃক্ত না, বরং এর সাথে সমানভাবে যুক্ত আছে ক্ষমতাশীল বনাম ক্ষমতাহীনের সম্পর্ক। পশ্চিমে যেটা ক্ষমতাশীল অমুসলিম সেকুলার বনাম ক্ষমতাহীন মুসলিম, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সেটা ক্ষমতাশীল পশ্চিমাপন্থী এলিট মুসলিম বনাম ক্ষমতাহীন রক্ষণশীল মুসলিম জনগণ ( conservative muslim masses)। খোদ মুসলিমদের মাঝেই যে এলিট শ্রেণী আধুনিক ও ইউরোসেন্ট্রিক মনোভাব পোষণ করেন তারা রক্ষণশীলদের প্রতি চিন্তাগত দিক দিয়ে সহিংস হয়ে থাকেন। একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণে রক্ষণশীল মুসলিমদেরকে প্রধানতম প্রতিবন্ধক মনে করেন।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজে ইসলামবিদ্বেষের কারণ ও ইতিহাস
মুসলিম সমাজ বা জাতি-রাষ্ট্রে ইসলাম বিদ্বেষের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—এর পেছনে মূলত পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ভূমিকা অত্যন্ত স্পষ্ট ও অনস্বীকার্য। আজকের দিনে মুসলিম বিশ্ব হিসেবে মানচিত্রের যে অংশটা পরিচিত, এর হাতেগোনা কয়েকটি দেশ ব্যতীত পুরোটাই একসময় ইউরোপের বাণিজ্যিক উপনিবেশে পরিণত হয়। প্রাক-উপনিবেশ আমলে যেসব দেশে ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতি হিসেবে রাষ্ট্র ও সমাজের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো, উপনিবেশ আমলে তাকেই বিকেন্দ্রীকরণ করা হয় সর্বাগ্রে। ইসলাম ও মুসলমানদেরকে কেন্দ্রচ্যুত করে সেখানে অধিষ্ঠিত হয় ঔপনিবেশিক ক্ষমতা।
উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন ও প্রতিরোধে মুসলিমরা কখনোই পিছপা হননি। সামরিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন সবসময়ই চলমান ছিলো। কিন্তু এরমধ্য থেকেই মুসলিম সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত এলিট মুসলিমরা ভাবলেন যে, আমরা আমাদের নিজস্ব প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমরনীতি ও সংস্কৃতি কোনটা দিয়েই পশ্চিমকে মোকাবেলা করতে পারবো না। ফলে আমাদের দেখা উচিত স্বয়ং ইউরোপ কোন শক্তি ও বিদ্যার বলে এতোটা উন্নত হয়েছে, আমাদেরকেও হুবহু সে পথেই চলতে হবে। তবেই কেবল সম্ভব হবে ইউরোপকে মোকাবেলা করা। বলাবাহুল্য, এটা ছিলো তাদের অদূরদর্শী ও আত্মঘাতি চিন্তা। তারা ইউরোপীয় আলোকায়নের ( enlightenmen) পুরো প্রকল্পটাকেই কোনরূপ বাছ বিচার ছাড়া মুসলিম সমাজে স্থানান্তরিত করেন এবং আত্তীকরণ করেন। ব্যাপকভাবে একই প্রবণতা দেখা যায় ভারতবর্ষ, মরক্কো, মিশর, সিরিয়া, আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়াসহ আরও অনেক দেশেই।
এলিট ক্লাস মুসলিমদের এই বিপ্লবী চিন্তা ঔপনিবেশিক শক্তির আনুকূল্য লাভ করে এবং ইসলাম ও মুসলিমদের মাঝে চিন্তাগত বিভক্তি তৈরীর মাধ্যমে এর শক্তিশালী কেন্দ্রীয় কাঠামোকে ভেঙে ফেলে। ইউরোপিয়ান আলোকায়ন ও আধুনিকতাকে আত্তীকৃত করতে গিয়ে তারা মুসলিম সমাজেই সংস্কারবাদী আন্দোলন গড়ে তোলেন। রেনেসাঁ পরবর্তী ইউরোপ যেমন চার্চ ও তার কর্তৃত্বকেই সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছিলো, এই এলিট মুসলিমরাও নিজেদের উন্নতি ও প্রগতির জন্য মুসলিম সমাজের একান্ত ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমস্যা হিসেবে হাজির করতে লাগলেন।
যেসব দেশ প্রত্যক্ষভাবে পশ্চিমা উপনিবেশের শিকার হয়নি এমন মুসলিম দেশও স্বপ্রণোদিত পশ্চিমায়ন ( self-westernization)কে নিজেদের জন্য একমাত্র মুক্তির পথ হিসেবে দেখেছে। যেমন, কামাল আতাতুর্কের তুর্কি ও বিপ্লবপূর্ব শাহ এর ইরান। ইসলামকে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসর থেকে সমূলে উৎখাত করে তারা সরাসরি পশ্চিমকে আত্তীকরণ করতে চেয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, ট্র্যাডিশনাল মুসলিম ও আলোকায়িত এলিট মুসলিমদের মাঝে মূলত দ্বন্দ্বটা তৈরী হয় আধুনিকতা বা পশ্চিমায়নকে গ্রহণ করা না করা থেকে।
বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে মুসলিম দেশগুলো উপনিবেশ মুক্ত হওয়া শুরু হয় ঠিকই, কিন্তু উপনিবেশ পূর্ব সময়ের ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ফিরে যেতে পারেনি। বিচ্ছিন্নতা, বিভাজন আর কেন্দ্রচ্যুত হওয়ার এই দগদগে ঔপনিবেশিক ঘা আর শুকায়নি কখনো। ফলে পশ্চিমা শক্তি সশরীরে দেশ ছেড়ে গেলেও তার রেখে যাওয়া প্রেতাত্মা ঠিকই চেপে বসে মুসলিম সমাজের ঘাড়ে। অনুসারী হিসেবে যাদেরকে রেখে যাওয়া হয় তারাই নতুন করে আবার আদর্শিক উপনিবেশ কায়েম করে।
পূর্বের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অবকাঠামো ভেঙে আধুনিকতা, সেকুলারিজম, লিবারেলিজম বা ফেমিনিজমের মত ইত্যাকার পশ্চিমা এনলাইটেনমেন্ট উদ্ভূত মতবাদ ও আইডিয়াগুলো মুসলিম সমাজের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে অধিষ্ঠিত হতে থাকে এবং ট্র্যাডিশনাল ইসলামের সাথে তার সংঘাতও স্পষ্ট হতে থাকে। ইসলাম তার সত্ত্বা-বিরোধী এসব মতবাদ মেনে নেয়নি।
যেহেতু এই সেকুলার এলিট মুসলিম শ্রেণীটাই ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকে, সেহেতু ট্র্যাডিশনাল বা রক্ষণশীল মুসলিম শ্রেণীকে দাবিয়ে রাখা বা কোনঠাসা করে রাখার একটি সচেতন প্রক্রিয়া সবসময় ক্রিয়াশীল থাকে। ট্র্যাডিশনাল ইসলামের রাজনৈতিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক অস্তিত্ব ও উত্থানকে দমন করে রাখাই তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। যুগযুগ ধরে এই সেকুলার এলিট মুসলিমরা তাদের আদর্শিক স্বৈরাচারী শাসকদেরকে সমর্থন দিয়ে এসেছে এই স্বার্থে যে, যদি সুষ্ঠু গনতান্ত্রিক নির্বাচন দেয়া হয় তাহলে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় এসে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এই ধারণা এবং সম্ভাবনা তাদেরকে ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে মারাত্মক রকমের রাজনৈতিক সহিংসতার সমর্থন যোগাতেও কসুর করেনি।
এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে ২০১৩ সালে মিশরের তাহরীর স্কয়ারে ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট মুরসীর সমর্থকদের উপর চালানো গণহত্যার কথা। ইসলামপন্থীকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য পশ্চিমা সহায়তায় এই জঘন্য গণহত্যাও তাদের কাছে বৈধতা পেয়েছে৷ শুধু মিশর নয়, লেবানন কিংবা আলজেরিয়ার এলিট সেকুলারদের বক্তব্য একই মালায় গ্রন্থিত। তাহরীর স্কয়ারের পাশাপাশি একই বছরে শাপলা চত্তরের গণহত্যাকেও উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়। একটি অরাজনৈতিক ইসলামি সংগঠনের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে ম্যাসাকার চালানো হয়েছিলো এই আশঙ্কা থেকেই এবং বাংলাদেশের এলিট সেকুলার শ্রেণী এই গণহত্যাকে সমর্থন দিয়েছে দ্ব্যার্থহীনভাবে।
ইসলামবিদ্বেষ : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
বাংলাদশের সাথে ইসলাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে হাজার বছরেরও বেশী সময় ধরে। এদেশের মাটি বহুবার সিঞ্চিত হয়েছে মুসলমানদের রক্তে। ইসলামের শেকড় প্রোথিত মাটির বহু গভীরে। সুতরাং ইসলাম ও মুসলমান এ দেশে অনাহুত ও উদ্ভূত কোন আগন্তুক নয়। কিন্তু উত্তর-ঔপনিবেশিক বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলমান পরিচয় এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। রক্ষণশীল ইসলাম ও পশ্চিমা আধুনিক এলিট মুসলিম। যথারীতি ক্ষমতাশীল ও ক্ষমতাহীনের সম্পর্ক। বাংলাদেশ-পাকিস্তান ইসলাম ও মুসলমানের স্বার্থ রক্ষার জন্য ভারত থেকে আলাদা হলেও উভয় দেশের ক্ষমতাই মূলত চলে যায় ইসলাম-বিরোধী সেকুলার শক্তির হাতে। যদিও তারা সময়ে সময়ে ক্ষমতার স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে থাকেন, কিন্তু মৌলিকভাবে ধর্ম ও ক্ষমতার মাঝে একটি মৌলিক দূরত্ব তৈরীই তাদের জন্য স্বস্তিদায়ক। এর অবধারিত ফলস্বরূপ এদেশে ইসলামবিদ্বেষও জারি আছে বহুমাত্রিকভাবে।
বাংলাদেশের ৯০% মানুষ মুসলমান। তা সত্ত্বেও এদেশের রাষ্ট্রীয় পরিসরে ইসলাম ও মুসলিম পরিচয় প্রবলভাবে অনুপস্থিত। তালাল আসাদ পশ্চিমা সমাজে মুসলমানদের একইসময়ে উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতিকে যেভাবে দেখেছেন, বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের মুসলিমরা একই সময়ে উপস্থিত এবং অনুপস্থিত। যেকোন প্রকার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক তৎপরতাকে যেন এক প্রকার নিষিদ্ধই ঘোষণা করা হয়েছে। সেই সুবিধাপ্রাপ্ত এলিট সেকুলাররা ধর্মীয় রাজনীতিকে আইনিভাবে সর্বত্র নিষিদ্ধ করার জোরালো দাবী জানিয়ে আসছে বহু আগ থেকেই। যেকোন ধর্মীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মুসলমানদের রাজনৈতিক এজেন্সিকে অস্বীকারের মধ্য দিয়ে তাদের রাজনৈতিক পরিচয়কেই অসম্ভব করা তোলা হয়।
৯/১১ পরবর্তী সময়ে আমেরিকা ও পশ্চিমা শক্তির ইসলাম বিরোধী বৈশ্বিক আধিপত্য (global hegemony) কে তারা মহা সু্যোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এর মাধ্যমে ইসলামবিদ্বেষের নতুন অধ্যায় শুরু হয় আরও প্রকটভাবে এবং স্পষ্ট আকারে।
ধর্মপ্রাণ মুসলিম সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকে ধর্মীয় শিক্ষালয়, মাদ্রাসা, মসজিদ, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি। এরা সমাজকে নানানভাবে প্রভাবিত করেন এবং ধর্মের যাবতীয় ব্যাপারে সমাজকে নেতৃত্ব দেন। মানুষের ধর্ম বিষয়ক সকল জিজ্ঞাসা ও আকাঙ্খার বাস্তবায়ন ঘটে এদের মাধ্যমে। কিন্তু আমেরিকার ‘ওয়ার অন টেরর’ পরবর্তী সময়ে গুড মুসলিম বনাম ব্যাড মুসলিম দ্বন্দ্ব যখন সামনে আসে, তখন এই ধর্মীয় মহলটিকে ক্ষমতাশীল এলিট সেকুলাররা একপ্রকারের টেরোরাইজ করে ফেলতে সক্ষম হয়। উগ্রবাদী, জঙ্গীবাদী, গোঁড়া, ধর্মান্ধ ইত্যাদী বিশেষণ দিয়ে তাদেরকে সফলতার সাথেই সমাজের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন ও অপর হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলা হয়। তাদেরকে জঙ্গি ও উগ্রবাদী হিসেবে গণ-সন্দেহের তালিকায় ফেলা হয়।
ফলে, দেশের ধর্মীয় ব্যাক্তিত্ব কিংবা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সবসময় নিজেদের আদর্শিক অবস্থান এবং ‘ধর্মীয় ভায়োলেন্স’ বা জঙ্গিবাদের সাথে নিজেদের সম্পর্কহীনতার কথাটি আলাদা করে এবং অবিরতভাবে প্রকাশ করতে বাধ্য করা হয়। যদিও বাংলাদেশে ‘জঙ্গিবাদ’ বা ধর্মীয় ভায়োলেন্সের চেয়ে অনেক বেশী বাস্তব ও প্রাসঙ্গিক হলো পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স। রাজপথ থেকে শুরু করে বিদ্যালয়ের হলরুম পর্যন্ত প্রতিনিয়ত ঘটমান এই পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স। কিন্তু এ ব্যাপারটিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ও সমাধানহীন রেখে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ নামক এক অদৃশ্য জুজুর ভয় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে মানুষের মনে। আর এই জঙ্গিবাদের জন্য ব্যাপকভাবে মাদ্রাসাগুলোকে কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়াই নজরাদারিতে রাখা হতে লাগলো। জনপরিসরে তাদের চলাচল ও উপস্থিতিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হতে লাগলো।
তাদের উপর গণসন্দেহের ভিত্তিতে যত্রতত্র পুলিশি হেনস্তা, নজরদারী, জিজ্ঞাসাবাদ এবং গ্রেপ্তারের অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে যায় সেকুলার রাষ্ট্র। মুসলিমদের ধর্মীয় চিহ্ন, প্রতীক, আচার অনুষ্ঠান বিষয়েও সেকুলার মহল থেকে অবাধে বিদ্বেষপ্রসূত মন্তব্য বক্তব্য আসতে লাগলো। দাঁড়ি, টুপি, পাঞ্জাবী, হিজাব, নিকাব হয়ে উঠলো পশ্চাৎপদতার প্রতীক। এমনকি একজন দাড়ি-টুপিওয়ালা মানুষ রাষ্ট্রের যেকোন ক্ষেত্রে হেনস্তার শিকার হওয়ার আশঙ্কা রাখেন এবং একজন হিজাব পরিহিতা নারীকে অনেক জায়গায়ই নানান ধরণের জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হয়।
এদেশে ঔপনিবেশিক আদর্শের ধারক বাহক সেকুলার বিদ্যালয়গুলি হয়ে উঠে ইসলামবিদ্বেষের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চাকেন্দ্র। বুদ্ধিবৃত্তিকতা ও একাডেমিয়া পরিসরে ইসলামবিদ্বেষকে একটি গ্রহণযোগ্য সাবজেক্ট হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মুসলমানদের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুভূতির সাথে সাংঘর্ষিক এরকম চিন্তা ও শিক্ষার প্রচার প্রসার ঘটানো হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিকভাব। মিডিয়া, সাহিত্য, চলচ্চিত্র সর্বত্রই ধার্মিক মুসলিমদের উপস্থাপন করা হয় একটি অসুবিধাজনক ‘অপর’ হিসেবে। যারা এই যুগেও ধর্মের মতো গুরুত্বহীন একটা ব্যাপারকে আঁকড়ে ধরে উন্নতি ও অগ্রগতির পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলে ধর্মীয় শিক্ষায় রাষ্ট্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের মাধ্যমে এর আধুনিকায়ন করে প্রচলিত সেকুলার শিক্ষার উপযোগী করে তোলা, কিংবা কখনও একে বিলুপ্ত করে ফেলার প্রস্তাবও তোলা হয় অবলীলায়।
একজন মানুষ সামান্য চোখ কান খোলা রাখলেই বাংলাদেশে ইসলামবিদ্বেষ চর্চার গভীরতা ও বহুমাত্রিকতা খুব সহজেই টের পাবেন। বর্ণবাদী আচরণ যেরকম একটি অপরাধ, তেমনই ইসলামবিদ্বেষী আচরণও একটি অপরাধ। এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এখন সময়ের দাবী। ইতিহাস সাক্ষ্য— ‘তথাকথিত ধর্মান্ধ, প্রতিক্রিয়াশীল কাঠমোল্লারা’ যখন দাঁতে দাঁত চেপে’ প্রাণপণে বিদেশী বেনিয়াদের বিরুদ্ধে লড়েছিলো যুদ্ধের ময়দানে, তখন আজকের এই সুবিধাপ্রাপ্ত এলিট মুসলিম শ্রেণীটা আধুনিকতা ও আলোকায়নের সবক নিচ্ছিলেন খোদ ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকেই।
হুজাইফা মাহমুদ :
গ্রন্থসূত্র :
1. islamophobia in muslim majority society — edited by farid hafez
2. Measuring islamophobia –salman sayyid
3. Radical skin,moderate masks –yasir mursi
4. Religion- building’ and foreign policy– Hatem Bazian
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন