সারা দেশে কোভিড-১৯ তকমায় ৭৮ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। জনমনে লেগে আছে অজানা আতঙ্ক। না জানি কে কখন কোথায় আক্রান্ত হয়ে যায়। সর্বনাশী ভাইরাসের কোন প্রতিশোধক এখনও আবিস্কার করতে পারেনি বাঘা বাঘা চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। তারা অনেকটাই হতাশ। এই ভয়াল ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে বার বার। কিন্তু দেশের অনেক স্থানে মানুষের চলাচল বন্ধ বন্ধ হয়নি। কারণে-অকারণে মানুষ ঘুরাফেরা অব্যাহত রেখেছে।
এর ফলে প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সংক্রামনের সংখ্যা। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গত ২৪ ঘন্টায় করোনার উপসর্গ জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টে ২১ জনের প্রাণহানি হয়েছে। করোনার নানান আলামত নিয়ে এ পর্যন্ত ৭৮ জনের মৃত্যু হলো। আমাদের প্রতিনিধি ও বিভিন্ন অঞ্চলের সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর ও নানান সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরী করা হয়েছে।
ঢাকা: রাজধানীর চিত্র হলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আইসোলেশনে থাকা দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন—মো. মিয়াদ হোসেন (২৩) ও মো. শারাফাত (৫৫)। গত শনিবার দুপুরে তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে মিয়াদ হোসেন ঢাকা মেডিক্যালের মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি হন। মঙ্গলবার তাকে আইসোলেশনে রাখা হয়। গতকাল সকালে তিনি মারা যান। মিয়াদের বাবার নাম শহীদুল্লাহ। তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার সদরে। এলাকায় শ্রুতি রয়েছে এরা করোনাক্রান্ত।
অন্যদিকে, শারাফাত গত বুধবার দুপুরে খুব বেশী শ্বাসকষ্ট নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি হন। চিকিত্সকরা তাকে জরুরি বিভাগের পাশে আইসোলেশনে পাঠায়। বেলা সোয়া ৩টার দিকে শারাফাত মারা যান। শারাফাত দীর্ঘদিন যাবত্ শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের মেঘনা এলাকায়। তবে স্বজনদের সন্দেহ তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া : নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শ্বাসকষ্টে এক প্রবাসীর মৃত্যু হয়। প্রবাসী বিদেশ থেকে দেশ আসার পর থেকেই করোনার উপসর্গ জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। মঙ্গলবার রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শ্বাসকষ্ট নিয়ে চিকিত্সাধীন ছিলেন। পরে তিনি মারা যান। সেই শ্বশুরবাড়ি লকডাউন করে দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
এদিকে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জেলার বাঞ্ছারামপুর উপলোর ৪৫ বছর বয়সি এক কৃষক করোনার আলামত নিয়ে গুরুতর অসুস্থ্য হয়ে যান। আইয়ূবপুর ইউনিয়নের চরছাউনী গ্রামের কৃষক আলাউদ্দিনকে করোনা ভাইরাসের উপসর্গ থাকায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে আইসোলেশনে থাকাবস্থায় তিনি মারা যান।
জেলার নবীনগর উপজেলায় করোনার উপসর্গ জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টে মো. রায়হান (২০) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দুপুরে নবীনগর সদর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ওই যুবকের মৃত্যু হয়। তার বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার বলিবাড়ি গ্রামে। কাশি, শ্বাসকষ্ট ও জ্বর নিয়ে গতকাল দুপুরে তিনি চিকিত্সা নিতে আসেন। এক্সরেসহ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা যায়। সবকিছু রেডি করার পর এম্বুলেন্সে ওঠানোর আগেই দুপুর ৩টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
কিশোরগঞ্জ : জেলার ভৈরব উপজেলায় প্রচণ্ড জ্বর ও কাশিতে এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। শহরের বঙ্গবন্ধু সরণিতে আনোয়ারা জেনারেল প্রাইভেট হাসপাতালে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিনি মারা যান। হাসপাতালটি তালাবদ্ধ করা হয়েছে। আর ওই পরিবারকে নিবির তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছে।
কুমিল্লা : নাঙ্গলকোট উপজেলায় করোনার উপসর্গ জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাজেরা বেগম (২৮) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। তার জ্বর, ডায়রিয়া ও গলাব্যথা ছিল। ওই বাড়ি ও আশ পাশ এলাকা লকডাউন করে রাখা হয়েছে। একদিনের ব্যবধানে নাঙ্গলকোটে দুই জন করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রশাসন ষিয়টি দেখভাল করছেন।
জেলার চেদ্দগ্রামে গতকাল ভোরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে সর্দি, কাশি, জ্বর ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মহিন উদ্দিন (৩২) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। শুভপুর ইউনিয়নের কৈয়ারধারী গ্রামের তিনটি বাড়ি লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে।
শরীয়তপুর : জেলার সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে বুধবার বিকালে ৩৪ বছর বয়সি এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। নড়িয়া উপজেলার ওই বাসিন্দা গত তিন দিন ধরে করোনার উপসর্গ জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. মুনির আহমেদ খান বলেন, ওই যুবক শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসায় ও তার বাড়ি প্রবাসী অধ্যুষিত নড়িয়ায়, যে কারণে মনে করা হয়েছিল তার করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে।
নীলফামারী : নীলফামারীতে জ্বর, সর্দি ও কাশিতে উপজেলার কেতকীবাড়ি ইউনিয়নের দক্ষিণ গ্রামে এক বৃদ্ধের (৬৫) মৃত্যু হয়েছে। তার বাড়ি লকডাউন করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। আশে পাশে বিদেশ ফেরত লোকজন ছিল বলেও জানা গেছে।
সুনামগঞ্জ : সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার বখতারপুর গ্রামের এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে জ্বর-শ্বাস কস্টে ভূগছিলেন ওই যুবক। যুবকের বাড়িসহ আশপাশের আরো ১০ থেকে ১২টি বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে। এলাকায় করোনাতঙ্ক বিরাজ করছে।
পিরোজপুর : পিরোজপুরের নাজিরপুরে তাবলিগ জামাত থেকে ফেরত বজলুর রহমান হাওলাদার নামে (৭২) এক বৃদ্ধ মারা গেছেন। তিনি জ্বর, গলাব্যাথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে গতকাল ভোরে নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি উপজেলার শাখারীকাঠী ইউনিয়নের মাদুলিহারানিয়া গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবার নাম নওয়াব আলী হাওলাদার। এ সংবাদ পেয়ে দুপুর ১টার দিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একটি মেডিক্যাল টিম ওই বৃদ্ধসহ তার মেয়ে হাসিনা বেগমের নমুনা সংগ্রহ করেছেন।
পরে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি টিম প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে ওই বৃদ্ধের দাফন সম্পন্ন করেন। এ মৃত্যুর সংবাদে এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। এদিকে, তাবলিগ জামায়াত থেকে ফেরত বৃদ্ধের মৃত্যুর ঘটনায় ওই বাড়িসহ পাশের আরো একটি বাড়ি লকডাউন করেছে উপজেলা প্রশাসন।
বরিশাল: জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার পূর্ব বাগধা গ্রামে এক পুরুষ জ্বর, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে বুধবার দুপুরে মারা যান। একই ভাবে শেবাচিম হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার এক শিশু মারা গেছে। এ ঘটনার পর পূর্ব বাগধা গ্রামের প্রায় ৫০০ পরিবারকে লকডাউন করেছে উপজেলা প্রশাসন।
জানা গেছে, পূর্ব বাগধা গ্রামের সোহরাব মিয়ার পুত্র আলী আকবর (৩৫) বুধবার সকালে জ্বর, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ঢাকা থেকে নিজ বাড়িতে আসেন। দুপুরে নিজ বাড়িতে তার মৃত্যু হয়েছে। তবে তিনি করোনায় আক্রান্ত কি না তা জানতে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
ঝালকাঠি: জেলার নলছিটি উপজেলার ছয় বছরের এক শিশু করোনার উপসর্গ জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টে মঙ্গলবার সকালে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা গেছে। উপজেলা প্রশাসন বিষয়টি দেখবাল করছেন।
গাজীপুর: জেলার কাপাসিয়া উপজেলায় মঙ্গলবার রাতে ঠান্ডা, জ্বর কাশিতে উপজেলা টোক ইউনিয়নের উলুসারা গ্রামের এক যুবক মারা গেছেন। তিনি নারায়ণগঞ্জের একটি ফার্মেসিতে কাজ করতেন। উপজেলা প্রশাসন ওই বাড়িটি লক ডাউন করে দিয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ : নারায়ণগঞ্জে করোনার উপসর্গ জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টে আরো দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে নারায়ণগঞ্জে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ৯ জনে। গত বুধবার সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় করোনা ভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে মুজিবর রহমান (৬৫) নামে এক ব্যক্তি মারা গেছেন। তিনি জালকুড়ি এলাকার বাসিন্দা এবং আদমজী আঞ্চলিক শ্রমিক লীগের সহসভাপতি ছিলেন।
গতকাল বুধবার বেলা ১১টার দিকে ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ শহরের জামতলা এলাকায় পাঁচ দিন ধরে করোনার উপসর্গ জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টে অসুস্থ থাকার পর আফতাব উদ্দিন (৭০) নামে এক ব্যক্তি মারা গেছেন।
রংপুর : জেলার কাউনিয়ার হারাগাছ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মিনা রানী নামে এক নারী মারা গেছেন। শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে মঙ্গলবার গভীর রাতে তাকে হারাগাছ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। বুধবার সকালে তিনি মারা যান। তার বাড়ি রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ খানসামার হাটে।
অপরদিকে, মিঠাপুকুরের ভাংনি ইউনিয়নের কামালপুর গ্রামে মোর্শেদা বেগম নামে এক নারী করোনার উপসর্গ জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টে মঙ্গলবার টাঙ্গাইলের হাসপাতালে মারা যান। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নমুনা সংগ্রহের পরে লাশ মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানো হয়। লাশ নিয়ে আসার পর অ্যাম্বুলেন্সের চালক ও ওই নারীর স্বজনরা গা-ঢাকা দিয়েছে। পরে পুলিশ ও প্রশাসন তাকে দাফনের ব্যবস্থা করে।
রাজশাহী : রাজশাহীতে তাবলিগ ফেরত বৃদ্ধের কোয়ারেন্টাইনে মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকাল সাড়ে ৬টার দিকে বাঘা উপজেলার দক্ষিণ মিলিকবাঘা কামিয়া ইসলামী দারুল উলুম মহিলা মাদ্রাসায় কোয়ারেন্টাইনে তার মৃত্যু হয়। দুপুরে তার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাঘা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আক্তারুজ্জামান। আবুল কালাম আজাদের (৬৫) বাড়ি উত্তর মিলিকবাঘা গ্রামে।
৪০ দিনের তাবলিগে বের হয়ে সর্বশেষ তিনি কুষ্টিয়ায় ছিলেন। সেখানে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেওয়ায় চিল্লা শেষ না করেই তিনি গত ৫ এপ্রিল গ্রামে ফিরেন। ডা. আক্তারুজ্জামান বলেন, জ্বর ও শ্বাসকষ্ট থাকলেও তার করোনার উপসর্গ জোরালো ছিল না। তার ডায়াবেটিক ও হাই পেশার ছিল।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন