নীতিমালা অনুযায়ী সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি-পদায়নের সময় জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত। এর আগে বা পরে কেউ বদলির জন্য আবেদন বা তদবির করতে পারবেন না। আবেদন করলেও তা গ্রহণ করা হবে না। অতীতে বরাবর এই নীতিমালাই অনুসৃত হয়ে আসছে। অথচ এ বছর জানুয়ারি আসার আগেই সকল বদলি-পদায়ন সম্পন্ন করে ফেলা হয়েছে। নীতিমালা বা কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। এমনকি শুধু শূন্য পদেই নয়, ভবিষ্যতে অর্থাৎ আগামী ছয় মাসে যেসব পদ শূন্য হবে সেগুলোকে শূন্য ধরে বদলি-পদায়ন করা হয়েছে। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর, মন্ত্রণালয়সহ গোটা প্রাথমিক শিক্ষা খাতে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
সূত্র জানায়, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯ প্রাথমিক শিক্ষা অদিধফতরের মহাপরিচালক ড. এএফএম মঞ্জুর কাদিরের চাকরির বয়স শেষ। আর সেই কারণেই তিনি পদে থাকাকালে কোনো নিয়ম-নীতি বা নীতিমালার তোয়াক্কা না করে অত্যন্ত গোপনে আগাম এ কাজগুলো করে যান। তাকে এ কাজে সহযোগিতা করেন অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা। তবে মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: আকরাম-আল-হোসেনেরও এতে যোগসাজশ রয়েছে। কিন্তু এই অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপারে প্রচণ্ডভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তার অগোচরেই এসব ঘটেছে এবং তিনি জানতে পেরে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। নতুন মহাপরিচালক যোগ দেয়ার পর প্রতিমন্ত্রী তাকে এসব অবৈধ বদলির আদেশ বাতিল করার নির্দেশও দিতে পারেন বলে জানা গেছে।
সূত্রমতে, মহাপরিচালক পদ থেকে অবসরের আগ মুহূর্তে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে অন্তত তিন শতাধিক সহকারী শিক্ষক বদলি করে গেছেন ড. মঞ্জুর কাদির। এটা ওপেন-সিক্রেট যে, রাজধানী ঢাকায় প্রতিজন সহকারী শিক্ষক বদলির জন্য ৭/৮ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হয়। ঢাকার বাইরে দু’তিন লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়ে থাকে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) খান মো. নুরুল আমিন, উপপরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) মির্জা হাসান খসরু ও শিক্ষা অফিসার (পলিসি ও অপারেশন) সেলিনা আক্তারের সহযোগিতায় এই বদলি বাণিজ্য হয়েছে। এতে অন্তত কয়েক কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, বদলিতে আগ্রহী শিক্ষকদের কাছ থেকে দরখাস্ত নেয়া থেকে শুরু করে পুরো প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়েছে। অফিস আওয়ারের পরে রাতের ১১টা-১২টা পর্যন্ত এবং ছুটির দিনেও সারাদিন গোপনে কাজ করেছেন ডিজিসহ এই কর্মকর্তারা। তাদের এ কাজে সহায়তা করেছেন কয়েকজন দালাল শ্রেণির শিক্ষক নেতা। বদলিতে আগ্রহী শিক্ষকদের সঙ্গে অর্থের লেনদেনও এরা করেছেন। পলিসি ও অপারেশন শাখার তিন কর্মকর্তার মাধ্যমে এই অর্থ ভাগবাটোয়ারা হয়েছে। বদলির আবেদন ও প্রস্তাবের ফাইল উপস্থাপন থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন পর্যন্ত হয়েছে ডিসেম্বরের তারিখে। তবে বদলির আদেশ জারি হয়েছে ১ জানুয়ারি, ২ জানুয়ারির তারিখ দিয়ে। যদিও এই বদলির আদেশগুলোও জারি হয়েছে ডিসেম্বরেই, যেহেতু ডিসেম্বরের তারিখে বদলির আদেশ জারি করা কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়। কারণ, তাতে নীতিমালা সরাসরি লঙ্ঘিত হয়।
কিন্তু নীতিমালায় বলা আছে, জানুয়ারির আগে কারো কোনো বদলির আবেদন গ্রহণ করা যাবে না। অথচ এখানে দেখা যাচ্ছে, ডিসেম্বরে বদলির আবেদন গ্রহণ করে সেগুলোর প্রস্তাব অনুমোদন পর্যন্ত করা হয়েছে ডিসেম্বরের তারিখ দিয়ে। যা নীতিমালা অনুযায়ী কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষকরা জানতেনই না, ডিসেম্বরে বদলির আবেদন গ্রহণ করা হবে। আগ্রহী শিক্ষকদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে বদলির কন্ট্রাক্ট করেন পলিসি ও অপারেশন উইংয়ের তিন কর্মকর্তা খান মো. নুরুল আমিন, মির্জা হাসান খসরু, সেলিনা আক্তার এবং শিক্ষক নেতা নামধারী কতিপয় দালাল।
জানা যায়, প্রতিবছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষক নিজেদের সুবিধার জন্য গ্রাম থেকে শহরে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় বদলি হওয়ার জন্য তদবির করেন। শিক্ষকদের এই বদলি ও পদায়নকে ঘিরে কোটি কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন হয়। তবে হাজার হাজার শিক্ষকের মধ্যে তদবির এবং ঘুষ লেনদেনের প্রতিযোগিতায় যারা এগিয়ে থাকেন তাদেরকেই কেবল প্রত্যাশিত জায়গায় বদলি ও পদায়ন করা হয়। বিশেষ করে ২০১৪ সালে মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী হবার পর পরই এই বদলি বাণিজ্য বেশ জমজমাট রূপ ধারণ করে। অবশ্য, পরবর্তীতে এ মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে আসিফউজ্জামান আসার পর তিনি নিজের একক চেষ্টায় বদলি বাণিজ্যের লাগাম কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হন। কিন্তু মোস্তাফিজুর রহমানের বিভিন্ন দুর্নীতি-অনিয়মে বাধা দেয়ায় এ নিয়ে এক পর্যায়ে সচিবের সঙ্গে মন্ত্রীর দ্বন্দ্ব বেধে যায়। ক্ষুব্ধ মন্ত্রী উপরের মহলে তদবির চালিয়ে সচিবকে ডাম্পিং পদে বদলির ব্যবস্থা করেন।
উল্লেখ্য, ড. এএফএম মঞ্জুর কাদির এক সময় প্রশাসনে একজন সৎ ও নীতিবান কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলেই এক সময় পাবনার ডিসি থাকাকালে সেখানকার কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম ঠেকাতে গিয়ে স্থানীয় ছাত্রলীগ-যুবলীগের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত বেধে যায় তার। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারও তখন বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। যা ছিল তার জন্য বিপজ্জনক। কিন্তু তারপরও তিনি তখন অনিয়মের কাছে হার মানেননি। তার ওই সাহসী অবস্থান নিয়ে সারাদেশে ব্যাপক আলোচনা হয়। অথচ সেই কর্মকর্তাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের ডিজি পদে আসার পর নিজের সুনাম রক্ষা করতে পারেননি। চাকরির শেষ মুহূর্তে এসে এখন যে কেলেংকারি কাণ্ড বাধালেন তাতে তার সারাজীবনের অর্জন সবই ধুলোয় মিশে গেছে, এ অভিমত সংশ্লিষ্ট মহলের।
সূত্রমতে, ড. মঞ্জুর কাদির প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক পদে পদায়নের আগে প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব পদে ছিলেন। কিন্তু তিনি অধিদফতরের ডিজি পদে আসার পর এ মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম-আল-হোসেনের প্রভাব তার ওপর বিশেষভাবে কাজ করেছে। মূলত সচিবের প্রভাবেই তিনি এখানে নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বিশেষ করে শেষ মুহূর্তে বদলি নিয়ে যে কেলেংকারি কা- ঘটে গেছে তাতে সচিবের প্রশ্রয় ও প্রভাব বিশেষভাবে কাজ করেছে। তা নাহলে নীতিমালা লঙ্ঘনের মতো এতোবড় অনিয়ম করার সাহস পেতেন না ড. মঞ্জুর কাদির। এ বদলি-পদায়ন কেলেংকারির বিষয়ে শীর্ষকাগজের পক্ষ থেকে ফোনে জানতে চাওয়া হলে মঞ্জুর কাদির নিজেও সচিবের প্ররোচনার কথা উল্লেখ করেন।
তবে তিনি বলেন, শিক্ষকদের সুবিধার কথা বিবেচনা করেই জানুয়ারির আগে বদলি-পদায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সব শিক্ষকই তো নিজেদের পছন্দের স্থানে পদায়ন চাইবে, সবাইকে কী একই সুবিধা দেয়া সম্ভব- এ প্রশ্নের জবাবে ড. মঞ্জুর কাদির বলেন, না সম্ভব নয়।
যাদের তদবিরের জোর বেশি এবং যারা তদবির প্রতিযোগিতায় এগিয়ে ছিলেন তাদের ইচ্ছাই পূরণ হয়েছে, তাই নয় কী- এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি মঞ্জুর কাদির।
আপনি জানেন, জানুয়ারির ১ তারিখে আপনি এ পদে নেই। তার আগেই আপনাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যোগ দিতে হবে। তাই নীতিমালার তোয়াক্কা না করে জানুয়ারির আগেই বদলি-পদায়ন সম্পন্ন করেছেন এবং এতে ব্যাপকহারে অর্থের লেনদেন হয়েছে -এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি মঞ্জুর কাদির।
ড. মঞ্জুর কাদির অবশ্য দাবি করেন বদলি-পদায়নের সংখ্যা তিন শতাধিক নয়, তারচেয়ে আরো কম এবং এর বেশিরভাগই ঢাকার বাইরের। তিনি দাবি করেন, ঢাকায় কোনো বদলি-পদায়ন করা হয়নি। কিন্তু যখন তাকে বলা হলো, ঢাকায় বদলির প্রমাণ আছে শীর্ষকাগজের হাতে- মঞ্জুর কাদির বললেন, বিচ্ছিন্নভাবে দু’একজন হতে পারে, এর বেশি নয়।
অথচ সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজের হাতে যে তথ্য আছে দেখা যাচ্ছে, একটি বদলির আদেশেই ঢাকায় ১৬ জনকে পদায়ন করা হয়েছে। জানা গেছে, বেশিরভাগ বদলিই হয়েছে বিচ্ছিন্ন এবং একক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে। এমন বিশেষ কৌশল নেয়া হয়েছে এই উদ্দেশ্যে যে, যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া অন্যরা পুরো ঘটনা বুঝতে বা জানতে না পারেন। অথচ নিয়ম হলো, সকল বদলির বিষয়ে একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয়া এবং একই সঙ্গে আদেশ জারি করা।
অবাক ব্যাপার হলো, ঢাকায় একসঙ্গে যে ১৬ জন সহকারি শিক্ষকের পদায়নের “অফিস আদেশ” জারি হয়েছে সেটিতে তারিখ দেয়া হয়েছে গত বছরের ০১ জানুয়ারির। কিন্তু অফিস আদেশের নিচে স্বাক্ষর করা হয়েছে ০১-০১-২০ তারিখ দিয়ে। অফিস আদেশে স্বাক্ষর করেছেন, সরকারের যুগ্মসচিব, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (পলিসি এন্ড অপারেশন) খান মো. নুরুল আমিন। অনিয়ম-অপকর্মে বেশি তাড়াহুড়ো করতে গিয়েই এতো বড় ভুল রয়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এই বদলির আদেশের স্মারক নম্বর- ৩৮.০১.০০০০.১৪৫.১৯.১৮৩.১৯-৫৭, তারিখ- ০১ জানুয়ারি, ২০১৯। এছাড়া বদলির অন্য আদেশগুলো প্রায় সবই পৃথক পৃথকভাবে জারি করা হয়েছে। বদলির আদেশ জারি করে গোপনে শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির হাতে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি গিয়ে পদায়নের স্থানে যোগদান করছেন। এতে অন্যরা জানতে বা বুঝতেও পারছেন না।
তবে এ সবই হয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোঃ জাকির হোসেনের অজান্তে। তিনি এ সম্পর্কে পুরোপুরিই অন্ধকারে ছিলেন। এভাবে দুর্নীতি-জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাপকহারে শিক্ষক বদলির ঘটনায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রতিমন্ত্রী।
সূত্র আরো জানায়, চাকরির শেষ সময়ে এসে শুধু এই বদলি-পদায়ন কেলেংকারিই নয়, অবৈধভাবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বেশ কিছু পদে আউট সোর্সিং কর্মচারীও নিয়োগ দিয়ে গেছেন ড. মঞ্জুর কাদির। যার বেশিরভাগই তার নিজ এলাকা রংপুরের বলে জানা গেছে। নিয়ম অনুযায়ী পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি বা টেন্ডার ছাড়া কখনোই সরাসরি আউট সোর্সিং কর্মচারী নিয়োগ দেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করেননি তিনি। অভিযোগ উঠেছে, এসব নিয়োগেও একটি চক্র বড় অংকের অর্থের লেনদেন করেছে।
(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ২০ জানুয়ারি ২০২০ প্রকাশিত)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন