স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি কারা দিয়েছিল—ভুটান না ভারত, তা নিয়ে বিতর্ক আছে দীর্ঘদিন ধরেই। যদিও বছর পাঁচেক আগে বাংলাদেশ সরকার জানিয়ে দেয়, দিল্লির স্বীকৃতি মেলার কয়েক ঘণ্টা আগেই থিম্পু থেকে এসেছিল স্বীকৃতির সনদ। কাজেই সেই কৃতিত্বের দাবিদার ভুটানই।
যদিও সেন্টার ফর বাংলাদেশ জেনোসাইড রিসার্চের মতো প্রতিষ্ঠান এই দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে। তাদের তথ্য ও গবেষণা বলছে, ভুটানের কিছু সময় আগে বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছিল ভারতই।
কিন্তু কে কয়েক ঘণ্টা আগে বা পরে স্বীকৃতি দিয়েছিল, সেই বিতর্কে না ঢুকেও ভারতের সাবেক কূটনীতিবিদরা জানাচ্ছেন, ভুটান যে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছিল, সেটা কিন্তু করা হয়েছিল ভারতের অনুরোধেই।
ভুটান ও বাংলাদেশ— উভয় রাষ্ট্রেই ভারতের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন প্রবীণ ভারতীয় কূটনীতিবিদ ইন্দর পাল খোসলা। থিম্পুতে তিনি ছিলেন গত শতকের সাতের দশকের মাঝামাঝি, আর ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নেন আটের দশকের গোড়ার দিকে।
ভারত ও ভুটানের মধ্যে ১৯৪৯ সালে সই হওয়া ‘ফ্রেন্ডশিপ ট্রিটি’র প্রসঙ্গ টেনে এই বর্ষীয়ান কূটনীতিবিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বাংলাদেশের বিজয় দিবসে বলেন, ‘ওই মৈত্রী চুক্তি অনুসারে ভুটানের প্রতিরক্ষা, বিদেশনীতি বা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতের একটা বলিষ্ঠ মতামত দেওয়ার অধিকার ছিল।’
তিনি বলেন, ‘ফলে ভুটান তখন বিদেশনীতির ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে পরামর্শ না করে কোনও স্বাধীন মতামত নিতো না। আর সেটা প্রয়োগ করেই কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভুটানকে বলেছিলেন অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে।’
ইন্দর পাল খোসলা আরও বলেন, ‘আমার যতদূর মনে পড়ছে, ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব টি এন কাউলই কিন্তু দিল্লিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেছিলেন, ভুটান বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এরপর ওই খবর বিবিসি, রয়টার্স বা এএফপির মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হয়।’
ভুটান যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, সেটা ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর। ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম রণাঙ্গনে তখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সালমান হায়দারের কথায়, ‘আসলে যে দেশটা সরাসরি ওই যুদ্ধে জড়িত, তার চেয়ে তৃতীয় কোনও দেশের থেকে স্বীকৃতি এলেই যে সেটা আন্তর্জাতিকভাবে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে— এটা আঁচ করেই কিন্তু ভারত সরকার ভুটানকে ওই অনুরোধ জানিয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘মনে রাখতে হবে ভুটান তার মাত্র দুই-তিন মাস আগেই জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ পেয়েছিল।’
সালমান হায়দার বলেন, ‘ভারতের প্রভাব বলয়ে থাকলেও আলাদা একটি সার্বভৌম দেশ হিসেবে তখন ভুটানের বক্তব্যের আলাদা গুরুত্ব ছিল। আর একাত্তরের কূটনৈতিক লড়াইয়ে সেটাকেই কাজে লাগিয়েছিল দিল্লির সাউথ ব্লক।’
সালমান হায়দার নিজেও বহুদিন থিম্পুতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেন, তার এটাও আবছা আবছা মনে আছে, ভুটানের রাজার সই করা স্বীকৃতির সনদ প্রথমে দিল্লির হাতেই তুলে দেওয়া হয়েছিল, যা পরে ভারতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
বস্তুত ভুটানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি পাইয়ে দিয়ে ভারত যে কুশলী কূটনৈতিক চাল দিয়েছিল, যুদ্ধের পরেও ঠিক একইভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করে তৎকালীন সোভিয়েত ব্লক।
মজার ব্যাপার হলো, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নেরও আগে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় তখন তাদের প্রভাব বলয়ে থাকা কমিউনিস্ট-শাসিত পূর্ব জার্মানি এবং এর পরপরই পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়া। পূর্ব জার্মানিই ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে প্রথম দেশ, যারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, পূর্ব জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অটো উইনজার হঠাৎ এক সফরে তার আগের দিন দিল্লিতে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন।
বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সেদিন পাকিস্তানে তার বন্দিদশার শেষে লন্ডন হয়ে ঢাকায় ফেরার পথে দিল্লিতে সংক্ষিপ্ত ‘স্টপওভার’ নিয়েছিলেন। ঢাকা থেকে দিল্লিতে এসে পৌঁছেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদও।
দিল্লিতেই বাংলাদেশ সরকারের হাতে তাদের স্বীকৃতির সনদ তুলে দেন পূর্ব জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এরপর একে একে সেই ধারাই অনুসরণ করে বিশ্বের অন্যান্য দেশ, সংক্ষেপে যাকে বলা যেতে পারে— বাকিটা ইতিহাস।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন