ওমর ফারুক
‘হ্যালো’
‘আপনি কি সাংবাদিক ওমর ফারুক বলছেন।’
‘বলছি।’
‘আপনিতো আমাদের সর্বনাশ করে ফেলেছেন।’
ফোনকারীর কথা শোনে চমকে গেলাম। আমি আবার কি করলাম। জানতে চাইলাম তার কাছে। তিনি বললেন-
‘আপনি আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবার নাম রাজাকারের তালিকায় ছেপেছেন।’
আবারো চমকালাম তার কথা শোনে। বিষয়টি কি সত্যি? সেই দিনটি ছিল ২০১১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। সেদিন কালের কণ্ঠ পত্রিকায় ‘যুদ্ধাপরাধ : দালাল আইনে বন্দির তালিকা মন্ত্রণালয়ে’ শিরোনামে আমার করা একটি লিড রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। পুরো এক পাতা জুড়ে ৫৫৫ জন রাজাকারের ঠিকানাসহ নাম প্রকাশ করা হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর পরই স্বাধীনতা বিরোধীদের তালিকা প্রকাশের উদ্যোগের অংশ হিসেবে কারা কর্তৃপক্ষকে তালিকা সংগ্রহের নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের প্রত্যেকটি কারাগার থেকে ওই সময় দালাল আইনে যার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন তাদের তালিকা খুঁজে বের করার কাজ শুরু হয়। দেশের যে ক’টি করাগার থেকে ওই সময় পর্যন্ত তালিকা পাওয়া গিয়েছিল সেটির তালিকা করে কারা অধিদপ্তর। বিষয়টি জানতে পেরে আমি অনেক দিন চেষ্টার পর পাঁচ শতাধিক স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তির তালিকা পাই। হয়তো আরো ছিল যেটি আমি সংগ্রহ করতে পারিনি। সেই তালিকা প্রকাশ করেছিল কালের কণ্ঠ।
আমার নামে রিপোর্টটি প্রকাশের পর দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আমার মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে ফোন করা হয়। কেউ কেউ হুমকি দেন। পরদিন দু’তিনটি জেলায় এই রিপোর্টের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা দাবীদার। তারা দাবী করেন তারা মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও তাদের নাম রাজাকারের তালিকায় প্রকাশ করা হয়েছে। তবে তাদের কেউ পত্রিকা অফিসে প্রতিবাদ পাঠাননি। তাদেরই একজনের ছেলে আমাকে ফোন করেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন তিনি সরকারি চাকরি করেন। পত্রিকায় তার বাবার নাম রাজাকার হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার কারণে এলাকায়, আত্মীয় স্বজনদের কাছে ছোট হয়েছেন। আমি তাকে বললাম-
‘রিপোর্টে আপনার বাবার নাম, গ্রামের নাম সব ঠিক আছে?
‘সব ঠিক আছে’
‘তাহলে আমার রিপোর্টও ঠিক আছে। আমি কোনো ভুল করিনি।’
এবার তার ক্ষিপ্ততা আরো বাড়ছে।
‘আপনি কি বলতে চাইছেন আমার বাবা রাজাকার?’
‘আমি তা বলতে চাইছি না। আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি আপনাকে?
‘বলুন’
‘আপনার বাবা কি বেঁচে আছেন?
‘আছেন’
‘হাটাচলা করতে পারেন, কথা বলতে পারেন?’
‘হ্যা! পারেন।’
‘তা হলে ফোনটি আপনি কেন করেছেন, আপনার বাবা কেন করলেন না?’
বুঝতে পারছিলাম আমার প্রশ্ন শোনে তিনি কিছুটা তথমথ খেয়ে যান। আমি তখন সেই তালিকা বের করি। সেখানে স্পষ্ট লেখা রয়েছে তার বাবা কত তারিখে দালাল আইনে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে গিয়েছিলেন। কত তারিখে জামিনে মুক্ত হয়েছেন। মামলার নম্বর ধারাসহ বলে দিই। এবং যেটুকু মনে পড়ে এও বলেছিলাম আপনার বাবাকে আমাকে ফোন করতে বলবেন। সেদিন ওই ভদ্রলোক ফোন কাটেন। ফোনটি করেছিলেন সম্ভবত দুপুর ১টার দিকে।
সন্ধ্যা সাতটার দিকে একই ব্যক্তি আবারও আমার মোবাইলে ফোন করেন। এবার তার কান্না স্পষ্ট। তিনি বললেন-
‘ভাই সরি। আমি আপনার সঙ্গে হয়তো খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি।’
বললাম, ‘ঠিক আছে। ফোন করেছেন কেন বলেন।’
‘আমার বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি স্বীকার করেছেন ১৯৭২ সালে দালাল আইনে জেলে ছিলেন। এখন আমরা কি করবো ভাই। একটা পথ দেখান।’
‘এ বিষয়ে আমার কিছু করণীয় নাই।’ বলে সেদিন ফোন কেটে ছিলাম।’
লেখক : জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, কালের কণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন