যারা আমেরিকান লেখক অ্যালেক্স হ্যালির ‘রুটস’ উপন্যাসটি পড়েছেন তাদের নিশ্চয়ই কুন্টাকিন্টের কথা মনে আছে। এই উপন্যাসে লেখক দাসপ্রথার নির্মমতা এবং দাসদের করুণ জীবনের কথা তুলে এনেছিলেন। আমেরিকাতে এই ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালও তৈরি হয়েছিল। যারা তা দেখেছেন অথবা বইটি পড়েছেন তাদের অনেকেই চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। এসব দাসদের ছিল না কোনো স্বাধীনতা, কোনো কর্মঘণ্টা। প্রভুর ইচ্ছের বাইরে তাদের কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিল না। দাসপ্রভুরা মুক্ত শ্রমের পরিবর্তে বন্দিশ্রমিকের শ্রম বেশি পছন্দ করতো। নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থেই তারা দাস প্রথাকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। স্বভাবতই দাসদের ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারী দাসদের ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হতো।
দাস ব্যবসা সেই প্রাচীনকাল থেকে শুরু হয় যা মধ্যযুগ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলেই এ প্রথা প্রচলিত ছিল। তবে তা মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল ১৬০০ থেকে ১৯০০ শতাব্দী পর্যন্ত। নানা আন্দোলন-সংগ্রামের পর বিশ্বব্যাপী আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এ প্রথা। সর্বশেষ আমেরিকাতে ১৮৬৫ সালে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ হয়। এরপর দেড়শ বছর কেটে গেছে। পৃথিবীর মানুষ সভ্যতার যুগে প্রবেশ করেছে। অথচ তথাকথিত আধুনিক সভ্যতার দাবিদার সমাজে এখন নতুন করে, নতুন মাত্রায় দাস ব্যবস্থা টিকে থাকার ও সম্প্রসারণের নানা খবর আমাদের আতঙ্কিত করছে, লজ্জিত করছে। বেশ কিছুকাল যাবৎ আমাদের দেশের পুরুষ শ্রমিকেরা বিভিন্ন দেশে গিয়ে আধুনিক দাস জীবন মেনে নিয়েছেন অথবা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন বলে আমরা প্রকাশিত খবরে দেখতে পাই। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের গৃহকর্মী হিসেবে কোন মালিক কর্তৃক কিনে নেয়া এবং পছন্দ না হলে স্থানীয় দালালদের কাছে বিক্রি করে দেয়ার যে সকল ঘটনা প্রকাশিত হচ্ছে তা তো দাস ব্যবস্থাকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন- ‘মানুষের সুবিধাবাদী চরিত্রের কারণে দাসপ্রথা সমাজ থেকে নির্মূল হয়নি। সরকার যদি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারতো তাহলে এই প্রথা কমে আসার সম্ভাবনা তৈরি হত।’
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে বেকার মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সরকারি নীতি শুরু থেকেই বৈষম্যমূলক হওয়ায় সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র এদেশে সংকুচিত হতে থাকে। ফলে বেকারত্ব দূর করে কিছুটা সচ্ছল জীবন যাপনের আশায় বৈধ-অবৈধ পথে মানুষ বিদেশে পাড়ি জমাতে থাকে। যা ধীরে ধীরে এদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বড় ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। বর্তমানে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস অভিবাসী শ্রমিক। কাজের কিছুটা সহজ সুযোগ থাকায় কাজের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমানো মানুষের ৮০ শতাংশ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে যায় এবং তাদের অন্যতম গন্তব্য সৌদি আরব। আরেকটি বড় সমস্যা আমাদের সমাজে রয়েছে, আর তা হলো কাজের শ্রেণিবিভাজন করা। এ কাজ ভাল নয় ও কাজ সম্মানের নয় ফলে ওটা করা যাবে না- এ ধরণের সামাজিক মনস্তত্ত্ব গড়ে ওঠার কারণে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ এদেশে না খেয়ে থাকবে কিন্তু গৃহশ্রমিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী বা হোটেল বয়ের কাজ করবে না। অথচ এরাই বিদেশে এ সকল চাকরি নিয়ে ছুটছে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া অধিকাংশ মানুষই ‘ড়ফফ লড়ন’ করে থাকে।
২০১০ সাল থেকে নানা কারণে বাংলাদেশের শ্রমিকদের বাজারে কিছুটা মন্দা দেখা দেয়। সৌদি আরবে দীর্ঘসময় বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ থাকে। সে সময়ে নেপাল, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া থেকে নারী গৃহশ্রমিক সৌদি আরবে যেতে থাকে। অতিরক্ষণশীল পশ্চাদপদ সৌদি আরবের বিরুদ্ধে নারী গৃহশ্রমিকদের যৌন নিপীড়নসহ মানসিক নানা নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। ঐ সকল দেশ তাদের শ্রমিকদের ফেরত নিতে শুরু করে এবং সাথে সাথে সৌদিতে শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দেয়। ২০১৫ সালে সৌদি সরকার নারী গৃহশ্রমিক পাঠনোর শর্তে বাংলাদেশের শ্রমবাজার খুলে দেয়ার ঘোষণা দেয়। আমাদের দেশের শাসক দলগুলো যারা এ পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন এবং এখনও করছেন তারা কখনোই নারী বান্ধব বা শ্রমিকবান্ধব ছিল না, এখনো নেই। ফলে শ্রমিকের স্বার্থের চেয়ে অর্থনৈতিক লাভের হিসেব তাদের কাছে মুখ্য। শ্রমিকের নিরাপত্তা বিশেষ করে আমাদের দেশের অশিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত, প্রশিক্ষণহীন নারী যাদের গৃহশ্রমিকের কাজের জন্য প্রকারান্তরে গৃহদাস হিসেবে পাঠনো হচ্ছে তাদের নিরাপত্তা সরকারি রেমিট্যান্সের কাছে তুচ্ছ গণ্য হয়।
গত চার বছরে প্রায় তিন লাখ নারী গৃহকর্মী সৌদি আরবে গিয়েছে। সরকারি হিসেবে মতে এদের মধ্যে এ পর্যন্ত প্রায় আট হাজার ফেরত এসেছে। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য থেকে ৩১১ জন নারী শ্রমিকের লাশ বাংলাদেশে আনা হয়েছে। এক তথ্যমতে চলতি বছরে দশ মাসে সৌদি আরবে গৃহশ্রমিক হিসেবে যাওয়া বাংলাদেশের ৯৬০ জন নারী দেশে ফেরত এসেছে, তাদের মধ্যে ৪৮ জন এসেছে লাশ হয়ে। আরও ভয়াবহ খবর হলো মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে ৩১১ জনের লাশ এসেছে তাদের মধ্যে ৫৩ জনই আত্মহত্যা করেছে, ১২০ জন স্ট্রোকে এবং ৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে নানা দুর্ঘটনায়। এসব নারীদের বয়স ২০ থেকে ৪০ এর মধ্যে।
কী অপরাধ ছিল এসব শ্রমিকদের? একটু ভাল থাকা, পরিবার পরিজনকে একটু ভাল রাখার আশায় তারা দেশ ছেড়েছিলেন। অধিকাংশই ঋণ নিয়ে, সহায়-সম্বল বিক্রি করে সচ্ছল জীবনের খোঁজে বুকভরা আশা নিয়ে তারা বিদেশে গিয়েছিলেন। বিনিময়ে সেখানে তারা যৌন নিপীড়নসহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরেছেন, ফিরেছেন লাশ হয়ে। যারা বেঁচে ফিরেছেন তাদের তথ্য অনুযায়ী অনেককে বেতন না দিয়ে দিনের পর দিন অভুক্ত রাখা হত, কেউ কেউ পালিয়ে সেভ হোমে গিয়ে আশ্রয় নিয়ে জীবন বাঁচিয়েছে, কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ করে এক গভীর অন্ধকার ভবিষ্যত নিয়ে ফিরে এসেছে। কেউবা ইতোমধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। নারীরা শুরুতে গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরব গেলেও কিছু স্থানীয় দালাল এমনকি গৃহকর্তাও তাদের বিক্রি করে দিচ্ছে। কম বেতন, বেতন না দেয়া, অতিরিক্ত কাজের চাপ, ভাষাগত সমস্যা, মালিক কর্তৃক যৌন নির্যাতন এসকল নারীকে এক জটিল অমানবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
এই যখন সৌদি আরবে যাওয়া নারী শ্রমিকদের অবস্থা তখন সমর্থিত সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে -একটি দালাল চক্র সিরিয়ায় কর্মী পাঠানোয় নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্বেও সম্প্রতি যৌন ও গৃহকর্মী হিসেবে বিক্রির জন্য বাংলাদেশে থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৪০ জনের অধিক নারীকে সিরিয়ায় পাচার করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশের নারীদের যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে। বিশেষ করে সিরিয়া, লেবানন, সৌদি আরব, জর্ডানসহ বেশ কিছু দেশে নারী পাচারের ঘটনার খবর আমাদের হতবিহ্বল করে তুলেছে।
এ অবস্থার জন্য প্রধানত দায়ী আমাদের সরকার ব্যবস্থা। দেশের জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন দেশে দূতাবাস থাকা সত্ত্বেও সরকার কেন এত বছরে শ্রম রপ্তানির বিকল্প বাজার গড়ে তুলতে পারল না, চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে পারল না সে প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক। রিক্রুটিং এজেন্টদের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কিছুতেই এর দায় এড়াতে পারে না। সরকারি মনিটরিং এবং প্রচারণা সীমিত, দুর্বল ও শ্রমিকবান্ধব না হওয়ার কারণেই সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার। জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য নির্ভরতা সরকারের অদক্ষতারই প্রমাণ দেয়। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ঘটনার ভয়াবহতাকে সরকার গুরুত্ব দিতে চাইছে না। বছর বছর শত হাজার কোটি টাকা রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে যে প্রবাসী শ্রমিকেরা তাদের নিরাপত্তায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সরকারের নির্লিপ্ততা নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। সকল শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে নারী গৃহশ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান কোন বিবেচনায়ই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে অনেক দেশ শক্ত অবস্থান নিয়েছে কিন্তু বাংলাদেশ পারেনি। ফিলিপিন, নেপাল, শ্রীলংকা ইতোমধ্যেই সৌদি আরবে নারী গৃহশ্রমিক পাঠনো অবৈধ ঘোষণা করেছে। আমাদের সরকারের যুক্তি -তারা বাজার হারাতে চায় না। তাই বলে জনশক্তি রপ্তানির নামে নারীদের গৃহদাস করে বিদেশে পাচার করা কোনভাবেই সমর্থন করা যায় না।
আমরা জনশক্তি রপ্তানির বিপক্ষে নই। নারী শ্রমিক রপ্তানিরও বিপক্ষে নই। কিন্তু কোন জনশক্তি রপ্তানি করবো সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে। গৃহকর্মী বা গৃহদাস হিসেবে বাংলাদেশের কোনো নারীকে বিদেশে পাঠানো যাবে না। শুধুমাত্র দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করতে হবে, নারীদের পাঠানোর ক্ষেত্রে এমন পেশা বেছে নিতে হবে যাতে তারা আত্মমর্যাদার সাথে কাজ করতে পারে। রিক্রুটিং এজেন্টদের অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
নারী দাস হিসেবে যারা সৌদি আরব গিয়েছে তাদের কান্না সরকারের কানে পৌঁছাতে চার বছর সময় লেগে গেল। নাজমার আকুতি শুনে ব্যবস্থা গ্রহণের মত কাউকেই পাওয়া গেল না। এখন যে সকল নারীরা সৌদিতে নরক যন্ত্রণার মধ্যে আছে তাদের ফিরিয়ে আনতে আরও কত নাজমা ঝরে যাবে সেটাই দেখার অপেক্ষা। (সংগৃহিত)
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন