রাজউকের কর্মকতা-কর্মচারীদের অনিয়ম আর দুর্নীতির বিষয়টি সবারই জানা। রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের রাজউক নিয়ন্ত্রিত এলাকার বাড়ি আর জমির মালিকদের কাছে একটি আতংকের নাম হচ্ছে এই রাজউক। রাজধানীতে সাম্প্রতিক কয়েকটি ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান জানান দিলেও থেমে নেই নকশা বহির্ভুত ভবন নির্মাণ। ভবনের নকশা পাস করতে মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ না দিলে ফাইল নড়ে না যা দিবালোকের মত সত্য। আবার, ঘুষ দিলে নকশার তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমতো কাঠামোয় বাড়ি নির্মাণ করা যায়। এতে রাজউক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভবিষ্যত আয়ের পথও খোলা হয়ে যায়। বাড়ি নির্মাণের পর মালিকের পক্ষে তো তা ভেঙ্গে নতুন করে নির্মাণ করা সম্ভব নয়। ফলে পরবর্তীতে যখন যারা দায়িত্বে আসেন দফায় দফায় নোটিস দিয়ে অর্থ আদায় করতে পারেন।
এভাবেই রাজউকের কোনো কোনো কর্মকর্তা, অথরাইজড অফিসার ও ইমারত পরিদর্শক বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক বনেছেন। এমনি এক অথরাইজড অফিসার রাজউকের ৪নং জোনের মোহাম্মদ হোসেন। তিনি একজন অথরাইজড অফিসার কিন্তু ক্ষমতা খাটান জোনের পরিচালকের চেয়েও বেশি। জোনের পরিচালকের তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন ফাইল পাস, প্ল্যান পাস, নকশা অনুমোদন, ভবন মালিকদের নোটিশ প্রদান করছেন। জোন পরিচালককে না জানিয়ে বিল্ডিং কন্সট্রাকশন বা বিসি কমিটির বৈঠকের তারিখ নির্ধারণ করেন। তার অনিয়মের বিরুদ্ধে অফিসে কেউ টু শব্দটি করতে সাহস পায় না। এভাবে নিজে নীতি নির্ধারক হয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। মোহাম্মদ হোসেনের ক্ষমতার দাপট এতোই যে, তার অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে খোদ জোন পরিচালককেই এখন আউট হয়ে যেতে হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা গুলশান, বারিধারা, বনানী, বাড্ডা, পূর্বাচল প্রভৃতি এলাকা রাজউকের জোন-৪ এর অধীনে। ৪নং জোনের অথরাইজড অফিসার হিসেবে নিয়োগ পাবার পর মোহাম্মদ হোসেন এখানে গড়ে তুলেছেন এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যেমে বিভিন্ন অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। অদৃশ্য খুঁটির জোরে সকল ক্ষমতার ওপরে গড়ে তুলেছেন নিজেকে। চাকরির দিক থেকে অধঃস্তন হলেও জোনের পরিচালক পদে যখন যিনি আসেন তাকে সমীহ করে চলতে হয়। না হলে পরিচালককেই ন্যক্কারজনকভাবে এখান থেকে বিদায় নিতে হয়।
জানা গেছে, জোন-৪ এর পরিচালক পদে উপসচিব মোহাম্মদ মামুন মিয়ার পদায়ন হলে তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন এবং এক পর্যায়ে তাকে উপেক্ষা করতে থাকেন মোহাম্মদ হোসেন। অফিসের কাজে অবাধ্যতা এবং বিরক্তি প্রদর্শনও করেন। ৮ তলা পর্যন্ত ভবনের নকশা অনুমোদনের বিষয়ে বিসি কমিটির সভাপতি সংশ্লিষ্ট জোনের পরিচালক। অথচ মোহাম্মদ হোসেন বিসি কমিটির সভা আহ্বান করেন সভাপতি অর্থাৎ জোনের পরিচালক মামুন মিয়ার সঙ্গে কোনো রকমের আলোচনা না করেই। জোন পরিচালকের অনুমতি ছাড়া সভার তারিখ ও নকশা অনুমোদনের প্রসঙ্গে মৌখিকভাবে অথরাইজড অফিসার মোহাম্মদ হোসেনের কাছে কারণ জানতে চাওয়া হলে তিনি ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করেন। মুখের ওপরই জানিয়ে দেন এ ধরণের অনুমতির নাকি প্রয়োজনই নেই! ফলে মামুন মিয়া বাধ্য হয়ে গত ১৫ অক্টোবর এক চিঠির মাধ্যমে মোহাম্মদ হোসনকে লিখেন, আট তলা পর্যন্ত ভবনের নকশা অনুমোদনের জন্য বিসি কমিটির অনুমোদন ও পরবর্তী সভার দিন নির্ধারণের জন্য জোন পরিচালকের অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু তারপরও অথরাইজড অফিসার মোহাম্মদ হোসেন সেই চিঠিকে তোয়াক্কা না করে পরিচালকের অনুমতি ছাড়াই নিজেই ২৩ অক্টোবর পরবর্তী সভার তারিখ নিধারণ করেন।
এছাড়া রাজউকের ইতিপূর্বের এবং সর্বশেষ গত ২ অক্টোবরেরও এক সভার এই মর্মে সিদ্ধান্ত রয়েছে যে, ভবন মালিককে নোটিস প্রদানের পূর্বে পরিচালক জোনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নোটিস প্রদান করতে হবে। ২ অক্টোবরের সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনাটিও মানছিলেন না অথরাইজড অফিসার মোহাম্মদ হোসেন।
এসব কারণে অফিসের শৃংঙ্খলা রক্ষার্থে অথরাইজড অফিসার মোহাম্মদ হোসেনের বিরুদ্ধে রাজউক চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগ দায়ের করেন জোন-৪ এর পরিচালক মোহাম্মদ মামুন মিয়া। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ চাকরি বিধিমালা, ২০১৩ এর ৩৬ (১) খ অনুযায়ী মোহাম্মদ হোসেনের বিরুদ্ধে আচরণ ও শৃঙ্খলা বিরোধী কার্যকলাপের দায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন।
কিন্তু রাজউক প্রশাসন দুর্নীতিবাজ অথরাইজড অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো পরিচালক মো মামুন মিয়াকে গত ৩০ অক্টোরব নারায়ণগঞ্জ বদলী করে। এর মাধ্যমে অন্যায়ের অভিযোগকারীকে শাস্তি দেয়া হলো, অন্যদিকে অফিসের রুল ভঙ্গকারী অথরাইজড অফিসার মোহাম্মদ হোসেনের দুর্নীতি ও অনিয়মকে শুধু প্রশ্রয়ই নয় বরং উৎসাহও দিয়েছে রাজউক প্রশাসন, এমনটাই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
কেন এমনটি ঘটলো- রাজউকের এক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এই অথরাইজড অফিসার মোহাম্মদ হোসেনের এর খুঁটির জোর অনেক শক্ত। রাজউকের ৪ নং জোনেই শুধু নয়, প্রধান কার্যালয়ে অনেক বড় বড় কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে সাহস পান না। কেউ যদি তার বিরুদ্ধে কথা বলে তাহলে তাকে মানসিকভাবে হেনস্থা করা হয়। এমনকি তার সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে সহকর্মীদেরকে ভুয়া দুর্নীতির মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়।
রাজউকের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ আছে। তবে তারা অন্ততঃপক্ষে ‘চেইন অব কমান্ড’ মেনে চলেন। কিন্তু মোহাম্মদ হোসেন শুধু দুর্নীতিই করছেন না, অফিসের শৃঙ্খলাও ভঙ্গ করছেন যা রাজউকের কর্মকর্তাদের মধ্যে চরম ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ১১ নভেম্বর ২০১৯ প্রকাশিত)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন