রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ২১টি রোহিঙ্গা পরিবারের মতামত জানতে চেয়েছেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা।
মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত টেকনাফ উপজেলার শালবাগান ২৬নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসব রোহিঙ্গাদের মতামত (সাক্ষাৎকার) যাচাই-বাছাই করেছেন। এসময় বরাবরের মতো রোহিঙ্গারাও তাদের শর্ত ও দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন।
প্রত্যাবাসনের তালিকায় নাম থাকা টেকনাফ শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা রহিমা খাতুন (৪৫) বলেন, ‘সকালে ইউএনএইচসিআর-এর সদস্যরা আমার বাড়িতে এসেছিল। তারা আমাকে বলেছেন- তালিকায় আমার পরিবারের নাম রয়েছে, আমাদের ‘সিআইসি’ অফিসে যেতে হবে। কিন্তু, আমি তাদের বলেছি, আমি মিয়ানমারে ফিরে যাব না। কারণ আমাদের দেওয়া শর্তগুলো মিয়ানমার সরকার এখনো মেনে নেয়নি।’
তার মেয়ে মল্লিকা বেগম (২০) বলেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইনে আমার খালারা রয়েছেন। তারা আমাদের বার্তা দিয়েছেন সেখানে না যেতে। কারণ, রাখাইনে পরিস্থিতি এখনো শান্ত হয়নি। তাই, আমরা ইউএনএইচসিআর-এর সদস্যদের বলেছি, প্রত্যাবাসনের তালিকা থেকে আমাদের নামটি বাদ দিয়ে দেওয়ার জন্য।’
একই ক্যাম্পের হামিদুর রহমান (৫৫) বলেন, ‘কিসের ভিত্তিতে আমরা মিয়ানমার ফিরব? আমাদের দায়িত্ব কে নেবে? এখন পর্যন্ত রাখাইন শান্ত হয়নি। এছাড়াও আমাদের শর্ত ও দাবিগুলো মিয়ানমার সরকার মেনে নেয়নি।’
তিনি বলেন, ‘রাখাইনে আমাদের লোকজনকে ক্যাম্পে আটকে রেখেছে। মিয়ানমার সরকারের উচিত হবে, আগে তাদের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া। তাহলে আমরা এমনিতেই মিয়ানমারে ফিরে যাব; এর আগে নয়।’
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, ‘আগামী ২২ আগস্ট মিয়ানমারের ছাড়পত্র দেওয়া তালিকা অনুযায়ী ৩ হাজার ৫৪০ রোহিঙ্গার মতামত নেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেছি। কক্সবাজার টেকনাফের শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরে এই সাক্ষাৎকার পর্ব শুরু হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ইউএনএইচসিআর এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে আটটি টিমের সদস্যরা ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে এসব রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎ নিচ্ছেন। এসময় প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তাদের বোঝানো হচ্ছে।’
আবুল কালাম আরও বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের (রোহিঙ্গা) বলেছি, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে রাজি হয়েছে এবং সকল দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে তাদের ফিরে যেতে বলেছে। কিন্তু এই কথাগুলো তাদের বোঝানো মুশকিল হয়ে পড়েছে। আমরা রোহিঙ্গাদের এই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি অব্যাহত রাখব। তারা হয়তো এক সময় বুঝে নিজ উদ্যোগে তাদের দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাবেন। এর আগে তাদেরকে কোনোমতেই জোর করে পাঠানো হবে না।’
গত ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিত অভিযান চালায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
হত্যা-ধর্ষণসহ সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ৭ লাখেরও বেশি মানুষ। এদের সঙ্গে রয়েছেন ১৯৮২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া আরও সাড়ে ৩ লাখ রোহিঙ্গা।
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্ন হয়। একই বছরের ৬ জুন নেপিদোতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মধ্যেও সমঝোতা চুক্তি হয়।
চুক্তি অনুযায়ী গত বছরের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। তবে আবারও হামলার মুখে পড়ার আশঙ্কায় রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরতে অস্বীকৃতি জানানোয় ব্যর্থ হয় ওই উদ্যোগ।
সর্বশেষ চলতি বছরের জুলাই মাসে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে নতুন করে উদ্যোগের অংশ হিসেবে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থোয়ের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দল। ১৫ সদস্যের দলটি দুই দিন ধরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা ও বৈঠক করে। এসব বৈঠকে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব ও চলাফেরায় স্বাধীনতার দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন