সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা কথা বলা আছে। সরকারের অন্যান্য প্রকল্পে নজিরবিহীন সফলতা এসেছে সেই ধারাবাহিকতায় বিদ্যুৎখাতেও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এজন্য মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে সরকার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের জন্য বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তারই একটি ‘ন্যাশনাল পাওয়ার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (১ম সংশোধিত)’।
২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি একনেকের সভায় প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়া হয়। একনেকের সভায় এই প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (পিজিসিবি)-কে। বাংলাদেশ সরকার, জাপানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা ও পিজিসিবি সম্মিলিতভাবে প্রকল্পটির অর্থায়ন করবে।
উক্ত প্রকল্পের নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেয়া ৪ বছর সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করাতো দূরের কথা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পটির প্রায় ২ বার সময় বৃদ্ধি এবং ৯০ কোটি টাকার ব্যয় বাড়ানো হলেও তারপরেও ৭৫% কাজ শেষ করতে না পারায় ৩ বারের মতো সময় বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এতে আরও বড় অংকের অর্থ ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। এই প্রকল্পের কাজ শেষ করতে আরও প্রায় ২ বছর সময়ের প্রয়োজন। এতে জাপানি দাতা সংস্থা জাইকাকেও বাড়তি সুদ হিসাবে গুণতে হবে প্রায় ৩৬ কোটি টাকা।
প্রকল্পের মালামাল কেনার নথিপত্র পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, এই প্রকল্পের প্রতিটি কাজেই অস্বাভাবিক অর্থ ব্যয় ধরা হয়েছে, প্রকল্পটির বরাদ্দ জওবি, পিজিসিবি এবং জাইকার যৌথ অর্থায়নে মোট ব্যয় ২৪২৬ কোটি ৬১ লক্ষ টাকা ধরা হলেও প্রকল্পের জন্য দেশি ও বিদেশী পরামর্শক নিয়োগ বাবদ খরচ ধরা হয়েছে ৩৪ কোটি ২০ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা।
এদিকে অর্ধদাতা জাইকা শুধুমাত্র প্রকল্পটির নির্মাণকালীন সুধ নিয়েছে ১০৪ কোটি ৬০ লক্ষ ৯৮ হাজার টাকা। প্রকল্পের ৬৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর আপ্যায়ন ও যাতায়াত ভাড়া বাবদ খরচ ধরা হয়েছে ৫ কোটি টাকা। এতে জনপ্রতি প্রায় ৭ লক্ষ ৫৭ হাজার ৫৭৫ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। যদিও এটা একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প সেটা সত্ত্বেও এই প্রকল্পেও আসবাবপত্র ক্রয়ে প্রায় ১৬ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।
অন্যদিকে প্রকল্প প্রস্তুতে অফিস সরঞ্জামাদি কেনার খরচ বাবদ ৩৪ লক্ষাধিক টাকার অর্থ ব্যয় দেখানো হয়েছে। শুধু এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নকালে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ৬৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্মানী ভাতা হিসাবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৫ কোটি ৯২ লক্ষ ৪৭ হাজার টাকা। অন্যদিকে এই ৬৬ জনের বেতন বাবদ বরাদ্দ করা হয়েছে ১৪ কোটি ২ লক্ষ ৭ হাজার টাকা।
প্রকল্পটির টাকা লেনদেনে ব্যাংকের চার্জ ধরা হয়েছে প্রায় ২ কোটি ৪৩ লক্ষ ৯ হাজার টাকা। প্রকল্প প্রস্তুতে সরকার কর আরোপ করেছে ৩৬ কোটি ৮৪ লক্ষ ৫৪ হাজার টাকা। প্রকল্পের কর্মকর্তাদের থাকার জন্য বাস ভবন নির্মাণে খরচ করা হয়েছে প্রায় ৬ কোটি টাকার উপরে। প্রকল্পের কার্যসম্পাদনের জন্য ১৫ টি হালকা ও মাঝারি মিনি পিকাপ ক্রয় করা হয়, যার ক্রয় মূল্য ধরা হয়েছে ৫ কোটি ৮২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। হিসাব করে দেখা যায়- প্রতিটি গাড়ি ক্রয়মূল্য প্রায় ৩৯ লক্ষ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য হালকা যন্ত্রপাতির ক্রয় বাবদ বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১৯ কোটি ৪৩ লক্ষ ৮৮ হাজার টাকা।
২২০ কি.মি. বৈদ্যুতিক লাইন নির্মাণে ক্ষতিপূরণ বাবদ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৫ কোটি ৪৪ লক্ষ ৪৭ হাজার টাকা। অপরদিকে ২২০ কি.মি. প্রকল্প এলাকা জরিপ করতেই খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ৪৫ লক্ষ ৪২ হাজার টাকার অধিক। প্রকল্পের উন্নয়নমূলক ফান্ডে জমা রাখার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৬৬ কোটি ১৩ লক্ষাধিক টাকা।
প্রকল্পটির ইআইএ সংকেতিক চিহ্ন দিয়ে এতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা। প্রকল্পে কার্যপরিচালনার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনার জন্য শারীরিক অনিশ্চয়তার বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১৭ কোটি ৬৭ লক্ষ ১৪ হাজার টাকা।
এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নকৃত এলাকাগুলো হলো শিকলবাহা (পটিয়া), আনোয়ারা, হাটহাজারী, খুলশী, রামপুর, আগ্রাবাদ, মিরসরাই, কুমিল্লা, চৌদ্দগ্রাম, লক্ষীপুর রামগঞ্জ, যশোর সদর, শার্শা, শরিয়তপুর সদর, মাদারীপুর সদর, ময়মনসিংহ ভালুকা সদর, বরিশাল সদর, রাজশাহী সদর, বগুড়া মহাস্থানগড়, জলঢাকা, সৈয়দপুর।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে প্রকল্পের রাজস্ব ও মূলধন মোট ১০টি ক্যাটাগরি রেখে প্রকল্পে কার্যপ্রণয়ন করা হয়। এসব প্রকল্পের প্রজেক্টের মধ্যে রয়েছে ৭১ কিলোমিটার ২৩০ কেভি ডাবল সার্কিট সঞ্চালন ওভারহেড লাইন নির্মাণ, ২ কিলোমিটার ২৩০ কেভি ডাবল সার্কিট ভূগর্ভস্থ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ, খুলশী-হালিশহর বিদ্যমান ১৩২ কেভি লাইনের ৪টি ইন-আউট ভূগর্ভস্থ সার্কিট লাইন নির্মাণ, ১৩১ কিলোমিটার ১৩২ কেভি ডাবল সার্কিট লাইন নির্মাণ, ৮ কিলোমিটার ১৩২ কেভি লুপইন লুপআউট লাইন নির্মাণ, ২টি ২৩০/১৩২ কেভি জিআইএস উপকেন্দ্র নির্মাণ, ১টি ১৩২/৩৩ কেভি জিআইএস উপকেন্দ্র নির্মাণ, ১০টি ১৩২/৩৩ কেভি এআইএস উপকেন্দ্র নির্মাণ, বিদ্যমান হাটহাজারী ২৩০/৩৩ কেভি উপকেন্দ্রে ৪টি ২৩০ কেভি জিআইএস বে বর্ধিতকরণ, বিদ্যমান ১৩২/৩৩ কেভি উপকেন্দ্রগুলোতে মোট ৮টি ১৩২কেভি বে বর্ধিতকরণ।
প্রকল্পটির নির্ধারিত এলাকা শরীয়তপুর সদরের বাসিন্দা আবিদ পাটোয়ারি বলেন, ‘আমাদের শরীয়তপুর সদর শতভাগ বিদ্যুৎ সাপ্লাই ছিল অনেক আগে থেকেই কিন্তু একটা সমস্যা ছিল সেটা হলো লোডশেডিং। তাই আমাদের সদরবাসীর বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণের দাবির পরে আমাদের এলাকায় এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। তবে সমস্যা যেটা সেটা হলো- ৪ বছর সময় পার হলেও এখনো তারা কাজ শেষ করতে পারেনি। জানি না এই প্রকল্পের সুফল আমরা কবে পাবো। আর বিদ্যুতের কাজের বিলম্বের কারণে সদরের মানুষের খুব ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।’
প্রকল্পের মালামাল ক্রয়ের ভারসাম্যহীনতার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ওই এলাকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আসলে মালামাল কেনাকাটার বিষয়টি আমরা দেখি না, এটা বড় স্যারেরা হ্যান্ডেল করেন। তাই এই বিষয়ে আমরা তেমন কিছু জানি না। আমাদের যেমন কাজ করতে বলা হয় আমরা সেটাই করি। তবে মালামাল কেনায় কিছু অসঙ্গতি আমাদের চোখেও পড়ে তবে বলার কিছু থাকে না।’
মালামাল ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম কেনাকাটায় বেশি খরচের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে পিজিসির চট্টগ্রামের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী প্রবীর কুমার দাস বলেন, ‘আমি শুধু এই প্রকল্পের একটা অঞ্চলের দায়িত্ব পালন করছি খুলশী-হালিশহর এর এখানে কেনাকাটায় কোন অনিয়ম হয়নি। আর পুরো প্রকল্পে কোন অনিয়ম হলে সেটা আমি জানি না। আসলে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদির দাম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা কম। তাই কেউ এটার বেশি দাম নিয়ে মন্তব্য করতে পারে না। বিদ্যুতের মালামাল বিদেশ থেকে কিনতে হয় তাই এর খরচের পরিমাণটাও একটু বেশি হয়।’
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন