বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের লক্ষ্যে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে ভারতের রিলায়েন্স পাওয়ার। প্রস্তাবনা অনুযায়ী, মোট তিন হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার চারটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কথা প্রতিষ্ঠানটির। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ৭৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চুক্তিও হয় ২০১৭ সালের শেষ দিকে। যদিও রিলায়েন্স পাওয়ারের চলমান আর্থিক সংকটে বাংলাদেশে তাদের এ বিনিয়োগ নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। এরই মধ্যে নিজেদের প্রস্তাবে চার দফায় পরিবর্তন এনেছে রিলায়েন্স।
কয়েক বছর ধরেই ভারতে নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে রিলায়েন্স পাওয়ার লিমিটেড। ভারতের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৬ সালের ৩১ মার্চ সমাপ্ত হিসাব বছরের পর থেকে কোনো লভ্যাংশ পাচ্ছেন না কোম্পানিটির শেয়ারহোল্ডাররা। ৪৪টি সাবসিডিয়ারি ও সহযোগী কোম্পানির সমন্বিত প্রতিবেদনে গত তিন বছরে মুনাফা কিছুটা বাড়াতে সক্ষম হলেও এককভাবে রিলায়েন্স পাওয়ার লিমিটেডের বিক্রি ও মুনাফায় নেমেছে ধস। ২০১৬ হিসাব বছরে সমন্বিত প্রতিবেদনে রিলায়েন্স পাওয়ারের বিক্রি ছিল ১০ হাজার ২৯৮ কোটি ৬৩ লাখ রুপি। ২০১৮ সালের ৩১ মার্চ সমাপ্ত বছরে তা ৯ হাজার ৮৪০ কোটি রুপির নিচে নেমে এসেছে।
এককভাবে রিলায়েন্স পাওয়ার লিমিটেডের পরিচালন মুনাফা ২০১৬ হিসাব বছরের প্রায় দেড় হাজার কোটি রুপি থেকে ২০১৮ হিসাব বছর শেষে নেমে এসেছে ৫০০ কোটি রুপিরও নিচে। অন্যান্য আয় হ্রাস ও সুদ ব্যয় বৃদ্ধির কারণে প্রতিষ্ঠানটির কর-পরবর্তী মুনাফা ১ হাজার ২৯৮ কোটি রুপি থেকে মাত্র ২ কোটি ২৫ লাখ রুপিতে ঠেকেছে। ২০১৬ হিসাব বছরে মূল কোম্পানি শেয়ারপ্রতি ৪ দশমিক ৬৩ রুপি মুনাফা (ইপিএস) করলেও ২০১৮ হিসাব বছরে তা মাত্র দশমিক শূন্য ১ রুপিতে নেমে এসেছে। ২০০৮ সালে ভারতের বোম্বে ও ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে রিলায়েন্স পাওয়ার লিমিটেডের একেকটি শেয়ার ২৫০ রুপির উপরে হাতবদল হলেও বর্তমানে তা ৭-৮ রুপিতে লেনদেন হচ্ছে।
অতিসম্প্রতি ব্যাংক গ্যারান্টি থেকে ৭৩ কোটি ৮৬ লাখ রুপি কেটে রাখা নিয়ে রিলায়েন্স পাওয়ারের একটা দাবি নাকচ করে দিয়েছেন এলাহাবাদ হাইকোর্টের লক্ষৌ বেঞ্চ। মধ্যপ্রদেশের চিত্রাঙ্গীতে প্রস্তাবিত ২ হাজার ৪৫৬ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ ২০১১ সালে ইউপি পাওয়ার করপোরেশন লিমিটেডের (ইউপিপিসিএল) কাছ থেকে বাগিয়ে নেয় রিলায়েন্স পাওয়ার। পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহ ব্যবস্থা বাতিল করলে বিপাকে পড়ে রিলায়েন্স। আদালতে প্রতিষ্ঠানটি দাবি করে, কয়লা সরবরাহ না পাওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
রিলায়েন্সের এমন দুর্দিনে বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিপিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ বণিক বার্তাকে বলেন, দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে রিলায়েন্সের আর্থিক পরিস্থিতির বিষয়টি উঠে এসেছে। তবে রিলায়েন্সের পক্ষ থেকে এখনো এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী তাদের হাতে সময় রয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে চুক্তির শর্ত অনুসরণ করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
ঢাকার অদূরে মেঘনাঘাটে তিন হাজার মেগাওয়াটের কম্বাইন্ড সাইকেল গ্যাস বিদ্যুৎকেন্দ্র ও কুতুবদিয়ায় ৫০০ এমএসসিএফডি সক্ষমতার একটি এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন নিয়ে বিপিডিবির সঙ্গে রিলায়েন্স পাওয়ারের সমঝোতা স্মারক সই হয় ২০১৫ সালের জুনে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় এটি সই হয়। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, প্রতিটি ৭৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কথা রিলায়েন্সের। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী প্রকল্পের ফেজ-১-এর আওতায় প্রাথমিকভাবে একটি ৭৫০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র ও এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করা হবে।
২০১৭ সালের নভেম্বরে এলএনজি টার্মিনালের ব্যবহার নিয়ে পেট্রোবাংলার সঙ্গে চুক্তি সই করে রিলায়েন্স পাওয়ার। এর আগেই মেঘনাঘাটে ৭৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে বিপিডিবির সঙ্গে চুক্তি করে প্রতিষ্ঠানটি।
চুক্তির পর রিলায়েন্স পাওয়ারের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, ফেজ-১-এর আওতায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কাজ ২৪ মাস বা দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন হবে। ২০১৮-১৯ সালে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ওই সময়। তবে এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির অগ্রগতিতে এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি গ্যাস সরবরাহ ও বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) সম্পন্নের জন্য চিঠি দিয়েছে রিলায়েন্স।
প্রকল্পের ফেজ-১ বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১০০ কোটি ডলার। এখন পর্যন্ত এটিই বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ বলে দাবি করেছে রিলায়েন্স পাওয়ার। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) নেতৃত্বাধীন ঋণদাতাদের একটি কনসোর্টিয়ামের কাছ থেকে অর্থায়ন অনুমোদনসাপেক্ষে প্রকল্পটিতে বিনিয়োগ করছে রিলায়েন্স পাওয়ার। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য তহবিল সংগ্রহ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে ভারতীয় রিলায়েন্স পাওয়ার লিমিটেডের জন্য ঋণ ও আংশিক গ্যারান্টার হয়েছে এডিবি। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে সংস্থাটির বোর্ডসভায় এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবের অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্পে রিলায়েন্সের ৫৮ কোটি ৩০ লাখ ডলারের ঋণ ও গ্যারান্টার হিসেবে কাজ করবে এডিবি।
মেঘনাঘাটে রিলায়েন্সের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপন করা হবে বিপিডিবির দেয়া জমিতে। এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের সমতলকোটে পরিকল্পিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কেনা যন্ত্রপাতি পুনঃস্থাপন করবে প্রতিষ্ঠানটি। রিলায়েন্সের পরিচালনাধীন স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় ব্যাপক হারে উৎপাদন হ্রাসের কারণে পরিকল্পনা হাতে নিয়েও সমতলকোটের ২ হাজার ২৫০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু করা যায়নি।
ভারতের মুম্বাইভিত্তিক রিলায়েন্স অনিল ধীরুভাই আম্বানি (এডিএ) গ্রুপের অধীন চারটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির অন্যতম রিলায়েন্স পাওয়ার লিমিটেড। কয়লা, গ্যাস, জল ও নবায়নযোগ্য—সব ধরনের উৎস থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে প্রতিষ্ঠানটি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ছাড়াও টেলিযোগাযোগ, বিনিয়োগ, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, এভিয়েশন, বিনোদন ও পরিবহন খাতে ব্যবসা রয়েছে রিলায়েন্সের।
উল্লেখ্য, ২০০২ সালে পিতা ধীরুভাই আম্বানির মৃত্যুর পর পারিবারিক ব্যবসা নিয়ে দুই ভাই মুকেশ ও অনিল আম্বানির মধ্যে মনোমালিন্য হয়। সাত মাসের তিক্ত বিবাদের পর ২০০৫ সালে রিলায়েন্স সাম্রাজ্য দুই ভাইয়ের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদের ব্যবসা নিয়ে অতীতে আইনি লড়াইও চলেছে দুই ভাইয়ের মধ্যে। তবে সম্প্রতি বড় ভাই ও ভারতের শীর্ষ ধনী মুকেশ আম্বানির আর্থিক সহায়তায় কারাগারে যাওয়া এড়িয়েছেন ছোট ভাই অনিল আম্বানি। সুইডিশ টেলিকম জায়ান্ট এরিকসনের সঙ্গে রিলায়েন্স কমিউনিকেশনস লিমিটেডের (আরকম) একটি চুক্তি বাতিল হওয়ার পর এরিকসনের প্রাপ্য অর্থ পরিশোধে গড়িমসির কারণে কারাদণ্ডের হুমকিতে পড়েন অনিল আম্বানি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন