লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলায় আগুনে দগ্ধ হয়ে তরুণী শাহিনুর আক্তারের মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে দাবি করেছে পুলিশ। আজ সোমবার (২২ এপ্রিল) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শাহিনুর মারা যান। যদিও,শাহিনুর চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছিলেন,‘স্ত্রীর স্বীকৃতি চাওয়ায় তার গায়ে কেরোসিন দিয়ে আগুন দেয় সালাহউদ্দিন নামে এক ব্যক্তি।
এছাড়াও,ফেনী সদর হাসপাতালে চিকিৎসকরা যে বক্তব্য রেকর্ড করেছেন সেখানেও শাহিনুর তার গায়ে আগুন দেওয়ার কথা বলেছেন। নিহত শাহিনুরের ভাইও অভিযোগ করেছেন, ‘শাহিনুরের গায়ে আগুন দেওয়া হয়েছে।’ তবে শাহীনুরের অভিযোগের সঙ্গে কমলনগর থানা পুলিশের বক্তব্য মিলছে না। তদন্তের আগেই পুলিশ এই ঘটনাকে ‘আত্মহত্যা’ বলে দাবি করেছে।সোমবার (২২ এপ্রিল) বিকালে পুলিশ, কমলনগরের জনপ্রতিনিধি ও নিহত শাহিনুরের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে।
আজ সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় শাহিনুরের। এসময় হাসপাতালে তার সঙ্গে তার স্বজনরা কেউ ছিলেন না। তবে কমলনগর থানার দুজন পুলিশ কর্মকর্তা তাকে নিয়ে এসেছেন। মরদেহটি ঢামেক হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। মরদেহ গ্রহণ করার জন্য শাহিনুরের বাবাকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছে পুলিশ।
কমলনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকবাল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি ঘটনার সময় এলাকাতে ছিলাম না। প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, শাহিনুর নিজেই অভিমান করে তার গায়ে আগুন দিয়েছে। এরপর স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে কমলনগর এরপর লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসা হয়।’
ওসি আরও বলেন,‘‘শাহিনুরের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামে রাউজানে। তিনি চট্টগ্রামের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। সেখানে কমলনগরের সালাহউদ্দিনের সঙ্গে পরিচয় হয় শাহিনুরের। সালাহউদ্দিন চট্টগ্রামে মাঝে মাঝে রিকশা চালাতে যেতেন। তারা মোবাইল ফোনেও কথা বলতেন। ১৫/২০ দিন আগে শাহিনুর তার মোবাইল থেকে সালাহউদ্দিনের মোবাইলে ফোন দিলে কল ধরেন সালাহউদ্দিনের বাড়িতে থাকা স্ত্রী। শাহিনুর তার কাছে নিজেকে সালাহউদ্দিনের স্ত্রী বলে দাবি করলে ওই মহিলা নিজেকে সালাহউদ্দিনের দুই সন্তানের জননী হিসেবে পরিচয় দেন। এরপর তার কাছে সালাহউদ্দিনের বাড়ির ঠিকানা নেন শাহনুর।’
ওসি জানান,‘এর কয়েকদিন পর শাহনুর কমলনগরে এসে সালাহউদ্দিনের দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন তা বুঝতে পারেন। ওই সময় গ্রামের মেম্বর, চেয়ারম্যান ও স্থানীয়রা শাহিনুরকে বুঝিয়ে ফের চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেন।’
ওসি আরও বলেন, ‘১৫/২০ আগে চট্টগ্রাম ফিরে গিয়ে পরশুদিন শাহিনুর ফের চট্টগ্রাম থেকে কমলনগরে সালাহউদ্দিনের বাড়িতে এসে তার স্ত্রী পরিচয়ে ঘরে উঠতে চান। এসময় স্থানীয় একজন মেম্বর এসে তার কাছে জানতে চান,‘কোথায় বিয়ে হয়েছে?’ তখন শাহিনুর তাকে জানান, ‘আদালতে তাদের বিয়ে হয়েছে।’ বিয়ের কাগজপত্র দেখাতে বললে শাহনুর জানান, ‘বিয়ের কাগজপত্র চট্টগ্রামে।’ মেম্বর শাহিনুরকে চট্টগ্রামে ফিরে যাওয়ার জন্য ৫০০ টাকা গাড়িভাড়া দেন। তবে রাত হয়ে যাওয়ায় তাকে সালাহউদ্দিনের বাড়ির পাশে একটি বাড়িতে রেখে দেন। সকালে তিনি চট্টগ্রামে যাবেন এমন কথা ছিল। কিন্তু সকালে শাহিনুর চট্টগ্রামের গাড়িতে না উঠে কমলনগরে বাজারে গিয়ে কেরোসিন নিয়ে আসেন। এরপর সালাহউদ্দিনের বাড়ির অদূরে একটি সয়াবিন ক্ষেতের মধ্যে নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনের যন্ত্রণা সহ্য না করতে পেরে তিনি দৌড়ে পাশের বাড়ির একটি গরুর চাড়ির ভেতরে ঝাঁপ দেন। তখন স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এলাকার মেম্বর পুলিশকে ফোন দিলে ঘটনাস্থলে পুলিশ যায়।’
ওসি ইকবাল হোসেন বলেন, ‘প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। সবাই বলেছে, তরুণী নিজেই নিজের গায়ে আগুন দিয়েছে। তারপরও তরুণীর পরিবার যেভাবে চাইবে সেভাবে মামলা হবে। আমরা ঘটনার পর তরুণীর ব্যাগ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করি। তার ঠিকানা নিশ্চিত হয়েছি। ঘটনার প্রথমদিকে ওই তরুণী কথাও বলেছিলেন। তিনি তার বাবার মোবাইল নম্বর দিলে তাকে ফোন দিয়ে কমলনগরে আসতে বলি। কিন্তু তিনি প্রথমে আসতে চাননি। মেয়ের সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই বলে ঘটনা এড়িয়ে যেতে চান।এরপর তিনি জানান,তার কাছে টাকা নেই। পরে পুলিশ গাড়ি নিয়ে তাকে চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে আসেন। তিনি লাশ নিতে পুলিশের সঙ্গে ঢাকায় আসেন।’
শাহিনুর চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াজিশপুর ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডের সোনাগাজী চৌধুরী বাড়ির জাফর আহমেদের মেয়ে। শাহিনুরের মা মারা গেছেন। তার বাবা দুই বিয়ে করেন। শাহিনুর জাফরের প্রথম স্ত্রীর মেয়ে। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে শাহিনুর ছিল মেঝ। তার বড়বোনের নাম সোনিয়া আক্তার। ছোটভাই জাবেদ।
সোনিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার বিয়ে হয়েছে। আমি আমার স্বামীর সংসার করি। শাহীনুর আমার ফুফুর সঙ্গে ছিল। তবে কয়েকমাস আগে সে আলাদা বাসা নিয়ে চট্টগ্রামের হামজাবাদ থাকতো। আমি জানতাম সালাহউদ্দিনের সঙ্গে শাহিনুরের বিয়ে হয়েছে। তারা একই বাসায় থাকতো। আমি সালাহউদ্দিনের সঙ্গে ফোনে কথাও বলেছি। তবে সালাহউদ্দিনের আগের বউ আছে তা আমরা জানতাম না। শাহীনুর লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে সালাহউদ্দিনের খোঁজে গেছে তাও আমরা জানতাম না। পুলিশ ঘটনা বলার পর আমরা জানতে পেরেছি। এরপর আমি হামজাবাদ এলাকায় শাহীনুরের বাসায় গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে শুনতে পেলাম কয়েক মাস আগে শাহীনুর অন্তঃস্বত্ত্বা হয়েছিল। সালাহউদ্দিন ওষুধ খাইয়ে বাচ্চা নষ্ট করেছে। বাসার আশেপাশের সবাই বললো সালাহউদ্দিন আর শাহীনুর বিয়ে করে একসাথেই ছিল।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে শাহীনুর এসবের কিছুই বলেনি। তবে আমরা শুনতে পেরেছি সে বিয়ে করেছে। আজকে শুনলাম সালাহউদ্দিন তাকে গায়ে আগুন দিয়ে হত্যা করেছে।’
এদিকে শাহীনুরের বাবার দ্বিতীয় সংসারে তিন ছেলে রয়েছে। তারাও এই ঘটনা সম্পর্কে কিছু জানে না। শাহীনুরের সৎভাই নূর উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা শুনেছি শাহীনুর আপাকে গায়ে আগুন দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। বিকালে কমলনগর থানা পুলিশ এসে বাবাকে নিয়ে গেছেন। তিনি লাশ নিয়ে আসবেন।’
রাউজান উপজেলার চেয়ারম্যান লায়ন এম সোহরাওয়ার্দী সিকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শাহিনুর চট্টগ্রামে শহরে যাওয়ার পর তেমন একটা বাড়িতে আসতো না। বাড়ির লোকজনের সঙ্গে তার যোগাযোগও কম ছিল। তারা বাবা জাফর আহম্মেদ একজন শ্রমিক। বর্তমানে তিনি বাবুর্চির সহকারী হিসেবে কাজ করছেন।’
দগ্ধ শাহীনুর চিকিৎসাধীন অবস্থায় লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে বসে চিকিৎসক ও সাংবাদিকদের কাছে যে জবানবন্দি দিয়েছেন তাতে দুই ধরনের বক্তব্য রয়েছে। একবার তিনি বলেছেন, ‘তাকে সালাহউদ্দিন গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়। আরেকবার শাহীনুর দাবি করেছেন, তিনি নিজেই গায়ে আগুন দিয়েছেন।’
লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের পাটারিরহাট এলাকার মোহর আলীর ছেলে রিকশাচালক সালাহউদ্দিন ঘটনার পর থেকে পলাতক। তবে পুলিশ সালাহউদ্দিনের আপন দুই ভাই আব্দুর রহমান বিশ্বাস ও আলাউদ্দিন, কমলনগরের চরফলকন ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড মেম্বার মো. হাফিজ উদ্দিন ও গ্রাম পুলিশ আবু তাহেরসহ পাঁচজনকে আটক করেছে। তারা বিষয়টি পুলিশকে না জানিয়ে মীমাংসার চেষ্টা করেছিল।
এদিকে, ওই তরুণীর মৃত্যুর পর তার লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন ডিএমপির শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মশিউর রহমান। সুরতহাল প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘শাহীনুর তার গায়ে নিজে নিজেই কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়েছে।’
সুরতহাল প্রতিবেদনের এই তথ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই মশিউর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাকে কমলনগর থানার ওসি বলেছেন, শাহীনুর নিজেই নিজের গায়ে আগুন দিয়েছে। তাই আমি সুরতহালে বিষয়টি উল্লেখ করেছি।’
তবে আত্মহত্যার বিষয়টি বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না শাহীনুরের পরিবার। তার বোন দাবি করেছেন, ‘তাকে হত্যা করা হয়েছে।’
প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় সলিম উদ্দিন নামে একজন ব্যক্তিও অভিযোগ করেছেন, শাহীনুরের শরীরে সালাহউদ্দিনই আগুন দিয়েছেন।
কমলনগর থানার ওসি ইকবাল হোসেন বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে থেকে যে তথ্য পেয়েছি, তাতে আত্মহত্যা মনে হয়েছে। তবে আমরা শাহীনুরের পরিবার যে অভিযোগ দেবে আমরা তা নেবো। আমরা সালাহউদ্দিনকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছি।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন