মো. এবাদত আলী খান। গ্রামের বাড়ি পাবনার আটঘরিয়ার চাদড়া কুষ্টিয়াপাড়ায়। ৬৬ বছর বয়সী এই বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটি পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে রাজধানীতে এসে রিকশার প্যাডেল মারছেন। ৪৯ বছর আগে স্বাধীনতা যুদ্ধে এবাদত আলী প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ না করলেও মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন ধরনের সহায়তা করেছিলেন। কিন্তু আজ নিজে বড় অসহায়, পাচ্ছে না কোনো ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের সহায়তা। মুক্তিযুদ্ধ, নিজের জীবন সংগ্রাম, পাকিস্তান-বাংলাদশে আমলসহ বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলছেন এবাদত আলী। রাজধানীর মতিঝিলের লেগুনা স্ট্যান্ডের পাশেই পাবনার ও ঢাকার আঞ্চলিকভাষাই ব্রেকিংনিউজের প্রতিবেদক মাইদুল ইসলামের সাথে কথা বলেন তিনি।
ব্রেকিংনিউজ: মুক্তিযু্দ্ধের কোনো স্মৃতি মনে পড়ে কিনা?
এবাদত আলী: যুদ্ধের সময় আমার বয়স ১৫-১৬ বছর হবে। একটা স্মৃতি এখনো মনে গাথি আছে। যেদিন কেহ আমাদের এলাকায় আগুন দ্যালো। এলাকাটা হলো পাবনার আটঘরিয়া থানার গৌরি গ্রাম। যেদিন গ্রামে আগুন দ্যায়। গ্রামটা ছিল হিন্দু প্রধান। পাড়ায় একটা বিরাট বিল ছিল। সে সময়ে আমার চালের দোকান চিল। ক্যাবলি বাজারের ওপর যাইয়ি চাউল এক বস্তা ঢালছি। এর মইধ্যে খবর আইসলো পাকিস্তানি আর্মি চারদিকে ঘিরে ফেলেছে। আমার ঘরে তখন ছিল ১০-১১ হাজার টাকা। মনে মনে চিন্তা করলাম ঘিরে লইক, পোড়া দিলে দেইক। দৌড়াইয়া বাড়িত যাইয়ি, ট্যাকা কয়টা লিয়া খালি কোমরে গুজ দিয়ে বিলে দিকে রহনা দিচি। সামনে যায়া দেখি আর্মিরা গুই সাপের মতো সুয়ে আছে। আর সামনে যারা পাইতেছে ধাম ধুম গুলি ছুড়ছে। বিপদ দ্যাখি উল্ঠা পাশে মারি দৌঁড়। পরে সাতরাইয়ে বিল পার হয়া এক আত্মীয় খালার বাড়িত আশ্রয় নেই। কদিন পরে গ্রামে আসি দেখি বাড়ি ঘর পুড়ে দেছে, লুট করেছে।
ব্রেকিংনিউজ: মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন?
এবাদত আলী: যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিতে পারিনি। আমার চাচাতো ভাই ছিল কমান্ডার, ওর নাম জহুরুল ইসলাম। সে কোনভাবেই ভারতে যাইবা দিল না। সে বলেছিলো- এই বয়সে মুক্তিবাহিনীতে নাম দেয়ার দরকার নাই। আমাদেরই কি হয় না হয় ঠিক নাই। তুই আমাদের সাথেই থাক পিছে পিছে।
ব্রেকিংনিউজ: মুক্তিবাহিনীকে কোন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করতে পেরেছিলেন?
এবাদত আলী: সহযোগিতা করা মানে কি তাদের সাথে সবসময় পাছ পাছ থাকতাম। যখন কোন কিছু দরকার হতো তাদের দিতাম আগাইয়া। যেখানে যাইত তারা সাথে সাথে যাইতাম। যেখানে যাইতাম আমরা সবাই সহযোগিতা করতে খাই-দাই করাতো।
ব্রেকিংনিউজ: পাকিস্তান আমল দেখেছেন বাংলাদেশও দেখলেন- কোন আমল ভালো মনে হচ্ছে?
এবাদত আলী: বাস্তবে একটা কথা কি। ধরেন আগের চাইতে এখন পয়সার দাম কমেছে। জিনিসের দাম বেড়েছে। বড়লোক ও মধ্যম শ্রেণির কোন সমস্যা হচ্ছে না। আগের চেয়ে এখন ক্ষেত খামার ফসল বেশি হচ্ছে। যাদের জমি আছে তাদের সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু যাদের না আছে নিজের সম্পত্তি না পারছে প্যাইট (কামলা) দিতে, তাদের সমস্যা হচ্ছে।
‘পাকিস্তানে আমলের থেকে গরীব মানুষ এখন ভাল আছে। ওই সময় দিনকাল চলা খুব কষ্ট ছিল। ওই সময় দ্যাখিছি আট আনা, বার আনা, একটাকা পাইতো। এক টাকা কামাই করে দেখা যেত ৩ কেজি চাল পাওয়া যেত। কিন্তু এখন দেখা যায় একটা লোকের হাজিরা মিনিমাম ৩০০-৪০০ ট্যাকা। এই ট্যাকা দিয়ে ৬-৭ কেজি চাউল কিনতে পারছি। তখনকার চাইতে এখন একটু উন্নত আছে।’
‘দুইটা মেয়েকে ম্যাট্রিক পাস করে বিয়ে দিছি, আর একটা মেয়ে ক্লাস নাইনে পড়ে। ছেলেটা তো বিএ অনার্স ফাস্ট ডিভিশনে পাশ করার কিছু দিন পর অ্যাকসিডেন্টে মারা গেল। দ্যাশ স্বাধীন হওয়ায় ছেলে-মেয়েদের পড়াইতে পারছি। বই কিনতে হচ্ছে না এখন। উপবৃত্তি দিচ্ছে সরকার।’
ব্রেকিংনিউজ: এই বয়সে এসেও রিকশা চালাতে হচ্ছে?
এবাদত আলী: আমার এক ছেলে তিন মেয়ে। ছেলেটা বিএ অনার্স রেজাল্ট বার হওয়ার তিন মাস পর এক্সিডেন্টে মারা যায়। ছেলেটা মারা যাওয়ার পর নিরুপায় হয়ে যাই। তাই মাঝে মাঝেই ঢাকায় আসি কয়েকদিন থেকে রিকশা চালিয়ে কিছু টাকা রোজগার করার পর আবার দ্যাশে চলে যাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকেই আমার মতো মুক্তিবাহিনীর সাথে পিচ পিচ বেড়াইতো। তারা কেমন কেমন করে যে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট পাইয়া নিছে। অনেকই আমার চেয়ে ছোট, আমার মত ঘুরেও নাই কিন্তু সার্টিফিকেট পাইছে। এখন তারা ভালই আছে। কিন্তু আমি তো পাইনা। তাই আজ ৬৬ বছর বয়সে আইসাও রিকশা প্যাডেল মারতে হচ্ছে।’
ব্রেকিংনিউজ: তাহলে কি বাকি জীবনটা নিয়ে কি খুবই শঙ্কায় রয়েছেন?
এবাদত আলী: আমাকে সহযোগিতা করার মতো কেউ নেই। ধরেন যদি এক সের (কেজি) লবণও কিনতে হয় তাও নিজের পরিশ্রমের টাকায়। ছেলেটা মারা না গেলে হয়ত আমাকে এই বৃদ্ধ বয়সে এসব করতে হত না। আমার চার বিঘা জমি ছিল। ছেলের চিকিৎসার খরচ, মেয়ের বিয়ে দিতে সব শেষ। এখন শুধু বাড়ি ভিটাটা আছে। আমি আজ যা করতেছি তা আমার পরিবার গোষ্ঠির মধ্যে নাই। করতেছি বড় দুঃখে। বাড়ি ছাড়া আমার কোনো সম্পদও নাই। যখন কোনো নিরূপাই, তখন এইসব করতে হচ্ছে। এখন ভবিষ্যতে আল্লাহ কি করবে না করবে সেই সেই জানে।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন