২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়েছিল ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন। প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধও সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল।
১৯৭১ সালের সেইদিন দুপুর থেকেই পুলিশ কর্মকর্তারা আঁচ করতে থাকেন যে, রাজারাবাগ পুলিশ লাইন্সে হামলা হবে। সেই আশঙ্কা সত্যি হয় রাত সোয়া ১১টার দিকে, যখন পাক সেনাবাহিনীর সাজোয়া যানগুলো রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের চারদিকে অবস্থান নিতে থাকে। পাক বাহিনীর এই আক্রমণের খবর তাৎক্ষণিকভাবে সারা দেশের জেলা ও সাব ডিভিশনসমূহে পুলিশ বেতার মারফত পাঠিয়ে দেয়া হয়।
হামলার খবরটি সেদিন প্রথম বার্তা আকারে সারা দেশের পুলিশ লাইন্সগুলোতে পাঠিয়েছিলেন বেতার অপারেটর শাহজাহান মিয়া। শাহজাহান যে বার্তাটি পাঠিয়েছিলেন সেটি হলো, ‘দ্য বেস ফর অল স্টেশন ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, কিপ লিচেনিং, ওয়াচ, উই আর অলরেডি অ্যাটাক্ড বাই দ্য পাক আর্মি, ট্রাই টু সেভ ইয়োরসেলফ।’ তার এই বার্তার কারণে সবাই সতর্ক হয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলেছিলেন।
তখনকার টগবগে যুবক সেই শাহজাহান মিয়া এখন বৃদ্ধ। তার বর্তমান বয়স ৭৫ বছর। থাকেন নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার বাট্টা গ্রামের বাড়িতে। দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও সেই দিনের ভয়াবহ স্মৃতি ভুলতে পারেননি তিনি। এখনও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় সহযোদ্ধাদের পড়ে থাকা লাশ, পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধের দৃশ্য।
দিনটির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শাহজাহান মিয়া পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, রাজারবাগে পাকিস্তানি আর্মিরা হামলা করতে এলেও, সেদিন প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন বাঙালি পুলিশ সদস্যরা। তাদের প্রথম বুলেটেই মারা গিয়েছিল দুই পাকিস্তানি সেনা। তারপর শুরু হয় তুমুল প্রতিরোধ যুদ্ধ। যখনই সবাই প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুললেন তখন আমি সর্বপ্রথম ওয়্যারলেসে বার্তা দেই যে, Base for all station of East Pakistan Police, keep listening, watch, we are already attacked by the Pak Army, try to save yourself, over. পুলিশের সে সময়কার ৩২টি সাব-ডিভিশন ও ১৯ জেলায় একযোগে গিয়েছিল এই বার্তা।
তিনি বলেন, সেদিন রাত ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে প্রথম হামলার পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। রাত ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত চলে তুমুল যুদ্ধ। কিছুতেই পাকিস্তানি আর্মিরা রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ঢুকতে পারছিল না। পাকিস্তানি আর্মিরা গাড়ি নিয়ে প্রথমে বেইলি রোড দিয়ে প্রবেশ করে শান্তিনগর হয়ে চামেলীবাগের দিকে আসছিল। তখন ডন হাইস্কুলের (বর্তমান ইস্টার্নপ্লাস মার্কেট) সামনে পুলিশ ও সাধারণ জনতা প্রতিরোধ গড়ার লক্ষে তারা রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়, যাতে রাজারবাগে তারা সহজে প্রবেশ করে হামলা না করতে পারে।
পাকিস্তানি সেনারা গাড়ি থেকে নেমে ব্যারিকেডগুলো ভাঙার চেষ্টা করলে রাইফেল দিয়ে সেখানেই দু’জনকে গুলিতে ফেলে দেন পুলিশের সদস্যরা। বেশ কয়েকজন আহতও হন। এটাই রাজারবাগ থেকে প্রতিরোধকারী বাঙালি পুলিশ সদস্যদের পক্ষ থেকে ছিল প্রথম বুলেট। প্রথম প্রতিরোধের পরই পুলিশ লাইন্সে থাকা বিভিন্ন ব্যারাকের সদস্যরা প্রতিরোধ যুদ্ধে নেমে পড়েন। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা বাঙালি পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে টিকতে না পেরে রাজারবাগে প্রবেশ করেই প্রথমে টিনশেডের ব্যারাকগুলোতে গানপাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া ট্যাংকের মাধ্যমে দুটি গেট গুঁড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা ভেতরে প্রবেশ করে এবং দেড় শতাধিক পুলিশ সদস্যকে হত্যার দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে।
পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধের আরেক যোদ্ধা কনস্টেবল আব্দুল আলী। তিনি তৎকালীন আইজিপি তসলিমউদ্দিন সাহেবের বডিগার্ড ছিলেন। রোববার ভয়াল ২৫ মার্চের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, হামলার কিছু সময় আগে আমি একা দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন একজন মোটরসাইকেল আরোহী রাজারবাগ ১ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে এই জরুরি বার্তা দিয়ে যান যে রাজারবাগে পাকিস্তানি সেনারা রাতে আক্রমণ করবে। সেই বার্তাটি সবার কাছে পৌঁছে দিতে আমি ৬ নম্বর ব্যারাকের দিকে ছুটে যাই। উত্তেজনায় আমার শরীর কেঁপে উঠছিল। কিন্তু, কিভাবে কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তখন অস্ত্রাগারের সামনে ঝোলানো পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে পুলিশ সদস্যদের সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করি। সকলকে বার্তাটা দেয়ার পর সবাই অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে প্রস্তুতি নেন। এর কিছুক্ষণ পরই শুরু হয় হামলা। প্রাথমিক প্রস্তুতি থাকায় প্রতিরোধ গড়া সহজ হয় তখন।
প্রথম প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়া সেই বেতার যন্ত্রটি এবং সেই পাগলা ঘণ্টা এখনও সংরক্ষিত আছে রাজারবাগ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। এছাড়া এখানে সংরক্ষিত আছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা, মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত রাইফেল, মর্টারশেলের আঘাতের চিহ্ন এবং মর্টারশেলের অংশবিশেষ, শহীদ কনস্টেবল আব্দুস সালাম এবং জাহাঙ্গীরের সমাধি ফলক, আইজিপি আবদুল খালেকের ভাষণের কপি, সরকারের গার্ড অব অনার প্রদান, পাটগ্রাম থানা পরিদর্শন মন্তব্য, খেতাবপ্রাপ্ত পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, ২৫ মার্চ প্রতিরোধ যুদ্ধে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ব্যবহৃত রাবার শেল, পুলিশ বাহিনীর মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত সার্চ লাইট ইত্যাদি।
২৫ মার্চের প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ অজ্ঞাত পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত সামগ্রীও রয়েছে এখানে। এছাড়া রয়েছে শহীদ ইন্সপেক্টর গোলাম রাব্বানীর পোশাক, মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ শহীদ সদস্যদের ব্যবহৃত বেতের তৈরি ঢাল, চশমা, মানিব্যাগ, ইউনিফর্ম, বেল্ট, টাই, স্টিক, পরিচয়পত্র, কলম, মেডেল, বাঁশি, মাফলার, জায়নামায, খাবারের প্লেট, পানির মগ, পানির গ্লাস, শার্ট, প্যান্ট, র্যাংকব্যাজসহ টিউনিক সেট, ক্যামেরা, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, লোহার হেলমেট, হ্যান্ড মাইক, রক্তভেজা প্যান্ট-শার্ট, দেয়ালঘড়ি, এমএম রাইফেল, সার্চ লাইট, রায়ট রাবার শেল, রিভলবার, এলএমজি, মেশিনগান, এমএম এলএমজি, বোর রিভলবার, বোর শটগান, এমএম এসএমজি, স্বাধীন বাংলার প্রথম আইজিপির ব্যবহৃত চেয়ার, মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ আলোকচিত্র এবং মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর স্মৃতিবিজড়িত তথ্য।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন