সোহান মাহমুদ ওরফে শুভ মৃধা নামে এক ব্যক্তিকে আটক করেছিল পুলিশ, যার নেশা শুধু বিয়ে করা। নিজের বাবাকে সাবেক সেনা কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে পর পর তিনটি বিয়ে করেন তিনি। এ ছাড়া ভুয়া শিক্ষা সনদ দেখিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিও করেছেন এই ব্যক্তি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সোহান মাহমুদ এখনো মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হতে পারেননি। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা এবং ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্স (ইউআইটিএস) থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে বিএসসি পাসের জাল সনদ দেখিয়ে দিনের পর দিন চাকরি করেছেন।
এই চাকরির সুবাদে পর পর তিনটি বিয়ে করেন শুভ। তবে আটক হন তৃতীয় বিয়ে করার পর দিন। নাটোরের সিংড়া উপজেলার বাকুন্দা গ্রামের বাসিন্দা নিজেকে প্রকৌশলীর পরিচয় দিয়ে বিয়ে করতে যান রাজশাহীর লক্ষীপুর এলাকার এক মেডিকেল ছাত্রীকে। গত ফেব্রুয়ারিতে মহা ধুমধামে তিনি ওই ছাত্রীকে বিয়ে করেন। এ ঘটনা জানার পর শুভর দ্বিতীয় স্ত্রী সন্তানসহ ঢাকা থেকে ছুটে যান রাজশাহীতে। এর পরই সামনে আসে শুভর আসল পরিচয়।
এই বিয়েসহ প্রত্যেকটি বিয়েতে শুভ নিজেকে প্রকৌশলী হিসেবে পরিচয় দেন। আর তার বাবা আবদুল মজিদ মৃধাকে পরিচয় দিতেন একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল হিসেবে। যদিও তিনি একজন বর্গাচাষী।
শুভর গ্রামের স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাবার অভাবের সংসারের কারণে পড়ালেখা ছেড়ে সিংড়া উপজেলা সদরে মুঠোফোন রিচার্জের ব্যবসা করতে শুরু করেন শুভ। কয়েকদিন এলাকার বিভিন্ন ধনী ব্যক্তির গাড়ির চালক হিসেবেও কাজ করেন। এর পরপরই রাতারাতি তিনি হয়ে ওঠেন প্রকৌশলী! এলাকাবাসীর কাছে তিনি জানান, ব্যবসা ও গাড়ি চালানোর সময় পড়ালেখা চালিয়েছেন তিনি। তবে তার ঘনিষ্টজনরা জানিয়েছেন, শিক্ষা সনদ জাল করেই নিজেকে প্রকৌশলী হিসেবে তুলে ধরছেন সকলের কাছে।
এই জাল সনদ দিয়ে তিনি চাকরি করেছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। এ ছাড়া নিজেকে একজন প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচয়ও দেন শুভ। তার ভোটার কার্ডে শিক্ষাগত যোগ্যতা দেওয়া আছে মাধ্যমিক। কিন্তু তার কাছে থাকা সনদে দেখা যায়, রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা এবং ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্স (ইউআইটিএস) থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে বিএসসি পাস করেছেন তিনি।
শুভর এসব সনদ যে জাল, তার নিশ্চিত হওয়া গেছে শিক্ষাবোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে। মাধ্যমিক ২০০৪, উচ্চমাধ্যমিক ২০০৮ এবং ২০১৩ সালের আগস্টে তার ইউআইটিএসের সনদ ইস্যু করা হয়। তবে শিক্ষাবোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষে জানিয়েছে, তাদের আর্কাইভে শুভর দেওয়া তথ্যের কোনো সংরক্ষণই নেই।
বিষয়টি নিশ্চিত করে রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক আনোয়ারুল হক প্রামানিক বলেন, ‘অনলাইন আর্কাইভে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ফলাফল দেওয়া আছে। সেখানে ফলাফল না পাওয়া গেলে বুঝতে হবে সনদপত্রটি জাল।’
শুভর রোল নম্বর জাল উল্লেখ করে ইউআইটিএআইয়ের সিনিয়র সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জেসমিন সুলতানা বলেন, ‘নিঃসন্দেহে সনদটি জাল। কারণ এই রোল ও নামের কোনো শিক্ষার্থী কখনই তাদের প্রতিষ্ঠানে ছিলেন না।’
২০০৯ সালে সিংড়া পৌরসভার মাদারীপুর মহল্লায় এক ভ্যানচালকের মেয়েকে প্রথম বিয়ে করেছিলেন শুভ। শ্বশুরবাড়ি যাতায়াতের সময় এক ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রীকে চোখে পড়ে তার। ২০১৪ সালে ওই ছাত্রীর মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে কথাবার্তা শুরু করেন তিনি। পরে তাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে একই বছরের ১২ নভেম্বর আদালতে নিয়ে বিয়ে করেন তিনি। যদিও প্রথম স্ত্রীর কথা তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে লুকোননি। কিন্তু জানিয়েছেন, প্রথম স্ত্রীকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তালাক দিয়ে চলে যান। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুভ তার প্রথম স্ত্রীকে তালাক দেননি, বরং তাদের পাঁচ বছরের একটা সন্তান রয়েছে।
শুভর দ্বিতীয় স্ত্রী আমাদের সময়কে জানান, সংসার শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই অন্তঃসত্ত্বা হন তিনি। এখন তাদের একটা ছেলে সন্তান রয়েছে। কিন্তু বিয়ের কয়েক মাসের মাথায় তিনি বুঝতে পারেন শুভ তাকে মিথ্য বলেছেন। প্রতারণার বিষয়টি তিনি বুঝতে পারে, যখন তার স্বামীর শিক্ষা সনদগুলো হাতে পান। এ ছাড়া অনেক মেয়ের সঙ্গে শুভর সম্পর্ক আছে বলেও জানান তিনি।
ওই নারী আরও জানান, গত বছর শুভ ঢাকায় একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। সেখানে তার বেতন হয় ৫০ হাজার টাকা। তিনি স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় বসবাস করতে শুরু করেন। গত বছরের নভেম্বরে শুভ সেই চাকরি ছেড়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের একটি প্রকল্পে প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। এরপর শুভ রাজশাহীতে থাকতে শুরু করেন। তিনি রাজশাহী আসতে চাইলেও শুভ তাকে বলতেন, কিছু দিন পরই এই চাকরি ছেড়ে তিনি ঢাকায় আসবেন।
কিন্তু এর মাঝেই আবার বিয়ের পরিকল্পনা করেন শুভ। রাজশাহী নগরীর এক মেডিকেল ছাত্রীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে তৃতীয় বিয়ে করেন তিনি। কিন্তু দ্বিতীয় স্ত্রী উপস্থিত হলে শুভকে তালাক দেন তার তৃতীয় স্ত্রী। এদিকে সন্তানের কথা চিন্তা করে শুভকে মেনে নেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী। পুলিশ আটক করে থানায় নিয়ে গেলেও মুচলেকা দিয়ে শুভকে ছাড়িয়ে রাজশাহী ফিরে যান তিনি।
এরপরও থামেনি শুভর প্রতারণা। শ্বশুরবাড়ি সাতদিন থাকার পর ব্যাংক ঋণের কথা বলে তার অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য শ্বশুরের কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা নেন তিনি। এ ছাড়া শ্বাশুড়ির ড্রয়ার থেকে আরও ৯৫ হাজার টাকা ও দুটি স্বর্ণের বালা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। এরপর থেকে তিনি রাজশাহী ফেরেননি।
এ বিষয়ে শুভর দ্বিতীয় স্ত্রী আমাদের সময়কে জানান, শেষবারের প্রতারণার পর শুভর বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেবেন তিনি।
শুভর তৃতীয় স্ত্রীর বাবা আমাদের সময়কে জানান, তিনিও একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী। প্রেমের ফাঁদে ফেলে শুভ তার মেয়েকে বিয়ে করেন। শুভ তাকে প্রকৌশলী ও তার বাবাকে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য হিসেবে পরিচয় দেন। এর ভিত্তিতেই তার মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হন। কিন্তু প্রতারণার বিষয়টি সামনে এলে থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করেন তিনি।
শুভর বাবা আবদুল মজিদ মৃধা জানান, তিনি একজন কৃষক, বর্গা চাষ করেন। তার ছেলে একজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। বিয়ে যা করার তার ছেলে না জানিয়ে একাই করেছে। কোনো কিছুই তাদের জানানো হতো না।
এ বিষয়ে জানতে সোহান মাহমুদ ওরফে শুভ মৃধাকে ফোন করলে আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘তিনটা বিয়ে করেছি, এটা ঠিক, সবগুলোই অ্যাকসিডেন্ট। তবে সবাই কেন সার্টিফিকেট জাল বলছে, তা বুঝতে পারছি না। আমি পাঁচ-ছয় মিনিট পর ফোন করে আবার কথা বলবো।’ তবে শুভ আর ফোন করেননি।
শিক্ষা সনদ জালিয়াতি প্রসঙ্গে শুভ বলেন, ‘সার্টিফিকেট জাল করি আর যাই করি, যেখান থেকে পারি সেখান থেকে আয় করে স্ত্রীকে খাইয়েছি। আপনাদের মাথা ব্যথা না দেখালেও চলবে।’
নগরীর রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, শুভ একজন প্রতারক। তার ব্যাপারে থানায় একটা সাধারণ ডায়েরি হয়েছে। তবে প্রতারিত পরিবারগুলো এখনও মামলা করেনি। তার সনদগুলো জাল। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চাইলেই তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন