ডা. সাঈদ এনাম
কেবলমাত্র ভোর হয়েছে। পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছে। আমাদের ইমার্জেন্সি ডাক্তার রুম থেকে বেশ শোনা যায় তাদের সেই কলকাকলি। ডিউটি ডাক্তারের শোবার রুমের বেলকনিতে আবার কয়েকটা চড়ুইয়ের স্থায়ী নিবাস। ওরাও বেশ চনমনে হয়ে উঠেছে।
আমি মশারির ভেতর থেকে জানালার থাই গ্লাস দিয়ে গাছের ডগার সবুজ পাতায় ওপর ভোরের সোনালী রোদের খেলা দেখছি, আর পাখিদের কিচিরমিচির ডাক শুনছি। এমন সময় হঠাৎ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ইমার্জেন্সি মোবাইলটি ডিউটি ডক্টরের বুক পকেটে থাকে সবসময়, ডিউটির দিনে বা রাতে।
'স্যার জরুরি', মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট ডাকলেন।
অত্যন্ত ধৈর্যশীল, গুনী, অভিজ্ঞ চিকিৎসা কর্মী। চিকিৎসা সেবায় নিবেদিত প্রান। সবার খুবই প্রিয়। আমি আদর করে তাকে দ্বীজ বলেই ডাকতাম।
বিছানা ছেড়ে ছুটলাম ইমার্জেন্সিতে। একটা আট-দশ বছরের বাচ্চা মেয়ে ইমার্জেন্সি বেডে শোয়ানো। সারা গায়ে ছোপ ছোপ কাদা মাটি।
'কী হয়েছে' জিজ্ঞাসা করায় মা বললেন, 'আমার মেয়েকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে সন্ত্রাসীরা মেরেছে আর খারাপ কাজ করেছে'।
যেহেতু রেইপ কেইস, পুলিশ কেইস। সিরিয়াস বটে। তাছাড়া সাক্ষী, প্রমাণ, মামলা, মোকদ্দমা, সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট অনেক কিছু অনেক বড় বিষয়, তাই জরুরিভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলাম।
বিদায়ের আগে গাইনোকোলজিস্ট বা লেডি ডক্টর না থাকায় সিনিয়র সিস্টার কে বললাম যতদূর পারা যায় প্রাইভেট পার্ট এক্সামিনেশন করে এর একটা এক্সটারনাল ইঞ্জুরী নোট লিখে রাখতে। যদিও মা মেয়ের সর্ট মেডিকেল হিস্ট্রি তে তেমন পজেটিভ কিছু প্রতীয়মান হয়নি। তারপরও এসব কেইস এক্সপার্ট ওপিনিয়নের জন্যে অনেক সময় রেফার্ড করাই শ্রেয়।
চলে যাবার একটু পরেই চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র নিয়ে হাজির এক নেতা। ডাক পড়লে, আবার গেলাম ইমার্জেন্সিতে, 'কী ব্যাপার?'।
ব্যবস্থাপত্র মেলে ধরে নেতাজী ইরশাদ করলেন, "এই নাবালিকা মেয়েটা রেইপ হলো। গ্রামের মকবুল মাতব্বরের সাঙ্গোপাঙ্গে সবাই মিলে রেইপ করলো, আর আপনি কিনা ধর্ষণের কোন সার্টিফিকেট না দিয়ে, রোগী কে ভর্তি না করে, সদরে পাঠিয়ে দিলেন"!
আমি বললাম, "যেভাবে নিয়ম সেভাবেই সব করা হয়েছে। বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া রেইপ বা ধর্ষণ চুড়ান্ত লিখে দেবার কোন নিয়ম নেই। তাছাড়া প্রাথমিক পরীক্ষায় তেমন কোন আলামত পাওয়া যায়নি। তারপরও যেহেতু যারা নিয়ে এসেছেন তারা সে রকম কিছু একটার ইঙ্গিত দিয়েছেন, সন্দেহ করেছেন তাই 'হিস্ট্রি অব রেইপ' লিখে রেফার্ড দিলাম সদরে। এটাই নিয়ম। সেখানে গাইনি ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বোর্ড বসিয়ে সাফ সাফ সার্টিফিকেট দেবেন। ওটাই যুক্তিযুক্ত। আপনারা দ্রুত সেটাই করেন। সদরে যান। আলামত কিন্তু বেশিক্ষণ কিন্তু থাকেনা। পরে প্যাচে পড়বেন"।
তিনি বাদ সাধলেন। তিনি একশত ভাগ নিশ্চিত। তাই তাকে ক্লিনকাট 'ধর্ষণের সার্টিফিকেট' দিতেই হবে। এটা নিয়ে তিনি তার প্রতিপক্ষ মকবুল ও তার কয়েকজন সাঙ্গোপাঙ্গোদের বিরুদ্ধে মামলা করবেন। এক্ষুনি অ্যারেস্টের ব্যবস্থা করবেন। একেবারে নাছোড়বান্দা টাইপের নেতা।
কি করবো বুঝিতে পারলাম না। এসবে খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। কারন শব্দ ব্যবহারে সামান্য হেরফের এ অনেক সময় নিরীহ ডাক্তার ফেঁসে যান। আমি দ্বিজ বাবুর দিকে চেয়ে তাকে বললাম, ‘বাবু এক কাজ করেন, নেতাজী যেহেতু নিশ্চিত করে বলছেন, রেইপ কেইস তাহলে উনাকে রাজস্বাক্ষী করে একটা বন্ড সই রেডি করেন। 'রেইপ' লিখে দেই। নেতাজীর একটা মান সম্মান আছেনা...’
"জ্বী স্যার" বলে বাবু তাৎক্ষণিক লাল কালিতে বন্ড সই লিখে আনলেন,
"'আমি অমুক নিশ্চিত করে বলিতেছি যে ইহা রেইপ কেইস এবং ইহা আমার সম্মুখেই হইয়াছে...."
তারপর সাদা পাতায় ঝকঝকে লাল লেখা গুলো তিনি নেতার সামনে মেলে ধরলেন, স্বাক্ষর দেবার জন্যে।
নেতাজী'তো এখন আর নড়েন চড়েন না। মুখে কোন কথা নেই। আমতা আমতা করে অস্পষ্ট স্বরে বললেন,
"না মানে আমি কেনো স্বাক্ষর দেবো, আমি কেনো রাজসাক্ষী হবো। আমার সামনেতো রেইপ হয়নি। আমিও সবার মতো শুনেছি রেইপ কেইস স্যার। তাই বলতে এসেছি.....'। (অনেক ক্ষন পর তার মুখে 'স্যার' শব্দ বের হলো)
আমি বললাম, "এই না আপনি একশত ভাগ নিশ্চিত হয়ে বললেন"।
তিনি আবার বললেন, "না স্যার.... বলেছিলাম কি, মানে... মানে আমি শুনেছি রেইপ তাই বলেছিলাম। আচ্ছা ঠিক আছে বন্ড সই লাগবেনা। আমরা সদরে যাই। কইরে চ্যালা ম্যালা, তোরা আয়। আসি স্যার। আসসালামু আলাইকুম...."।
আমি বললাম, "ওয়ালাইকুম"
লেখক: ডা. সাঈদ এনাম
মেম্বার, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন
মেম্বার, ইউরোপিয়ান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন