আদালত নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরও পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় কয়েক শ ‘বোমা মেশিন’ দিয়ে পাথর উত্তোলন অব্যাহত আছে। অভিযোগ আছে, পুলিশ ও বিজিবি সদস্য থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী ‘পাথরখেকো’ এ চক্রের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ড্রেজার মালিক কালের কণ্ঠকে জানান, এই চক্রের সঙ্গে বিজিবি, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি, পাথর সমিতির নেতৃবৃন্দ, নামমাত্র পত্রিকার কিছু সাংবাদিকসহ অনেকেই জড়িত। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিদিন চাঁদা হিসেবে উত্তোলনকৃত ১৮-২০ লাখ টাকার বড় অংশটি চলে যায় সরাসরি
পুলিশের কাছে। বাকি টাকার ভাগ পান স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, এসপি, ডিসির গাড়ি চালক, লাইনের গাড়িচালক, প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা, কিছু হলুদ সাংবাদিকসহ অনেকে।
তেঁতুলিয়া মডেল থানা-পুলিশের গাড়িচালক মিজানের বিরুদ্ধে ড্রেজারসংশ্লিষ্টতার অভিযোগ বেশ পুরনো। পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে মধ্যস্থতা ও ভাগাভাগির দিকটি মূলত তিনিই দেখভাল করেন। এটা এর আগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সরেস চন্দ্রের সময়কাল থেকেই চলে আসছে। এই অভিযোগে একবার তাঁকে অন্যত্র বদলি করা হলেও বছর না ঘুরতেই আবারও তেঁতুলিয়া থানায়ই হাজির হন তিনি। মিজানের একটি ফোন রেকর্ড কালের কণ্ঠ’র কাছে এসেছে। তাতে মিজান বলছেন, ‘তিন ট্রলি পাথর ওঠানোর পর এক ট্রলির দাম যেন রেখে দেওয়া হয়।’
এ ছাড়া তেঁতুলিয়া থানার এসআই অশ্বিনী রায়, এসআই শওকত, এএসআই মনমোহন বর্মণ, আশরাফুদ্দৌলা, সাজেদুর রহমান, কনস্টেবল শহিদুর রহমান, মিজানুর রহমান, ছাদেকুর রহমানসহ জেলার ঊর্ধ্বতন কিছু পুলিশ কর্মকর্তার নামেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। সূত্র মতে, এঁদের অনেকের বদলি হলেও তদবিরের জোরে তেঁতুলিয়াতেই তাঁরা ঘাঁটি গেড়েছেন এবং রাতারাতি টাকার পাহাড় গড়ছেন। এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে জেলার ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের অদৃশ্য হাত আছে বলে জানা গেছে।
তেঁতুলিয়া থানা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর অশ্বিনীর একটি ফোন রেকর্ডে তিনি অন্য প্রান্তের ব্যক্তিকে বলছেন, ‘গাড়ি ঢুকছে নাকি ওদিক? আমাদের কোনো লোকজন গেছে নাকি? দুজন লোক মনে হয় মোটরসাইকেলযোগে গেল। কোথায় সাইট চালাচ্ছেন? কুকুরমুহা?...ওটা মনে হয় বক্করের? অভিযোগ করার কেউ নেই...সেটা আমি দেখব। চার ট্রলি হয়ে গেছে ,আর দুই ট্রলি তোলার পর এক ট্রলির দাম রেখে দেবেন।’
বিজিবির বিরুদ্ধে অভিযোগ, সীমান্ত এলাকার দুই কিলোমিটারের মধ্যে এসব চললেও তারা কোনো বাধা দিচ্ছে না। বিজিবির নামে টাকা তুলছেন ঢিপা নামের এক বিজিবির সোর্স। ফোন রেকর্ডে যা পাওয়া গেছে, তাতে তিনি একজনকে বলছেন, ‘টাকা না দিলে কোনো জোর নাই। পরে কিছু হলে আমাকে আর ফোন দেবেন না।’ এরপর ফোনের অন্য প্রান্তের ব্যক্তিকে ‘আকবরিয়া হোটেলে’ যেতে বলেন তিনি।
ড্রেজার সিন্ডিকেটের তিন হোতার একজন এসারুল। তাঁকে ফোনে জনৈক ব্যবসায়ীকে বলতে শোনা যায়, মেশিনপ্রতি তাঁকে ৫০০ টাকা করে দিতে হবে। তাহলে বিজিবিকে আর আলাদাভাবে কোনো টাকা দিতে হবে না। টাকা না দিয়ে কোনো সমস্যায় পড়লে তার কোনো দায় নেই।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও জেলা প্রশাসনের পক্ষে মাঝেমধ্যে ‘লোক-দেখানো’ কিছু অভিযান চললেও থেমে নেই বিকট শব্দের এসব মেশিন। সারা রাত উচ্চ শব্দে ড্রেজার চলায় ওই এলাকার দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ নির্বিঘ্নে ঘুমাতে পারছে না। পড়াশোনার পরিবেশ হারিয়েছে শিক্ষার্থীরা। নিষিদ্ধ এই ড্রেজার মেশিন তৈরি করতে তেঁতুলিয়া ভজনপুর এলাকায় অসংখ্য ওয়ার্কশপ গড়ে উঠেছে। সবার সামনেই এ ‘কর্মযজ্ঞ’ চললেও পুলিশ তাদের ‘খুঁজে পাচ্ছে না’।
অবৈধ বোমা মেশিন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদ করে আসছে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠনসহ স্থানীয় মানুষ। প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান, মানববন্ধন, প্রতিবাদী নাটক, সড়ক অবরোধসহ ফেসবুকেও সরব আন্দোলনকারীরা।
গত সেপ্টেম্বরে স্থানীয় তরুণদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘জাগ্রত তেঁতুলিয়া’র উদ্যোগে তেঁতুলিয়া চৌরাস্তায় সম্মিলিত প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়। তখন নড়েচড়ে ওঠে পুলিশ প্রশাসন। তখন পুলিশ সুপার গিয়াস উদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, ‘আমি পঞ্চগড় থাকতে বা আমার সময়কালে পঞ্চগড়ে কোনো ড্রেজার চলবে না।’ এই আশ্বাসে তখন প্রতিবাদ সমাবেশ স্থগিত করা হয় এবং রাতারাতি বোমা মেশিন বন্ধও হয়ে যায়। কিন্তু কয়েক মাস পর এখন আবার কেন চলছে অবৈধ বোমা মেশিন—এ প্রশ্নের জবাবে গত ৯ ফেব্রুয়ারি তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার জানা মতে, কোনো বোমা মেশিন চলছে না। কোথাও বোমা মেশিন চললে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, একদিকে নদী খননের কাজ উদ্বোধন করছেন জেলা প্রশাসক, অন্যদিকে বোমা মেশিনে পাথর উত্তোলনের কারণে দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদী। এর আগের জেলা প্রশাসক ড্রেজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বেশ তৎপর ছিলেন। এখন মাঝেমধ্যে টাস্কফোর্সের অভিযান ছাড়া কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত এক বছরে জেলার বিভিন্ন এলাকায় টাস্কফোর্সের অভিযানে ১৬৯টি ড্রেজার মেশিন ধ্বংস ও জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া ২৪টি ড্রাম এবং ২০ হাজার ৭৫ ফুট রিং পাইপ জব্দ করা হয়েছে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন