চুয়াডাঙ্গার ইমপ্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে চলতি বছরের পয়লা এপ্রিল বিনা মূল্যে অস্ত্রোপচার করে এক চোখ হারান ২০ রোগী। এ ঘটনায় গঠিত দুটি তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে হাসপাতালের অবহেলার কথা উল্লেখ করেনি। অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসককে দায়ী করেও দেওয়া হয়নি কোনো বক্তব্য।
রোগীদের এক চোখ হারানোর ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাইকোর্টে জনস্বার্থে রিট করেন এক আইনজীবী। ওই রিটের শুনানি শেষে বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের হাইকোর্ট বেঞ্চ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের প্রত্যেককে এক কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে।
হাইকোর্টে ওই রিট করার আগেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আলাদা দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তার মধ্যে একটি কমিটি ৫ মে তাদের প্রতিবেদনে বলে, হাসপাতাল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে তাতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অস্ত্রোপচার প্রক্রিয়ায় বা অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি বা প্রাসঙ্গিক অন্যান্য দ্রব্যের জীবাণুমুক্তকরণ প্রক্রিয়ায় ত্রুটির কারণে ছানি অপসারণ করা চোখে জীবাণুর সংক্রমণ ঘটেছে। ব্যবহৃত কেমিক্যালের মধ্যে অরোব্লু, অরোলেঞ্জ, আই ড্রফট (সিঅ্যান্ডপি) ম্যাকটিটেক্স, হ্যান্ডগ্লোভস ওষুধ প্রশাসনের রেজিস্ট্রেশনভুক্ত নয় বলে মাসুদুল হক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ওষুধ প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বক্তব্যে প্রতীয়মান হয়েছে। এগুলোর রেজিস্ট্রেশন এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের পক্ষ থেকে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের প্রতিনিধি ছিলেন।
ওই কমিটির প্রতিবেদন ১৭ জুলাই হাইকোর্টে দাখিল করা হয়। তাতে বলা হয়, অস্ত্রোপচারের সময় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, ওষুধ, মাস্কে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যাঘাত ঘটে। এ কারণে জীবাণু সংক্রমিত হয়, সব রোগীর চোখে সংক্রমণ হয়। আক্রান্ত চোখ থেকে সংগৃহীত নমুনায় ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের ল্যাবরেটরির পরীক্ষায় জীবাণু শনাক্ত করা হয়।
কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অস্ত্রোপচার করার কোনো এক সময়ে এসব রোগীর চোখে সংক্রমণ হয়, যা অনিচ্ছাকৃত ও দুর্ঘটনাজনিত। এ ক্ষেত্রে হাসপাতালের কোনো অবহেলা নেই।
‘যেহেতু অপারেশনকারী প্রতিষ্ঠান ইমপ্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টার দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়ে নিজ উদ্যোগে সকল রোগীর পরবর্তী চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং উক্ত হাসপাতালটি ইতোপূর্বে বহু রোগীর চক্ষু অপারেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ নিরাময়যোগ্য অন্ধত্ব প্রতিরোধে যথেষ্ট অবদান রেখেছে; এই হাসপাতাল ৩৫ হাজার ৮৪১ জন রোগীর অপারেশন করেছে। এ ছাড়াও অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত রোগীদের পুনর্বাসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তা মানবিক ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ বলে বিবেচিত হবে’, বলা হয় প্রতিবেদনে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমান ছাড়াও ডা. আকরাম হোসেন, ডা. ইফতেখার মো. মনির, ডা. একিউএম মনির শরীফ, ডা. এটিএম ইকবাল আনোয়ার ও ডা. সানিয়া তাহসিন প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করেন। এতে বলা হয়, চক্ষু শিবিরের অস্ত্রোপচারে ২০ রোগীর এক চোখ নষ্ট হয়েছে। কিন্তু আরেকটিতে দৃষ্টিমান বিদ্যমান আছে।
এমন প্রতিবেদন দেখে মঙ্গলবার বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বলে, ‘ডাক্তারদের নৈতিকতার মান কোথায়? চোখ হারানোর ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুটি প্রতিবেদনে ভিন্নতা কেন?’
‘তাহলে প্রতিবেদন অনুযায়ী অপরাধ বা ত্রুটি হয়েছে। তবে অপারেশনকারী সার্জন মো. শাহীন ও ইমপ্যাক্ট মাসুদুল হক হাসপাতাল কি নির্দোষ?’, বলেন বেঞ্চের একজন বিচারপতি।
এই চক্ষুশিবিরে অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসক মো. শাহীনের অভিজ্ঞতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি আদালত। বিচারপতি বলেন, ‘উনার (ডাক্তারের) দক্ষতা নিয়ে আমাদের কোনো প্রশ্ন নাই। সেটি আমরা এই মামলাতে দেখবও না।’
বিচারপতি আরও বলেন, ‘যেসব গরিব মানুষ আস্থা নিয়ে অপারেশন করতে গিয়েছিল, ডাক্তারদের প্রতি তাদের আস্থা হারিয়ে গেছে। মূলত অপারেশন করতে চুয়াডাঙ্গার ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টার কর্তৃপক্ষের কোনো অবহেলা ছিল কি না, আমরা সেটিই দেখব।’
আদালতের ভাষ্য, চক্ষুশিবিরে তিন দিন অস্ত্রোপচার করা হয়। পরপর দুই দিন কোনো সমস্যা হয়নি। তৃতীয় দিন সমস্যা হয়েছে। এতেই বোঝা যায় যে, তৃতীয় দিনের অস্ত্রোপচারের সময় ওষুধ ও অস্ত্রোপচার করার যন্ত্রপাতিতে পয়জন (জীবাণু) ছিল। এই অস্ত্রোপচার করতে যে ব্যাঘাত ঘটেছিল, সে ক্ষেত্রে ইমপ্যাক্ট কর্তৃপক্ষের কোনো অবহেলা ছিল কি না, সেটাও দেখা হবে।
আদালতে ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারের পক্ষে কথা বলেন ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘চক্ষুশিবিরে যে কোম্পানি থেকে ওষুধ ও অপারেশনের যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হয়েছে, সে কোম্পানির নাম আসেনি। তাদেরকে এখানে পক্ষভুক্ত করা হোক। আইরিশ নামের একটি ওষুধ কোম্পানি অপারেশনের ওষুধসমূহ সরবরাহ করেছিল। আইরিশকে এই মামলায় পক্ষভুক্ত করা হোক। কারণ তাদের দেওয়া ওষুধ দিয়ে অপারেশন সম্পন্ন করা হয়েছে।’
ওই সময় আদালত জানায়, রিট পিটিশনকারী আইরিশকে পক্ষভুক্ত করতে আবেদন করতে পারে।
উত্তরে রিটকারী আইনজীবী অমিত দাসগুপ্ত বলেন, ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোন কোম্পানির কাছ থেকে ওষুধ নিয়েছে, সেটি আমাদের জানার বিষয় না। সুতরাং আইরিশকে পক্ষভুক্তির আবেদন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করতে পারে।’
ওই বক্তব্যের পর আদালত ১৮ জুলাই, বুধবার ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলামকে একটি আবেদন নিয়ে আসতে বলেন এবং পরর্বতী শুনানির দিন নির্ধারণ করে।
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন