নিপীড়িতদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকরা।
মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) ক্যাফেটেরিয়ার শিক্ষক লাউঞ্জে এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এই অভিযোগ করেন। গত রোববার জাতীয় শহীদ মিনারে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও শিক্ষক লাঞ্ছনার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকরা এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
এতে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক, সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক খান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা, অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ড. সামিনা লুৎফা। তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্তদের নানা নিপীড়নের পাশাপাশি ‘বাম ঘরানার শিবির', ‘তাদের কার্যক্রম জঙ্গির মতো', ‘তারা আসলে জামাত-শিবির’ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত করা হচ্ছে। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে যারা নিপীড়ক, তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপই নেয়া হচ্ছে না, কোনো বক্তব্যই দেয়া হচ্ছে না। কেবল যারা নিপীড়িত, তাদের তাদের বিরুদ্ধেই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে, প্রশাসনের দিক থেকে বক্তব্য প্রদান করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মাঝে তারা প্রশাসনিক ভীতি তৈরি করার চেষ্টা করছেন যাতে তারা প্রতিবাদী হয়ে উঠতে না পারে এবং ক্যাম্পাসজুড়ে চলমান নীরব বা সরব সহিংসতা বজায় থাকে।
তিনি বলেন, শিক্ষকদের লাঞ্ছনার বিষয়টি অত্যন্ত আপত্তিকর। এরকম পরিস্থিতিতে সেই সমাবেশ স্থলে প্রক্টরিয়াল বডির কেউ উপস্থিত ছিলেন না। পুলিশ বাহিনীর কেউ ছিলেন না। এভাবেই নিপীড়নের একটি ক্ষেত্র আগে থেকেই প্রস্তুত করে দেওয়া হয়েছিল। শিক্ষার্থীরা যখন ছাত্রলীগের আক্রমণের শিকার হলো, তখন শিক্ষক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং পাশে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে আমরাও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছি। আমাদেরকে বিভিন্ন ব্লেম দেওয়া হয়েছে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরাই শুধু নয়, আমরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, এটা কারও অজানা নয় যে, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের অঙ্গুলি হেলন ছাড়া আবাসিক হলগুলোর একটি গাছের পাতাও নড়তে পারে না। হল প্রশাসনও তাদের কাছে জিম্মি। এরই ধারাবাহিকতায় গত রোববার শহীদ মিনারে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি ও হামলাকারীদের বিচারের দাবিতে সমাবেশ করতে গেলে আমাদের কয়েকজন শিক্ষক তাতে সংহতি জানাতে যান। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সেই সংহতি সমাবেশ পণ্ড করতে গিয়ে নানা অসভ্য উপায় বরণ করে। তারা শিক্ষকদের সমাবেশের কাছে এসে পাল্টা মাইক জুড়ে দিয়ে বক্তৃতা করে, শিক্ষকদের নিয়ে কটূক্তি করে ও কোনো যোগসূত্র ছাড়া জামায়াত-শিবির বলে আখ্যা দেয়।
ফাহমিদুল হক বলেন, শহীদ মিনারে সমাবেশের পরে হামলার বিষয়ে আমরা যখন প্রক্টরের সঙ্গে যোগাযোগ করি, তখন আমাদেরকে বলা হলো আমরা কেন সমাবেশ করার আগে অনুমতি নিলাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৩’র অধ্যাদেশের কোথাও ‘ক্যাম্পাসে সমাবেশ করার জন্য অনুমতি নিতে হবে’এমনটা বলা আছে বলে মনে হয় না।
'শিক্ষার্থীদের ক্লাস বর্জনের সাথে আপনার একাত্ততা পোষণ করেন কি না’এমন প্রশ্নের জবাবে তানজীম উদ্দিন খান বলেন, শিক্ষার্থীরা স্বাধীন। তাই তারা ইচ্ছে মতো ক্লাস করবে, যার ইচ্ছা হবে না, সে করবে না। আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি। তাদের ক্লাস বর্জনে আমরা কোনো সমর্থন বা ইন্ধন দিচ্ছি না।
কর্মসূচি: সংবাদ সম্মেলনে ড. সামিনা লুৎফা নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকদের পক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এগুলোর মধ্যে- বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে শিক্ষকদের সংহতি সমাবেশ, ২৩ জুলাই কলাভবনের সামনের বটতলায় নিপীড়নবিরোধী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কাছে শিক্ষক লাঞ্ছনার পরিপ্রেক্ষিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য পত্র প্রেরণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্বতা রক্ষা, অ্যাকাডেমিক মান সমুন্নত রাখা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের কাছে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকদের উদ্যোগে স্মারকলিপি পেশ করা হবে।
নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের স্মারকলিপি: এদিকে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী মঙ্গলবার দুপুরে ‘বারবার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উপর হামলাকারীদের বিচার ও জোর-জুলুম-সন্ত্রাসমুক্ত ভয়ভীতিহীন গণতান্ত্রিক নিরাপদ বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেনন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীরা। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। পরে সেখান থেকে ১০ জনের একটি প্রতিনিধি দল উপাচার্য কার্যালয়ের দিকে রওয়ানা হন।
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন: দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় হামলার প্রতিবাদে বিজ্ঞান গ্রন্থাগারের প্রবেশ মুখে কালো ব্যানার নিয়ে মানববন্ধন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এতে বিভাগের অন্তত দুই শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে তাদের নিরাপত্তা না দেওয়া হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলে তারা জানান। এছাড়া শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত আটক শিক্ষার্থীদের দ্রুত মুক্তির দাবিও জানান।
মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা ‘এমন ক্যাম্পাসই কি আমরা চেয়েছিলাম?’, ‘ক্যাম্পাস অনিরাপদ কেন?’, ‘আমাদের ক্যাম্পাসে আমরা কেন আক্রান্ত?’ ইত্যাদি লেখা সম্বলিত প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।
ছাত্র ইউনিয়নের বিক্ষোভ: এদিকে দুপুরে ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদ, নিরাপদ ক্যাম্পাস ও প্রক্টরের পদত্যাগের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে। মিছিলে ঢাবি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক রাজিব দাশ, সাবেক সভাপতি তুহিন কান্তি দাশসহ সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশ নেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন