ট্রেনের সিটে বসে থাকা এক তৃষ্ণার্ত নারীর জন্য পানি আনতে গিয়েছিল স্টেশনেই এক দোকানে। ট্রেনের সে তর সইনি। থামা ট্রেন, অথচ হুইসেল দিয়েই স্পিড বাড়িয়ে দেয়। পানির বোতল হাতে নিয়ে দরজার সিঁড়িতে পা রাখতেই বেসামাল। ছিটকে পড়েন ট্রেনের নিচে। মুহূর্তেই ডান পা বিচ্ছিন্ন। চাকায় চাকায় গড়িয়ে যান আরও কয়েক গজ সামনে। পাথরের আঘাতে আঘাতে গোটা শরীর ক্ষত-বিক্ষত।
তখনও জ্ঞান হারায়নি। কিন্তু উদ্ধারের পর কাটা পায়ে চোখ রাখতেই আঁতকে ওঠেন! মিনিট খানিক আগেও যে পায়ে ভর করে ট্রেনে উঠতে চাওয়া, সে পা নেই! ভাবতেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন টগবগে যুবক রাসেল। যার জন্য পানি আনতে গিয়ে এত কিছু! অথচ তার কিছুই জানল না সেই তৃষ্ণার্ত নারী। জানার প্রয়োজন হয়নি রেল কর্তৃপক্ষকেও। এখন হারানো পা নিয়ে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের যুবক রাসেল।
দু’সপ্তাহের আগের কথা। বৃহস্পতিবার ঢাকায় ফিরবেন বলে ট্রেনে ওঠেছিলেন নোয়াখালী থেকে। কমলাপুর স্টেশনে কন্টেইনার টার্মিনালে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করছেন বছর তিনেক আগে থেকে। পাঁচ বছর আগে বাবার মৃত্যুর পরেই পরিবারের হাল ধরতে হয়েছে রাসেলকে। মা, ছোট দুই ভাই, দুই বোনের বেঁচে থাকার ভরসা রাসেল-ই।
ঘটনার দিন ট্রেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে এসে দাঁড়ালে সিটে বসে থাকা এক নারী পানি কিনে এনে দেয়ার অনুরোধ করেন। পানি নিয়ে ট্রেনে উঠতেই দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি।
ঘটনার পর উদ্ধার করে প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদিকে নিজের এবং পরিবারে কারও কাছে কোনো মোবাইল না থাকায় ঘটনা কাউকে জানাতে পারে না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক ডাক্তার অবস্থা গুরুতর দেখে ঢাকায় অর্থোপেডিক (পঙ্গু) হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। ওই চিকিৎসক নিজেই দু’ব্যাগ রক্ত, একটি লুঙ্গি এবং কিছু টাকা দিয়ে একজনকে সঙ্গে দিয়ে ট্রেনে তুলে দেন।
পরের দিন এয়ারপোর্টে স্টেশনে আসার আগেই সঙ্গে আসা লোকটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। রক্তাক্ত কাটা পা নিয়ে ট্রেনে বসেই কাঁদতে থাকেন রাসেল। পরে স্টেশনের আনসার সদস্যরা ধরে প্লাটফর্মে নামান তাকে। আনসার সদস্যরা লোকজনের কাছ থেকে শ’চারেক টাকা সাহায্য তুলে সিএনজিতে করে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। এখানেও বিধি বাম। সিএনজি চালক পঙ্গু হাসপাতালের গেটে নামিয়ে দিয়েই চলে যান। সেখানে বসেই ব্যথায় চিৎকার করতে থাকেন অনবরত।
পরে হাসপাতালের ঝাড়ুদাররা জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন। পরে পঙ্গুর চিকিৎসকরা কাটা পা ব্যান্ডেজ করে পুরুষ ওয়ার্ডের বারান্দায় পাঠিয়ে দেন। সেবা প্রায় এখানেই বন্ধ। অভিভাবক না থাকায় পরবর্তী চিকিৎসা করতে অপারগতা প্রকাশ করেন ডাক্তার। হাসপাতালের বারান্দাতেই বিনা চিকিৎসায় সপ্তাহ খানেক কেটে যায় অসহায় তরুণের।
বারান্দায় শুয়ে যখন অসহ্য যন্ত্রণায় বুকফাটা চিৎকার করছিলেন, তখন খবর পেয়ে এগিয়ে আসেন স্বেচ্চাসেবী সংগঠন ‘হাসিমুখ’-এর প্রতিষ্ঠাতা তাহসিন। সঙ্গে আসেন আরও স্বেচ্ছাসেবক। ঘটনা সব খুলে বলেন রাসেল। তাহসিনদের বদৌলতেই পরবর্তী চিকিৎসা পেতে শুরু করেন। তাহসিন রাসেলের ছবি আর নাম ঠিকানা দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন। তা দেখেই ঘটনার আর আট দিন পর মা আর মামা ছুটে আসেন হাসপাতালে। ইতোমধেই অপারেশন করে ডান পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে বাকি অংশ কেটে ফেলা হয়েছে রাসেলের।
বৃহস্পতিবার হাসপাতালের বেডে শুয়ে জাগো নিউজ’র কাছে দুঃখ কথা শোনান পা হারা এই যুবক। কাটা পায়ে হাত রাখতেই অশ্রুতে চোখ ভরে গেল। সে অশ্রু শুধু পা হারানোর জন্য-ই নয়, কে নেবে পরিবারের ভার, কে দেবে ছোট ছোট ভাই-বোনদের মুখে খাবার, তা বলতেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলেন রাসেল। ততক্ষণে চোখের জলে বালিশ ভিজে গেল। রাসেলের মাথার কাছে বসে থাকা মধ্যবয়সী মা কাজলও চোখ মুছলেন ক্ষণে ক্ষণে।
ধরে আসা গলায় রাসেল বলেন, অন্যের মোবাইলে ফেসবুকে দেখে ছোট বোনরা কান্না করছে। তারা বিশ্বাস করছে না আমার পা নেই। আমিও বলতে পারছি না। ওদের এখন খাওয়াবে কে! কে পরাবে! পা নেই, এমন মনে হলেই ছোট ভাই-বোনদের মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে।’
নিঃস্ব, সর্বহারা রাসেলের চিকিৎসা ব্যয় হচ্ছে অন্যের দেয়া সাহায্যে। বাকি চিকিৎসার জন্যও অন্যের দারস্ত হতে হচ্ছে রাসেলকে। সাহায্যের জন্য যোগাযোগ-আকরাম হোসাইন তাহসিন, প্রতিষ্ঠাতা, হাসিমুখ। মোবাইল নম্বর-০১৭১৩৫৪৫৭০১ (বিকাশ)।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন