চট্টগ্রামে বেসরকারি চাইল্ড কেয়ার হাসপাতালে জীবিত শিশুর পরিবর্তে মৃত শিশু দেয়ার কেলেঙ্কারির প্রাথমিক সমাধান হয়েছে। জীবিত শিশুকন্যাকে তার পরিবারের কাছে তুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু মৃত যে পুত্রশিশু দিয়ে এই কেলেঙ্কারি ঘটনা ঘটানো হয়েছে, তাকে নিয়ে এখনো রহস্য কাটেনি। এনিয়ে মুখ খুলছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
জীবিত শিশু লুকিয়ে মৃত শিশু ধরিয়ে দেয়ার ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ২৪ ঘণ্টা নানা নাটকীয়তায় পর জীবিত কন্যাশিশুটিকে তার মা রোকসানার কাছে ফিরিয়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এখন প্রশ্ন হলো- মৃত পুত্রশিশুটি কার ছিল? কাকেই বা বুঝিয়ে দেয়া হলো? এ বিষয়ে কোনো সদোত্তর পাওয়া যাচ্ছে না নবজাতক বদল কেলেঙ্কারিতে জড়িত চাইল্ড কেয়ার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেনের ট্রিটমেন্ট হাসপাতালে তৃতীয় তলার চাইল্ড কেয়ার ইউনিটে গত ১৮ এপ্রিল বুধবার ভোর থেকে থানা পুলিশ, কন্যাশিশুর অভিভাবক ও চাইল্ড কেয়ার কর্তৃপক্ষের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে কন্যাশিশুটিকে তুলে দেয়া হয় তার মায়ের কাছে। এর আগে ভোর ৬টার দিকে তাদের কাছ ফেরত নেয় আগের দিন বুঝিয়ে মৃত পুত্রশিশুর লাশ।
শনিবার বিকালে ওই কন্যাশিশুর মা রোকসানার সঙ্গে আলাপকালে জানান, বুধবার সকাল ১০টায় নগরের জিইসি মোড় রয়েল হাসপাতালের শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছে তার শিশুকন্যাকে। সে চার দিন চিকিৎসাধীন রয়েছে এই হাসপাতালেই।
শিশু কেলেঙ্কারির বিষয়ে তিনি বলেন, গত ১২ এপ্রিল বিয়ের পাঁচ বছর পর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে বাবার বাড়িতে স্বাভাবকিভাবেই কন্যাশিশু জন্ম দেন তিনি। স্বামী মহিউদ্দিন প্রবাসে থাকায় তিনি বাবার বাড়িতেই ছিলেন।
রোকসানা জানান, জন্মের এক ঘণ্টা পর বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দ্রুত নোয়াখালীর মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রায় তিন দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর বাচ্চার শারীরিক অবস্থা অবনতি ঘটে। পরে কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়ার পরার্মশ দেন।
তিনি জানান, গত ১৫ এপ্রিল রোববার সকালে চট্টগ্রামে এসে প্রথমে চট্টগ্রাম মেডিকেলের এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যান। ওই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে শিশুকন্যাকে দুপুর ১২টায় ভর্তি করা হয় ট্রিটমেন্ট হাসপাতালের তৃতীয় তলার চাইল্ড কেয়ার হাসপাতালে।
রোকসানা বলেন, ভর্তি করার কিছুক্ষণ পরই চাইল্ড কেয়ারের কয়েকজন চিকিৎসক শিশুকন্যাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র-আইসিইউ-তে রাখার পরামর্শ দেন। দুই দিন আইসিইউ-তে চিকিৎসার পর ১৭ এপ্রিল মঙ্গলবার সকাল ৮টায় কন্যাশিশুটিকে মৃত ঘোষণা করে চাইল্ড কেয়ার কর্তৃপক্ষ।
তিনি বলেন, এরপর শিশুটিকে জানাজার জন্য প্রস্তুত করতে গোসল করাতে যায় গ্রামের বাড়ির লোকজন। চাইল্ড কেয়ার কর্তৃপক্ষের মুড়িয়ে দেয়া কাপড় খুলে শিশুকে বের করতেই দেখা যায় ফতুয়া ও পেমপার্স পরানো। কিন্তু আমাদের শিশুর গায়ে কিছুই ছিল না।
রোকসানা বলেন, গোসল করাতে ফতুয়া ও পেমপার্স খুলতেই সবাই চমকে উঠি। এতো আমাদের শিশুকন্যা নয়, অন্য কারো শিশুপুত্রের লাশ! রাত ৯টায় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে চাইল্ড কেয়ার হাসপাতাল থেকে দেয়া শালটি নিয়ে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় চলে যান তারা।
কন্যাশিশুর চাচা আলমগীর হোসেন জানান, মঙ্গলবার রাতে বাচ্চা শনাক্ত করার পর সকাল ৯টা ৪৫ মিনেটে রয়েল হাসপাতালে বাচ্চা নিয়ে আসি। এর আগে আমরা পুত্রশিশুর লাশ পুলিশের মাধ্যমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিয়েছে।
তবে ওই ছেলে শিশুর লাশ কর্তৃপক্ষ কাকে বুঝিয়ে দিয়েছে- শনিবার বিকাল ৪টায় চাইল্ড কেয়ারের ব্যবস্থাপক শওকত হোসেনের কাছে জানতে চান পরিবর্তন ডটকমের এই প্রতিবেদক। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি আপনাকে পরে জানাব।’
এর আগে এ বিষয়ে জানতে চাইলে চাইল্ড কেয়ার হাসপাতালের পরিচালক ডা. ফাহিম হাসান রেজা বলেন, ভর্তিকালীন ট্যাগ পরিবর্তনের কারণে এই ভুল বুঝাবুঝিটা হয়েছে। পরে আমরা কন্যাশিশুকে তার মায়ের কাছে এবং মৃত পুত্রশিশুকে তার অভিভাবকদের বুঝিয়ে দিযেছে।
মৃত পুত্রশিশুর অভিভাবকদের নাম-ঠিকানা জানতে চাইলে ডা. রেজা বলেন, ‘হাসপাতালে পরে একসময় আসলে জানতে পারবেন।’
ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর বুধবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে চাইল্ড কেয়ারের পরিচালক প্রফেসর ডা. বদরুদ্দোজা বলেন, ‘আমাদের নলেজে আসার পর আমরা তদন্ত করে ভুলটা বুঝতে পেরে রোগীর স্বজনদের ডেকে তাদের কন্যাশিশু বুঝিয়ে দিয়েছি। এটা অবশ্যই প্যাথেটিক ঘটনা।’
তিনি বলেন, ‘এঘটনাকে একেকজন একেকভাবে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। অবশ্যই স্বীকার করছি- রোগীর স্বজনরা মানসিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। তবে বেড বদলের কারণে এমনটা হয়েছে।’
মৃত পুত্রশিশুর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিভাবকদের বুঝিয়ে দিয়েছি। তবে সেই অভিভাবকদের নাম-ঠিকানা জানাতে পারেননি চাইল্ড কেয়ার পরিচালক।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি আমিনুল হক বাবু বলেন, এই ন্যাক্কারজনক কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের কোনো অবস্থাতেই ছাড় দেয়া যায় না।
তিনি বলেন, শিশুকন্যাকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার আগে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত কোথায় ছিল, কী চিকিৎসা চলছিল এবং কার তত্ত্বাবধানে ছিল সেটা বের করতে হবে। একইভাবে মৃত পুত্রশিশুর অভিভাবকদের পরিচয় কেন জানানো হচ্ছে না তাও বের করতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগের তদন্ত কমিটি আশা করি বিষয়টি বের করবে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত চলমান, প্রতিবেদন হাতে পেলেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পরামর্শক্রমে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আলোচিত নবজাতক কেলেঙ্কারির ঘটনায় তদন্ত কমিটি করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে (শুক্রবার সকাল ১০টা) তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল কমিটিকে।
তবে বেঁধে দেয়া সময়ে প্রতিবেদন দিতে পারেনি কমিটি। কমিটির দাবি, সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আরো ৪৮ ঘণ্টা সময় প্রয়োজন। আবেদনের প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় দফায় আরো ৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়ে রোববার বিকাল ৪টা পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার নাথকে আহ্বায়ক এবং একই হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. শাহ আলমকে সদস্য সচিব ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কর্মকর্তা শাহেদুল ইসলামকে কমিটির সদস্য করা হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন