ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহার করে ব্যাংকসহ সরকারি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। শুক্রবারও সোনালী ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষায় ডিভাইস ব্যবহার করে অংশ নেয়া ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এ নিয়ে গত ১৫ দিনে চক্রটির ১৮ জনকে গ্রেফতার করলো পুলিশ।
পুলিশ বলছে, ডিভাইস ব্যবহার করে নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি করা এই চক্রটি বিশাল বড়। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ সদস্যই জালিয়াতি করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ নিয়ে চাকরির পাশাপাশি এই প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। টাকার বিনিময়ে জালিয়াতি করে অন্যদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতে সাহায্য করছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চক্রটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালকসহ বিভিন্ন ব্যাংক কর্মকর্তা ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জড়িত। এরই মধ্যে চক্রটির মূলহোতাসহ অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে। বাকি সদস্যদের গ্রেফতার করতে একের পর এক অভিযান চলছে।
চক্রটির সকলকে গ্রেফতার করা সম্ভব হলেই অভিনব কায়দায় ঘটানো এই জালিয়াতি পুরোপুরিভাবে বন্ধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগের (উত্তর) এডিসি গোলাম সাকলাইন পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, শুক্রবার বিকেলে অভিযান চালিয়ে সোনালী ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি করা পাঁচ শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়। তারা ডিভাইস নিয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকেছিল। এর আগে নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতিতে আরো ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, চক্রটিতে ব্যাংক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অনেকেই জড়িত। গতকাল যারা গ্রেফতার হয়েছে তারা প্রিলি পরীক্ষার সময়ও একইভাবে জালিয়াতি করে টিকেছিল। তারা যদি এভাবে জালিয়াতি করে টিকতে থাকে তাহলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা চাকরি থেকে বঞ্চিত হবে। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই শুধুমাত্র পেশাগত দিক থেকে নয় আবেগের জায়গা থেকেই আমরা এই চক্রটির সকলকে ধরতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সবাইকে গ্রেফতার করা গেলে ভয়াবহ এই জালিয়াতি বন্ধ করা যাবে বলে আশা করছি।
জালিয়াতিতে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা ও পরীক্ষার্থীরা
পরীক্ষা কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহার করে উত্তর সরবরাহকারী এই চক্রটির প্রধান পুলকেশ দাস বাচ্চু (৩২) নিজে কয়েক দফা জালিয়াতি করে চাকরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এরপর থেকে তিনি সবার কাছে নিজেকে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিতে থাকেন।
এক পর্যায়ে তিনি বিদেশ থেকে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস আমদানি করে নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির একটি বড় সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। ওই সিন্ডিকেটে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক আবু জাফর মজুমদারসহ আরো বেশ কয়েকজনের নাম উঠে এসেছে। পাশাপাশি পরীক্ষার্থীরাও জড়িয়ে পড়েছে এই চক্রের সাথে।
গত ১৭ এপ্রিল রাজধানীর রমনাসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে পুলকেশ ও তার সহযোগী মনিরুল ইসলাম (২৩) এবং মো. ফিরোজ আহমেদকে (২৬) ৮টি বিশেষ ডিভাইস ও ১১টি ব্লুটুথ ইয়ারপিসসহ গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ।
পরদিন বুধবার (১৮ এপ্রিল) ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট একেএম মইন উদ্দিন সিদ্দিকীর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন পুলকেশ।
এর আগে গত ৭ এপ্রিল নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি করার ঘটনায় গ্রেফতার হন ৩ জন ব্যাংক কর্মকর্তাসহ ১০ জন।
গ্রেফতার হওয়া তিন ব্যাংক কর্মকর্তা হলেন— পূবালী ব্যাংকের মো. মনিরুল ইসলাম ওরফে সুমন, সোনালী ব্যাংকের অসীম কুমার দাস ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মো. সোহেল আকন্দ।
সবশেষ শুক্রবার (২০ এপ্রিল) সোনালী ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষা চলাকালীন সময় রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজ, লালমাটিয়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় এবং তেজগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী এই পাঁচজনকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ।
তারা ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও মোবাইল ফোন ব্যবহার করে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল।
এছাড়া এই পরীক্ষার্থীরা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে হলের বাইরে থেকে প্রশ্নের উত্তর সরবরাহ করত বলে জানিয়েছে পুলিশ।
গ্রেফতাররা হলেন— মো. আহসানুজ্জামান, মো. মমিনুল ইসলাম ওরফে মমিন (২৯), রিয়াশদ হোসেন সেতু (৩০), মো. রাশিদুল ইসলাম ওরফে তাজুল (৩১) ও মো. শামসুজ্জামান ওরফে পলাশ (২৯)।
যেভাবে নিয়োগ জালিয়াতিতে পুলকেশের উত্থান
নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি চক্রের মূল হোতা পুলকেশ দাস বাচ্চুর গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির গরংগলে। তিনি ২০০২ সালে এসএসসি ও ২০০৫ সালে এইচএসসি পাসের পর ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে ২০১২ সালে অনার্স সম্পন্ন করেন। আদালতে পুলকেশের দেয়া জবানবন্দি থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
অনার্স শেষ করার পর আর মাস্টার্স করা হয়নি পুলকেশের। অনার্সের পরপরই চাকরির জন্য জালিয়াতির পথ বেছে নেন পুলকেশ। পরিচিত এক বড় ভাইয়ের সহায়তায় মোবাইলে এসএমএস জালিয়াতির মাধ্যমে একটি সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি। কিন্তু ওই পরীক্ষায় তিনি না টিকলেও টিকে যান তার সাথেই জালিয়াতি করে পরীক্ষায় অংশ নেয়া আরেক ব্যক্তি।
এরপর থেকেই জালিয়াতি করে কয়েকবার নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন পুলকেশ। সব চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে তিনি নিজেকে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিতে থাকেন সবার কাছে। আর জালিয়াতির নতুন পথ খুঁজতে থাকেন।
এক পর্যায়ে পুলকেশ নিজেই বনে যান চাকরিদাতা। তিনি কয়েকজন অসাধু ব্যবসায়ীর মাধ্যমে চীন থেকে বিশেষ এক ধরনের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ইমপোর্ট করেন। আর সেসব ডিভাইস ব্যবহার করে জালিয়াতি করতে করতে ধীরে ধীরে একটি বড় সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এ কাজে তিনি বেশ কয়েকজনকে সহযোগী হিসেবে কাছে পেয়েছিলেন। তার মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন ব্যাংক কর্মকর্তা।
কার্জনের কাছ থেকেই প্রথম ডিভাইস কিনেন পুলকেশ
পুলকেশের সঙ্গে ২০১৫ সালের শেষ দিকে পরিচয় হয় মোহাম্মদ কার্জন নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। ওই ব্যক্তির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠার এক পর্যায়ে তারা দুজন মিলে নিয়োগ পরীক্ষা জালিয়াতির ফন্দি করে। ২০১৬ সালের প্রথম দিকে এই কার্জনের কাছ থেকেই ১৭ হাজার টাকা করে তিনটি ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ক্রয় করে পুলকেশ।
এরপর পুলকেশ তার বন্ধু ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরিফুর রহমান শাহীনকে সাথে নিয়ে বিভিন্ন সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার্থী সংগ্রহ করতে শুরু করেন। পরীক্ষার্থী সংগ্রহের পর পুলকেশ তার সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যদের মাধ্যমে ডিভাইসগুলো পরীক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ ও পরীক্ষার্থীদের শরীরে ডিভাইস স্থাপনসহ সংরক্ষণের কাজ করাতে থাকেন।
প্রাথমিকভাবে প্রিলিমিনারী পরীক্ষার জন্য পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত নিতেন পুলকেশের সিন্ডিকেট। তারপর যারা প্রিলিমিনারীতে সফল হতেন, তাদের কাছ থেকে পরবর্তী সময়ে আরো টাকা নেয়া হতো। পুলকেশের মাধ্যমে জালিয়াতিতে অংশ নিয়ে এখন পর্যন্ত অন্তত ২০ জন পরীক্ষার্থী বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন বলে আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে জানিয়েছেন তিনি।
ডিভাইস ব্যবহার করে যেভাবে জালিয়াতি হচ্ছে
সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি চক্রের গ্রেফতার হওয়া বিভিন্ন সদস্যদের কাছ থেকে জালিয়াতির প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পেরেছে পুলিশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নির্দিষ্ট পরীক্ষার দিন চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীদের কানে ও বাহুতে বিশেষ কায়দায় ইলেকট্রনিক ডিভাইস স্থাপন করে জালিয়াতি চক্রের সদস্যরা।
ওই ডিভাইস দিয়ে পরীক্ষার্থী শুধু কল রিসিভ করতে পারেন, কল করতে পারেন না। চক্রের সদস্যরা পরীক্ষার হলের বাইরে থেকে ডিভাইসে কল করে পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করেন। প্রশ্ন সংগ্রহের পর তারা দ্রুত উত্তর বের করে তা পরীক্ষার্থীর সাথে থাকা গোপনীয় ডিভাইসে সরবরাহ করেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন