আতিয়া মহলের বর্তমান অবস্থা দেখাচ্ছেন বাড়ির মালিক উস্তার আলীসিলেটের দক্ষিণ সুরমার পাঠানপাড়ার সেই ‘জঙ্গি আস্তানা’ (আতিয়া মহল) এখন ভাড়াটিয়াদের স্বাভাবিক জীবন-যাপন ফিরে এসেছে। এর আগে ভবনটিতে জঙ্গিরা যে আস্তানা গড়ে তুলেছিল, সে বিষয়টিই ভুলে গেছেন এর পুরনো অনেক বাসিন্দা। গত বছরের শেষের দিকে পুরো ভবনের মেরামত কাজ শেষে পাঁচতলা বাড়িটির ২৯টি ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া হয়। এখন আবার সেই আতিয়া মহলে ফিরে এসেছে প্রাণচাঞ্চল্য। বাড়ির মালিক উস্তার আলী বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী অভিযানে আতিয়া মহলের ক্ষতি হলেও দেশের অনেক লাভ হয়েছে।’
গত ৩ মার্চ (শনিবার) দুপুরে সরেজমিনে আতিয়া মহলে কথা হয় পুরনো কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে। তারা বলেন, ‘এই ভবনটিতে অনেক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। জঙ্গি অভিযানে বাড়িটির যে অবস্থা ছিল, তা এখন আর নেই। মালিক পক্ষ মেরামত করেই বাড়িটি ভাড়া দেয়। জঙ্গিবিরোধী অভিযানের স্মৃতিচারণ করে তারা বলেন, মনে হয় নতুন জীবন নিয়ে বেঁচে আছি। ওইদিন যদি সেনাবাহিনী আমাদের উদ্ধার না করতো, তাহলে বেঁচে থাকাই আমাদের কাছে স্বপ্ন হয়েই থাকতো।’
এই ভবনের বাসিন্দা আব্দুল্লাহ ও আফসানা বলেন, ‘জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সময় গুলি আর বোমার শব্দে মনে হয়েছিল যুদ্ধ লেগেছে। আতঙ্কে দিন পার করতে হয়েছে আমাদের। সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়ে তারা বলেন, সংকটময় মুহূর্তে সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য যে ভূমিকা পালন করেছেন, তা অতুলনীয়। তাদের জন্য আমাদের নতুন জীবন পাওয়া।’
এই রুমেই জঙ্গিরাছিল
আতিয়া মহল বাড়িটির পাঁচতলা ভবনের নিচতলার ৪নং ফ্ল্যাটে মর্জিনা ও কাউছার নামে দুই জঙ্গি নিজেদের স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে ওই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল। বর্তমানে ওই ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন ফাতেমা বেগম। তিনি বলেন, ‘ছেলে-মেয়েদের লেখপড়ার জন্য তিনি সিলেটে এসেছেন গত বছরের ডিসেম্বর মাসে। অন্য ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে শুনেছি, এই ফ্ল্যাটে নারীসহ জঙ্গিরা বসবাস করতো। তবে ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার সময় এ বিষয় কেউ কিছু বলেনি।’ ফ্ল্যাটে থাকতে ভয় হয় কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না ভয় নেই। কারণ, যা ঘটেছিল, তা আর ঘটবে না বলে আশা রাখি। ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার সময় বাড়িটির মালিক আমাদের ভোটার আইডিসহ সবার ছবি নিয়েছেন। এছাড়া ভাড়াটিয়া ফরমে আমাদের তথ্যও নিয়েছেন তিনি।’
পাশের ফ্ল্যাটে থাকা সিলেট র্যাবে কর্মরত দুলাল আহমদের স্ত্রী নগরের চণ্ডিপুল এলাকার বাসিন্দা জানান, ‘অনেক আগে খবরে দেখেছি, আতিয়া মহলে জঙ্গিরা ছিল। পরে শুনেছি তারা মারাও যায়, এই বাড়িটি সেই আতিয়া মহল তা জানা ছিল না। এখন কিছুটা ভয় কাজ করছে।’
ভবনটি তদারকি করতে দেখা যায় আতিয়া মহলের মালিক উস্তার আলীকে। তিনি বলেন, ‘আতিয়া মহল নামে আমার দু’টি বাড়ি রয়েছে। সামনের বাড়িটি চারতলা ও পেছনের বাড়িটি ছিল পাঁচতলা। পাঁচতলা বাড়িটির নিচতলার ৪ নং ফ্ল্যাটে মর্জিনা ও কাউছার নামের দু’জন জঙ্গি ছিল। তারা আমার কাছে স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে ফ্ল্যাটি ভাড়া নেয়। কাউছার আমাকে জানায়, সে একটি বহুজাতিক কোম্পানির ডিলার। ভাড়া দেওয়ার আগেই তাদের কাছ থেকে ছবি ও ভোটার আইডিসহ সার্বিক তথ্য নিয়ে রাখি। এমনকি পুলিশের তথ্য ফরম পূরণ করেও তা মহানগর পুলিশের মোগলাবাজার থানায় একটি কপি দাখিল করে রাখি। ’ তিনি আরও জানান, ‘ওই সময়ে থানার ওসি ছিলেন খায়রুল ফজল। তিনি আর এসব বিষয় যাচাই-বাছাই করেননি। পরে গোয়েন্দাদের তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ আমাকে জানায় আতিয়া মহলের পাঁচতলা বাড়িতে জঙ্গিদের আস্তানা আছে। এরপর পুলিশের সঙ্গে গত বছরের ২৪ মার্চ ভোরে পাঁচতলার ২৯টি ফ্ল্যাটের দরজায় তালা দিয়ে রাখি। তালা দেওয়ার আগে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বলেছিলাম, কাউছার নামের ওই লোকটি প্রতিদিন সকাল ১০টার দিকে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যায়। বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলার কথা জানালেও তারা আমার কথা রাখেননি। কথা না রাখার কারণে আমি নিজেই ভয় পেয়ে যাই। এরপর ভবনের ফ্ল্যাটের দরজায় তাল ঝুলিয়ে রাখি। অপরাশেন চলার সময় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় ভবনটি। তবে, আমার অনেক ক্ষতি হলেও দেশের অনেক লাভ হয়েছে। পাঁচতলা ও চার তলা ভবনের পাশেই আমার একতলা আরেকটি বাড়ি ছিল। অভিযানের সময় এই বাড়িটি পুরোটাই ভেঙে ফেলা হয়।’
জঙ্গিবিরোধী অভিযানের পর বাড়িটির দেয়াল ধসে পড়ার পর
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশের উপ-কমিশনার (সিলেট উত্তর) ফয়সাল মাহমুদ বলেন, ‘গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ওই ভবনটি পুলিশই গেরাও করে রেখেছিল। আর অভিযানের প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেছিল পুলিশ। সরকারের উচ্চমহল থেকে সিদ্ধান্ত আসে অভিযান চালাবে সেনা বাহিনী। সে অনুযায়ী সেনা বাহিনী অভিযান চালায়।’
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় সিলেটের জঙ্গি আস্তানায় সেনা অভিযানের মধ্যে জোড়া বোমা বিস্ফোরণে সাতজন নিহত ও অন্তত ৪৫ জন আহত হন। সাতজন নিহতের ঘটনায় সিলেট মহানগর পুলিশের মোগলাবাজার থানায় দু’টি মামলা হয়। এসআই শিপলু দাস বাদী হয়ে হত্যা মামলা ও আতিয়া মহল থেকে বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় একই থানার এসআই সুহেল বাদী হয়ে আরেকটি মামলা দায়ের করেন। এর আগে ২৪ মার্চ ভোর থেকে শুরু হয় আতিয়া মহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান। ২৮ মার্চ বিকেল পর্যন্ত সেনা অপারেশন ‘টুয়াইলাইট’ পরিচালিত হয়। সেনা প্যারা কমান্ডোদের অভিযানে শীর্ষ ৪ জঙ্গি নিহত হয়। এরপর ওই বছরের ৯ মে পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশের পর ১৩ মে মামলা দু’টি আলামত ও ডকেট বুঝে নেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআইয়) তদন্তকারী দল। বর্তমানে মামলা দু’টি তদন্ত করছে পিবিআই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন