বিএনপি সরকারের শেষ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে বর্তমান সরকারের আমলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির তুলনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।সরকার প্রধানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার এক যুগ আগে বিএনপি সরকারের শেষ বছরের তুলনায় চার গুণ থেকে ক্ষেত্র বিশেষে ১০ গুণ বড় হয়েছে নানা খাত। দারিদ্র্যের হার কমেছে প্রায় অর্ধেক।রবিবার রাজধানীতে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদক প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এই তুলনা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।অনুষ্ঠানে মোট ১৮ জনকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়। এদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সংগ্রামে অবদান রাখায় এই পদক পান ১০ জন, যাদের সাত জন পেয়েছেন মরণোত্তর পুরস্কার। বাকিরা শিক্ষা, চিকিৎসা, শিল্প, সাংবাদিকতাসহ নানা খাতে অবদানের জন্য পুরস্কার পান।
অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী পুরস্কার তুলে দেন। এদের মধ্যে প্রয়াত স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর স্ত্রী মেহজাবীন হুইল চেয়ারে করে পুরস্কার নিতে আসেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী তার চেয়ার থেকে উঠে সামনে এগিয়ে এসে তার হাতে পদক তুলে দেন। এ সময় মেজহাবীন চৌধুরী শেখ হাসিনার মুখে হাত বুলিয়ে আদর করে দেন।পরে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে মুক্তিযুদ্ধের পর সাড়ে তিন বছরের চেষ্টা এবং আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের চেষ্টা তুলে ধরেন।প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটি বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে উঠেছিল মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে। যে বাংলাদেশ ছিল দরিদ্র, যে দেশের ৮০ থেকে ৯০ ভাগ মানুষ ছিল দরিদ্র সেই বাংলাদেশকে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে গড়ে তুলে তিনি (বঙ্গবন্ধু) একটি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে যান এবং বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের পথে যাত্রা শুরু হয়।’‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ বহু আগেই উন্নত, ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে পারত।’
দুই সরকারের পরিসংখ্যান
প্রধানমন্ত্রী মাথাপিছু আয়, বিদ্যুৎ উৎপাদন, বাজেটের আকার, দারিদ্র্য ও প্রবৃদ্ধির হারসহ নানা বিষয়ে বিএনপি সরকারের সঙ্গে তার সরকারের তুলনা দেন প্রধানমন্ত্রী।শেখ হাসিনা জানান, বিএনপি সরকারের শেষ বছর ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ ডলার। বর্তমানে তা এক হাজার ৬১০ ডলার।২০০৫-০৬ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১.৫৬ শতাংশ। বর্তমানে তা কমে ২২ শতাংশে নেমে এসেছে।বিএনপির শেষ বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৫.৪ শতাংশ। এখন তা ৭.২৮ শতাংশ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আশা করি আরও বেশি হারে প্রবৃদ্ধি হবে।’২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিল ১০.৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা তিন গুণেরও বেশি বেড়ে হয়েছে ৩৪.৬৭ বিলিয়ন ডলার।বিএনপি সরকারের শেষ বছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির আকার ছিল চার লাখ ৪২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চার গুণেরও বেশি বেড়ে এটি হয়েছে ১৯ লাখ ৭৫ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা।বিএনপির শেষ বছর বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩.৪৮ বিলিয়ন ডলার। প্রায় ১০ গুণ বেড়ে এটি এখন হয়েছে ৩৩ বিলিয়ন ডলার।
২০০৫-০৬ অর্থবছরে মুদ্রাস্ফীতি ৭.১৬। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের সময় এটি ১০ শতাংশের বেশি ছিল বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। গত জানুয়ারি সেটি কমে হয়েছে ৫.৭ শতাংশে।আবার বিএনপি সরকারের শেষ বছরে বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ ছিল ০.৭৪ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এটি চার গুণ বেড়ে তিন বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাজেট ছিল ৬১ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। সেটি প্রায় সাত গুণ বেড়ে এখন হয়েছে চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকা।বিএনপির শেষ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ছিল ১৯ হাজার কোটি টাকা। এটি আট গুণ বেড়ে এখন হয়েছে এক লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা।বিএনপির শেষ বছরে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল তিন হাজার ২০০ মেগাওয়াট। অথচ ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা ছাড়ার সময় এটা ছিল চার হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ বিএনপি সরকারের আমলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ার বদলে কমেছে ১১০০ মেগাওয়াট।বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ১৬ হাজার মেগাওয়াট। আর দেশের ৯০ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে।প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য, প্রতিটি ঘরে ঘরেই আমরা আলো জ্বালব, কোথাও অন্ধকার রাখব না।’‘এ ছাড়া রাস্তাঘাট, পুল, ব্রিজ, যা যা দরকার, আমরা করে যাচ্ছি।’‘আমি শুধু এটুকু চাই, ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই বাংলাদেশকে আমরা উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।’
‘বাংলাদেশের যাত্রা যেন থেমে না যায়’
বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা চালু থাকবে-এই প্রত্যয়ের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা নিয়ে এই বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে, এই যাত্রা যেন থেমে না যায় এই যাত্রা যেন অব্যাহত থাকে।’‘বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুধার্থ থাকবে, রোগের চিকিৎসা পাবে না, মানবেতর জীব যাপন করবে, ঘরবাড়ি থাকবে না, এটা তো হতে পারে না।’‘জাতির পিতা আমাদেরকে যে সংবিধান দিয়ে গেছেন, সেই সংবিধানে তিনি স্পষ্ট মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলে গেছেন। কাজেই অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা এই মৌলিক অধিকারগুলো পূরণ করা আমাদের কর্তব্য।’‘আমার কাছে ক্ষমতায় থাকা মানে জনগণের প্রতি এই কর্তব্য পালন করা আর মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এই বাংলাদেশকে গড়ে তোলা, জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা।’প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে আমরা চলব। কারও কাছে মাথা নত করে নয়, কারও কাছে হাত পেতে নয়।’‘আমাদের যতটুকু সম্পদ, তাই দিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে যাব, দেশকে আমরা আরও সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যাব।’
‘সরকারের ধারাবাহিকতা থাকায় অর্জন’
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের স্বীকৃতিপত্র পাওয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা সরকারের ধারাবাহিকতার ওপর জোর দেন। বলেন, ‘সরকারের ধারাবাহিকতা ছিল বলেই আমরা এটা অর্জন করতে পেরেছি।’প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য প্রধান তিনটি শর্তের মধ্যে দুটি শর্ত পূরণ করলেই সনদ পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা বাংলাদেশ তিনটি শর্তই বেশ বড় ব্যবধানে পূরণ করেছে।এই উত্তরণের জন্য তিন বছরে গড় মাথাপিছু আয় ১২৪২ ডলারের বেশি হতে হয়। সেখানে বাংলাদেশ বর্তমানে মাথাপিছু আয় এক হাজার ৬১০ ডলার। আবার জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচক ৬৬ বা তার ওপরে হতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ অর্জন ৭২.৯ পয়েন্ট। আবার অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচক ৩২ এর নিচে হতে হয়। বাংলাদেশের এটা ২৫।প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০০৮ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল তারে আগে নির্বাচনী ইশতেহারকে আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম দিন ‘বদলের সনদ’। আর ২০১৪ তে আমরা ঘোষণা দেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।’
‘সম্মান জানিয়ে সম্মানিত হব’
স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা বিশেষ অবদান রেখেছেন তাদেরেকে সরকার সম্মান জানাবে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা জানি আরও বহু অবদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমরা চেষ্টা করছি খুঁজে খুঁজে বের করতে। আমরা তাদের সম্মানিক করে নিজেরাই সম্মানিত হতে চাই।’
ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন