ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের হরিপুর গ্রামে আন্তঃসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল গত শনিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি)। এর আয়োজন করে বেসরকারি সংস্থা দ্যা হাঙ্গার প্রজেক্ট ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। কিন্তু স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের অভিযোগ, এটি এক ধরনের প্রহসন। হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দির ভাঙার ঘটনায় আসামিদের নিয়ে ‘সম্প্রীতি রক্ষার নামে প্রহসনের এ অনুষ্ঠান’ করা হয়েছে।
জানা যায়, আয়োজকদের সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন হামলা মামলার দুই আসামি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক মিয়া ও বিএনপি নেতা জামাল মিয়া। এ ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
এ ব্যাপারে নাসিরনগর উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি কাজল জ্যোতিদত্ত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানের বিষয়ে জানতে পেরেছি। এক বছর আগের হামলা ও মন্দির ভাঙচুরের মামলার আসামি হরিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক মিয়া এবং ইউনিয়ন বিএনপির উপদেষ্টা সাবেক চেয়ারম্যান জামাল মিয়াকে নিয়ে সম্প্রীতির উৎসব নামে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। কী উপলক্ষে তারা এ আয়োজন করেছে তা বোধগম্য নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত বছর হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনার পর আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে নাসিরনগর সদরে সস্প্রীতির অনুষ্ঠান করবো বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু সমালোচনা হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে আমরা অনুষ্ঠানটি করিনি, তা থেকে বিরত ছিলাম। অথচ এক বছর পর যখন সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে, তখন মন্দির ভাঙচুর মামলার আসামিদের নিয়ে সম্প্রীতির অনুষ্ঠান করা হলো।’
এ ঘটনাকে দুঃখজনক অভিহিত করে উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি কাজল জ্যোতিদত্ত বলেন, ‘আমরা এটা মেনে নিতে পারছি না।’
নাসিরনগর উপজেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুজিত কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘সম্প্রীতির নামে আমাদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট মামলার আসামিদের নিয়ে মঞ্চে উঠে আয়োজকরা এক ধরনের তামাশা করেছেন। এ ঘটনায় আমরা মর্মাহত। এ ধরনের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই।’
এ ব্যাপারে নাসিরনগর কেন্দ্রীয় গৌর মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক নির্মল চৌধুরীও বলেন, ‘এই অনুষ্ঠানটি এক কথায় এক ধরনের প্রহসন।’
সম্প্রীতি উৎসবে হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা মামলার আসামি (পেছনে হাত তোলা)
মন্দির ভাঙচুর মামলার আসামিদের প্রকাশ্য মঞ্চে অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবু জাফর বলেন, ‘হরিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক মিয়া ও ইউনিয়ন বিএনপির উপদেষ্টা জামাল মিয়া উভয়েই মন্দির ভাঙচুর মামলার আসামি। সময় মতো আদালতে তাদের নামসহ পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।’
তবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজক দ্যা হাঙ্গার প্রজেক্টের কান্ট্রি ডিরেক্টর ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার জানান, ‘এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা সবাইকে একত্র করার চেষ্টা করেছি। কাউকে চিহ্নিত করে অনুষ্ঠানে আনা হয়নি।’ আসামিদের মঞ্চে বসানোর ব্যাপারে তিনি আরও বলেন, ‘তারা আসামি হতে পারেন। আসামি হলেই কেউ দোষী হয়ে যায় না। আমরা কোনও আসামিকে পুনর্বাসন করার চেষ্টা করিনি। আবার দোষীকে আরও দোষ দিতে চাইনি। নাসিরনগরে যে দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, আমরা এটার ইতি টানার চেষ্টা করেছি।’
এ ব্যাপারে হরিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক মিয়া জানান, হাঙ্গার প্রজেক্টের কর্মকর্তা তন্ময় সাহেবের দাওয়াতে আমি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আর কোনও দোষ না করেই আমি মন্দিরে হামলা মামলার আসামি হয়েছি। অনুষ্ঠানে না গেলে আমার প্রতি তাদের নেতিবাচক ধারণা ও সন্দেহ আরও ঘনীভূত হবে ভেবে সেখানে উপস্থিত হয়েছি।’
ইউনিয়ন বিএনপির উপদেষ্টা জামাল মিয়া বলেন, ‘আমি সাবেক চেয়ারম্যান। তাই হয়তো তারা আমাকে দাওয়াত দিয়েছে।’ মন্দির ভাঙার আসামি হয়ে কীভাবে অনুষ্ঠানে যোগদান করেছেন জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘ভাই, আমরা দোষ না কইরা এখন আসামি। কী বলবো! যারা ঘটনা ঘটাইছে তারা পার পেয়ে গেছে, আমরা আসামি। আদালত সঠিক বিচার করবেন বলে আশা করি।’
জানা যায়, গত শনিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সাধারণ সম্পাদক ও দ্যা হাঙ্গার প্রজেক্টের কান্ট্রি ডিরেক্টর বদিউল আলম মজুমদার। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) উম্মে সালমা, বৃটিশ হাইকমিশনের গভর্ন্যান্স টিম লিডার অ্যাসলিন বেকার, পেইভের রূপকার অ্যালিস্টার লেগ, দ্যা হাঙ্গার প্রজেক্টের প্রোগ্রাম ম্যানেজার সৈকত শুভ্র আইচ।
সম্প্রীতি উৎসবে হরিপুর স্থানীয় মন্দিরের পুরোহিত সবুজ চক্রবর্তী আলিয়া মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্টকে কোরআন উপহার দেন এবং আলিয়া মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট পুরোহিতকে গীতা উপহার দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম অবমাননার ছবি পোস্টের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাসিরনগর উপজেলা সদর ও হরিপুরের হিন্দু গ্রামের মন্দির এবং অর্ধশতাধিক ঘরবাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় মোট ৮টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় পুলিশ ১২৪ জন আসামিকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠায়। পরে সবাই জামিনে মুক্ত হয়ে নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান করছেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন