মূল লেখক বা প্রকাশকের অনুমতি নেওয়ার বিধান নেওয়ার তার তোয়াক্কা না করেই অনেক লেখক ও প্রকাশক হরদম বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ করে চলেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। একুশের বইমেলাতেও এসব বই আসছে হরদম।
কপিরাইট অফিস ও বাংলা একাডেমির অনুবাদ বিভাগ থেকে এমন অভিযোগ এনে বলা হয়েছে, মূল লেখক আর প্রকাশকের অনুমতি ‘প্রচুর অর্থসাপেক্ষ’ বলে লেখক-প্রকাশকরা নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না।
কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন, বইমেলায় অনুবাদের বই প্রকাশের আগে মূল লেখক বা প্রকাশকের অনুমতিপত্রের কপি কপিরাইট অফিসে জমা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু হাতেগোণা কয়েকজন প্রকাশক ছাড়া কেউ এই তা জমা দেন না।
কপিরাইট আইন অনুযায়ী, লেখকের মৃত্যুর পরবর্তী ৬০ বছর তার পরিবার গ্রন্থস্বত্ত্ব হিসেবে রয়্যালিটি পায় প্রকাশকের কাছ থেকে। ৬০ বছর পরে সেগুলো পাবলিক প্রপার্টি হয়ে যায়। তখন কেউ যদি সে লেখকের কোনো বই প্রকাশ করতে চায়, তবে তা মূল প্রকাশকের অনুমতি সাপেক্ষে পারবে।
বাংলা একাডেমির অনুবাদ শাখার পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, “এভাবে অনুমতি ব্যতিরেকে বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ চলতে থাকায় ভিনদেশে বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গন নিয়ে ভুল বার্তা পৌঁছাচ্ছে।”
ছবি: মুস্তাফিজ মামুন ছবি: মুস্তাফিজ মামুন বইমেলায় আসা একাধিক প্রকাশনীর প্রকাশক ও ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তারা অনুবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে মূল লেখক বা প্রকাশকের কোনো অনুমতি নেন না।
বাতিঘর-ঢাকা থেকে এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হচ্ছে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড’ এর বাংলা অনুবাদ ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’। প্রকাশক দীপঙ্কর দাশ ও অনুবাদক জি এইচ হাবীব জানান, তারা মূল লেখক বা প্রকাশকের কারো অনুমতি নেননি।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে জি এইচ হাবীব তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, “বাংলাদেশে অনুবাদের কোন বইটির অনুমতি আছে? মূল প্রকাশক বা লেখক বা তার পরিবারের কেউ যদি অভিযোগ জানাতে আসে, সেটা আমি পরে দেখব।”
দীপঙ্কর দাশ বলেন, “অনুমতি পেতে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা নিয়মনীতির মধ্যে আমাদের যেতে হয়। এসব নিয়মনীতি সহজ হলে প্রকাশকদের সুবিধা হত।”
অনুবাদের বই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি মাজহারুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যারা অনুমতি ছাড়া বই ছাপে, তাদের বইমেলাতেই আসা উচিৎ নয়। এমন বেআইনি কার্যকলাপের জন্য তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়াও প্রয়োজন।”
ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন এ প্রসঙ্গে কথা হয় ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ও অনুবাদ অধ্যাপক আবদুস সেলিম, খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা শিক্ষা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী, অনুবাদক-লেখক রাজু আলাউদ্দিনের সঙ্গে।
রাজু আলাউদ্দিন বলেন, “কথাসাহিত্যে অনুবাদ ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠছে। সেখানে এভাবে বিদেশি লেখকদের অনুবাদ বিনা অনুমতিতে প্রকাশ করা তো অপরাধ। অনুমতিহীন গ্রন্থ প্রকাশ যে আমাদের সাহিত্যকেই অমর্যাদা করে। অনৈতিক কাজটি মানসম্মানও ক্ষুণ্ন করে আমাদের।”
অধ্যাপক আবদুস সেলিম বলেন, “অনুবাদের বইয়ের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে, কিন্তু মানসম্মত অনুবাদ একেবারেই কম। পড়াশোনা নেই, তথ্য জানাশোনা নেই, এভাবে একটা অনুবাদ করে ফেলে। তারপর অনুমতির তোয়াক্কা তো করছেই না অনেকে। যে যেভাবে পারছে করছে। এটা শুধু অন্যায় নয়, এটা বড় অপরাধও।”
অনুবাদকের ভাষা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে নিয়ে তিনি বলেন, “গ্রিক, ফ্রেঞ্চ ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদের পর আমরা সেটার বাংলা অনুবাদ পাচ্ছি। আসলে আমাদের দেশে তো বহু ভাষার চর্চা খুব কম। এটা করা গেলে, অন্য অনেক ভাষায় দক্ষতা থাকলে আমরা আরো অনেক ভালো অনুবাদ পেতাম।”
বাংলা একাডেমি থেকে অধ্যাপক সেলিমের আবু ইসহাকের ‘সূ্র্যদীঘল বাড়ি’র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে এবারের বইমেলায়।
তিনি বলেন, “বিচ্ছিন্নভাবে অনুবাদ না হয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে অনুবাদ হলে সেটি ভালো হয়। বাংলা একাডেমি বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এই উদ্যোগটি গ্রহণ করতে পারে।”
বিপিএল থেকে প্রকাশিত হয়েছে স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজারের ‘গোল্ডেন বাউ’ এর অনুবাদ ‘মানুষের জাদুবিশ্বাস ও ধর্মাচার বৃত্তান্ত’। বইটি অনুবাদ করেছেন ইংরেজির অধ্যাপক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস।
অনুবাদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সাহিত্যের অনুবাদ করতে গিয়ে আমরা যেন মূল থেকে সরে না যাই। তা না হলে কিন্তু পাঠকের কাছে আমরা একটি অখাদ্য তুলে দেব।
“অনুবাদকের সিনটেক্স চিন্তা করতে হবে। সোর্স ল্যাঙ্গুয়েজের যতটা কাছাকাছি পারা যায় যেতে হবে। মূল ভাষার সিনটেক্স অনেকটাই কিন্তু বাংলায় আনা যাবে না। বিদেশি সাহিত্যের সিনটেক্স এত প্যাঁচানো যে বাংলায় সেটা আনা অনেকটাই অসম্ভব। কনটেক্সট চিন্তা করতে অনুবাদককে আরো বেশি স্বাধীনতা নিতে হবে। তবে সেই চ্যালেঞ্জটা নেওয়া যায়।”
ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের স্প্যানিশ ভাষার শিক্ষক রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী বলেন, “ভাষা জ্ঞানের পাশাপাশি অনুবাদকের যা করণীয়- সেটা হল যে দেশের সাহিত্য সে অনুবাদ করছে, তার সংস্কৃতিটা তাকে জানতে হবে। অনুবাদের ক্ষেত্রে যে সমস্যাটা প্রকট হচ্ছে এখন, সেটা হলো এই সংস্কৃতি জ্ঞানের অভাব। মূল ভাষা থেকে ইংরেজি, তারপর বাংলায় যখন অনুবাদ করতে হয়, তখন এই সংস্কৃতিজ্ঞানের বড় প্রয়োজন রয়েছে।”
বাংলা সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ
ইংরেজি সাহিত্যের বঙ্গানুবাদের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদের ক্ষেত্রে আরো উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।
বইমেলা ঘুরতে এসে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি বলেন, “আমাদের বাংলা সাহিত্যের আবেদন রয়েছে বিশ্বজুড়ে। এখন সময় এসেছে, আমাদের সাহিত্যগুলোকে অনুবাদ করে সেগুলো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরা। বাংলা সাহিত্যের বিকাশে অনুবাদ হল একমাত্র উপায়।”
বাংলা একাডেমির অনুবাদ শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, “বাংলা একাডেমি কালজয়ী সাহিত্যগুলোর ইংরেজি অনুবাদ করছে। আমাদের পরিকল্পনায় বেশকটি সাহিত্য রয়েছে, আমরা কাজ করছি। বাঙালি বংশোদ্ভূত অনেক পরিবার থাকে দেশের বাইরে। তাদের কথা ভেবে, আমাদের সাহিত্যগুলো তাদের কাছে পৌঁছাতে আমরা কাজগুলো খুব গুরুত্ব দিয়ে করছি।”
তিনি জানান, এবার বইমেলায় বাংলা একাডেমি থেকে আসা মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’র ইংরেজি অনুবাদ ‘ওসেন অব সোরো’ অনুবাদ করেছেন ফকরুল আলম। নীলিমা ইব্রাহীমের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’র ইংরেজি অনুবাদ ‘আ ওয়ার হিরোইন স্পিক’ অনুবাদ করেছেন ফায়েজা হাসনাত।
বইমেলায় আসা অনুবাদের বই
এবার বইমেলায় অগ্রদূত প্রকাশনী থেকে এসেছে রাজু আলাউদ্দিনের বিদেশি কবিতার অনুবাদ সংকলন ‘আকাশের ওপাড়ে আকাশ’, আগামী প্রকাশনী থেকে এসেছে হেলাল উদ্দিন আহমেদের ‘কনফুসিয়াসের কথোপকথন’, ঐতিহ্য থেকে এসেছে রাজু রাজের ‘মোঘল সাম্রাজ্যের সেনা ব্যবস্থা’ ও সৈয়দ আবিদের ‘আকবর দ্য গ্রেট’ বই দুটো, পাঞ্জেরী এনেছে মোজাফর আহমেদের ‘রুসটলি’, মুক্তচিন্তা এনেছে ‘কোড অব কিং হাসুরাবি’, বিদ্যাপ্রকাশ এনেছে ফারহানা আলম শিউলীর ‘চকলেট ও জলের আখ্যান’, অ্যাডর্ন থেকে এসেছে ‘দ্য ওভার ট্র্যাকার্স’, সংবেদ থেকে এসেছে অদিতি ফালগুনীর ‘গ্রিক পুরাণের গল্প’, সময় থেকে এসেছে ফয়সল মোকাম্মেলের ‘সেকেন্ড সেক্স’, চর্চা গ্রন্থ প্রকাশ থেকে এসেছে রাকিবুল রকির ‘দ্য আলকেমিস্ট’, ইউনিভার্সেল একাডেমি থেকে এসেছে আহম্মেদ রাজুর ‘ধূসরের সবুজ ছায়া’, ‘নেপোলিয়নের জীবনে প্রেম ও নারী’, ‘দ্য লাভ মেশিন’, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে অনুবাদের বইগুলোর মধ্যে রয়েছে লিও তলস্তয়ের ‘আনা কারেনিনা’, ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ বইগুলো, বইগুলোর অনুবাদ করেছেন বিষ্ণু বসু। এখানে ফ্রেডারিক ডগলাসের ‘একজন আমেরিকান ক্রীতদাসের জীবন বৃত্তান্ত’ এনেছে তারা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন