সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহারকারী চিকিৎসকদের ওয়ালে ওয়ালে ঘুরছে একটি লিফলেট। যেখানে ওয়ালি উর রেজা নামে একজন নিজেকে চিকিৎসক হিসেবে দাবি করেছেন।
শুধু তাই নয়, ওয়ালি উর রেজা নিজেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সাবেক সহকারী অধ্যাপক হিসেবেও দাবি করেছেন।
এই দাবি করায় ওয়ালি উর রেজা চিকিৎসক না ভুয়া ডিগ্রিধারী তা খোদ চিকিৎসকদের মধ্যেই সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে।
এ কারণে অনেক চিকিৎসক ওয়ালি উর রেজার লিফলেট নিজেদের ফেসবুকে ওয়ালে দিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
শুক্রবার রাত ৯টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসক আমিনুল ইসলাম ওই লিফলেট দিয়ে নিজের ফেসবুক ওয়ালে একটি পোস্ট দিয়েছেন।
তিনি লিখেন, এ নামে কোনো সহকারী অধ্যাপক কি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে আদৌ আছে বা ছিল? একইসঙ্গে শিশু বিষয়ে এমডি ও মেডিসিনে এফসিপিএস! খোদ ঢাকা শহরেই এভাবে কি নিশ্চিত হচ্ছে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা?
ওই স্ট্যাটাসের সূত্র ধরেই অনুসন্ধান শুরু করে পরিবর্তন ডটকম।
লিফলেটে ডায়াগনস্টিক সেন্টার মেডিনোভার মালিবাগ শাখায় ওয়ালি উরের চেম্বারের ঠিকানা দেয়া।
মেডিনোভার মালিবাগ শাখায় যোগাযোগ করে জানা যায়, এরই মধ্যে ওয়ালি উর রেজা নামের ওই ব্যক্তিকে সেখান থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে।
মেডিনোভার মালিবাগ শাখার কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেন পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ওই চিকিৎসক আর আমাদের এখানে বসেন না। তার প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন কর্তৃপক্ষ। সেটা তাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
কি কারণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে ভুয়া ডিগ্রিধারীসহ নানা অভিযোগ এসেছে। সেগুলো আমলে নিয়েই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
মেডিনোভায় চেম্বার দেয়ার আগে তাকে যাচাই-বাছাই করা হয়নি কেন এমন প্রশ্নে ওই কর্মকর্তা বলেন, আসলে নিয়ম অনুযায়ী সব যাচাই-বাছাই করেই চিকিৎসকদের চেম্বার দেয়া হয়। তারপরও কেন এমন হলো সেটা আমার জানা নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওয়ালি উর রেজা নামের এই ব্যক্তির টঙ্গীর ২৮/এ খাঁ পাড়া রোডেও একটি চেম্বার রয়েছে।
রোগী পরিচয় দিয়ে সেখানে যোগাযোগ করা হলে দায়িত্বরত কর্মকর্তা মুঠোফোনে পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, স্যার তো আগামী কয়েকদিন চেম্বারে বসবেন না।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, স্যার তো গাড়ি ছাড়া চলাফেরা করেন না। আমাদের চেম্বারের সামনের রাস্তার সংস্কার কাজ চলছে। তাই স্যার রাস্তা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত বসবেন না বলে জানিয়েছেন।
ওয়ালি উর রেজার ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বার চাইলে ওই ব্যক্তি বলেন, না স্যার মোবাইল নাম্বার দিতে নিষেধ করেছেন।
তখন ওই ব্যক্তির নাম জানতে চাইলে তিনি কিছু না বলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
এদিকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ওয়ালি উর রেজা নামে কোনো চিকিৎসক ছিলেন না বলেই জানিয়েছেন সেখানে কর্মরত একাধিক চিকিৎসক।
সেখানকার হেপাটোলজি বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর ড. ফয়েজ খন্দকার পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, আমি এই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন কর্মরত। অথচ এই নামে কেউ এখানে আছে বলে আমার জানা নেই।
তিনি বলেন, তার (ওয়ালি উর রেজা) ওই লিফলেটটা দেখার পরই আমার সন্দেহটা প্রকট হয়। কারণ সেখানে তিনি সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশে সাবেক লিখে রেখেছেন। তারপর আমি এখানকার উচ্চপদস্থ অনেকের সাথে আলাপ করি। তারাও জানিয়েছেন এই নামে কেউ ছিল না।
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের রেজিস্ট্রার ড. রাশেদুল হাসান কনক পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, আমি বিগত ছয়-সাত বছর ধরে এখানে কর্মরত। আমি কখনো ওয়ালি উর রেজা নামের ওই ব্যক্তিকে দেখিনি। সিনিয়র যারা আছেন প্রায় সবার সাথেই আমরা তার বিষয়ে কথা বলেছি কিন্তু কেউই তাকে চেনেন না।
তিনি বলেন, তিনি নাকি মেডিসিনে এফসিপিএস করেছেন, তাহলে সেক্ষেত্রে তাকে আমাদের সবারই চেনার কথা। কারণ আমরা মেডিসিন বিভাগে যারা আছি সবাই সবার চেহারা চিনি।
ড. রাশেদুল হাসান কনক বলেন, আরেকটা বিষয় নিয়ে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে তা হচ্ছে মেডিসিনে এফসিপিএস করলে তার এমডিও করার কথা মেডিসিনেরই কোনো ব্রাঞ্চে। রিলেটেড সাবজেক্টেই করার কথা। কিন্তু তিনি মেডিসিনে এফসিপিএস করে কিভাবে শিশু বিভাগে এমডি করেন?
তিনি বলেন, এটা দুঃখজনক ব্যাপার যে উনার সাথে আমরা সাক্ষাৎ করতে পারলাম না। সাক্ষাতে কথা হলে হয়তো বুঝতে পারতাম উনি কি আসলেও ডাক্তার নাকি ভুয়া ডিগ্রিধারী। এটা জানা খুব জরুরি ছিল।
নিজের স্ট্যাটাসেই এক কমেন্টে ড. আমিনুল ইসলাম লেখেন, নিজ অপকর্মের পক্ষে যুক্তি দিয়ে সাফাই গাওয়ার বদ অভ্যাস আমাদের চিরন্তন। মেডিনোভার director সে স্বভাবটারই জানান দিয়ে গেলেন। যেন দ্বিমুখী ডিগ্রির ব্যাপারটা ছাড়া আর কোনো অসামঞ্জস্য তার চোখে পড়ে নাই। এসব ফেইক বিশেষজ্ঞদের পুষলে মেডিনোভাদের অনেক লাভ। তাদের দিয়ে ইচ্ছামতো investigation লিখিয়ে রোগীদের গলা কাটানো যায় যা নৈতিকভাবে শক্তিশালী চিকিৎসকদের দ্বারা করানো যায় না। জেনেশুনে ভুয়া ডাক্তার পুষে উনারা ভাব নেন enquiry করে দেখবেন।
মইনুল বিপ্লব নামে এক লেখক কমেন্টে লেখেন, কোনো রিঅ্যাক্ট দিলাম না কারণ বিষয়টা জানি না। এটুকু বুঝেছি যে তিনি দুটো অন্যায় করেছেন, নিজে যা নন তা প্রচার করে যাচ্ছেন সেইসাথে তিনি নিজের সম্পর্কে এমন কিছু প্রচার করেছেন যেটা আসলে কারো পক্ষে অর্জন করা মোটামুটি অসম্ভব এদেশে- মানে তিনি তামাম সবাইকে বোকা ভাবছেন।
কমেন্টে তিনি আরো লেখেন, প্রথম অন্যায়টার চাইতে দ্বিতীয় অন্যায়টা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা তিনি ভাবছেন তার স্বগোত্রের লোকজনও বিষয়টা ধরতে পারবেন না। যদি তারা স্বজ্ঞানে বিষয়টা এড়িয়ে গিয়ে থাকেন তবে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হওয়া উচিৎ। অন্যদিকে তারা নিজেরাই যদি সেটা না জানেন তবে তাদের উচিৎ জনগণকে জরিমানা দিয়ে এই ব্যবসার ইতি টানা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন