উলিপুর উপজেলার ১৩টি ও চিলমারী উপজেলার ৪টি ইউনিয়ন ও উলিপুর পৌরসভা নিয়ে কুড়িগ্রাম-৩ আসন। বর্তমান এমপি জাতীয় পার্টির একেএম মাঈদুল ইসলাম মুকুল। সাবেক এ মন্ত্রীর সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ নেই বললেই চলে। তার সব কর্মকাণ্ড দেখভাল করেন তার নিকট আত্মীয়রা। তাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে স্থানীয় আওয়ামী লীগ বিব্রত। এ কারণে আওয়ামী লীগ এবার আসনটি ছেড়ে দিতে নারাজ। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা এ ব্যাপারে কেন্দ্রে জোর চেষ্টা করছে। এমপি একেএম মাঈদুল ইসলাম মুকুলের আপন ছোট ভাই শিল্পপতি তাসভিরুল ইসলাম জেলা বিএনপির সভাপতি। তিনি যে কোনো মূল্যে এ আসনটি দখলে নিতে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। পৃথক নির্বাচন হলে এ আসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির ত্রিমুখী লড়াই হবে। আর জোটগতভাবে নির্বাচন হলে মহাজোটের প্রার্থী একেএম মাঈদুল ইসলাম মুকুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি তার আপন ছোট ভাই শিল্পপতি তাসভিরুল ইসলামের। সে ক্ষেত্রে দেখা যেতে পারে সহোদর দু’ভাইয়ের ভোটযুদ্ধ।
মাঈদুল ইসলাম মুকুল ১৯৭৯ সালে বিএনপি থেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন। এরপরে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত হন এবং মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ছিলিন। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হন আমজাদ হোসেন তালুকদার। ১৯৯৬ সালে এ আসনটি জাতীয় পার্টি পুনরুদ্ধারে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছোট ভাই মোজাম্মেল হোসেন লালু প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হন। ২০০১ সালে মাওলানা মতিয়ার রহমান লাঙ্গল নিয়ে বিজয়ী হন। এরপর আবারো মাঈদুল ইসলাম মুকুল জাতীয় পার্টিতে ফিরলে তিনি ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত এমপি একেএম মাঈদুল ইসলাম মুকুল আবারো জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পাবেন বলে অনুসারীদের নিশ্চয়তা দিলেও মনোনয়নের প্রতিযোগিতায় তার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী সনিক প্রাইম গ্রুপের চেয়ারম্যান ডা. আক্কাস আলী। জাপার কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবু তাহেরও (এটি) মাঠে পড়ে আছেন মনোনয়নের আশায়। দীর্ঘদিন ধরে উলিপুর জাতীয় পার্টিতে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। পাল্টাপাল্টি কমিটি ও অফিসের কারণে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়েছে। এমপি একেএম মাঈদুল ইসলাম মুকুল এলাকায় আসেন কালেভদ্রে। বিশেষ করে ভয়াবহ বন্যায় তিনি এলাকায় না এসে প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করে সমালোচনায় পড়েন। এ ছাড়া টিআর-কাবিখা ও বিভিন্ন নিয়োগে তিনি মূলত তার ভাই শফিকুল ইসলাম দারার মাধ্যমে তার কর্মকাণ্ড চালান। এমপির ডিও লেটার নিতেও দিতে হয় টাকা। এসব ক্ষেত্রে দারার বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। দুর্নীতি, আত্মীয়করণ এবং দল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় নেতৃত্ব এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। যা প্রকারান্তরে তার ইমেজের বিরুদ্ধে যায়। জাপা এককভাবে নির্বাচন করলেও ভোটের মাঠে তিনি ফ্যাক্টর হতে পারবেন না জেনে ইমেজ সংকটে খাবি খাওয়া মাঈদুল ইসলাম মহাজোটের মাধ্যমে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টায় আছেন। কিন্তু তার প্রধান বাধা স্থানীয় আওয়ামী লীগ। ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগকে পক্ষে নামাতে না পরলে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া প্রায় অসম্ভব।
ডা. আক্কাসের জনপ্রিয়তা থাকলেও তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা কোন দলের মনোনয়ন নেবেনÑ এ নিয়ে দ্বিধায় থাকেন সব সময়। তবে ইদানীং জাপা চেয়ারম্যানের সঙ্গে তার সখ্য ও বন্যায় এলাকায় ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতার কারণে আলোচনায় এসেছেন নতুন করে। বিত্তবান এ শিল্পপতি নির্বাচনকে ঘিরে নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন সমাজ উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছেন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। তিনি একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে সমান্তরালে চলছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করতে মাঝে মধ্যেই করছেন ডোনেশন।
সাবেক এমপি গোলাম হাবীব দুলাল জাতীয় পার্টি ত্যাগ করে ট্র–থ পার্টি নামে একটি দল গঠন করেছেন। গত নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী থাকলেও শেষ পর্যন্ত তাকে হতাশ হতে হয়। তিনি এর আগে কুড়িগ্রাম-৪ আসনের এমপি ছিলেন। তিনি চিলমারীর অধিবাসী। আগে চিলমারী কুড়িগ্রাম-৪ আসনের অন্তর্ভুক্ত থাকলেও বর্তমানে জাতীয় সংসদের সীমানা পুনর্বিন্যাসের পর কুড়িগ্রাম-৩ আসনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চিলমারীর অধিকাংশ এলাকা। গোলাম হাবীব দুলাল ২০০৯ সালে কুড়িগ্রাম-২ আসনে এরশাদের ছেড়ে দেয়া আসনে উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। কুড়িগ্রাম-৩ ছাড়াও তার আগের আসন কুড়িগ্রাম-৪ আসনে নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি প্রধান বন রক্ষক থাকা অবস্থায় এবং পরবর্তী সময়ে এমপি নির্বাচিত হয়ে এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, ব্যাপক উন্নয়ন, স্কুল-কলেজের এমপিও করানোয় নিজস্ব ভোট ব্যাংক রয়েছে। সহজ-সরল মানুষ হিসেবে আছে জনপ্রিয়তা।
গোলাম হাবীব দুলাল বলেন, ‘এরশাদ সাহেবের নীতি ও আদর্শের সঙ্গে একমত না হওয়ায় তার দল ত্যাগ করেছি। নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক গণসংযোগ করছি। মানুষের ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছি।’ তিনি প্রতিবারই ভোট এলে মাঠে সরব থাকেন।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে উলিপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতি শিউলীর অবস্থান বেশ শক্ত। এ ছাড়া চিলমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী (বীর বিক্রম), অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এমএ মতিন, সাবেক এমপি আমজাদ হোসেন তালুকদার মনোনয়ন প্রত্যাশী বলে শোনা যাচ্ছে। ২০০৮ সালে অধ্যক্ষ নাসিমা বানু (অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এমএ মতিনের স্ত্রী) ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে মতি শিউলি দলের মনোনয়ন পেলেও মহাজোটের কারণে মাঈদুল ইসলামকে আসনটি ছেড়ে দিতে হয়। এবারো মতি শিউলী মনোনয়নের জন্য জোর লবিং করছেন কেন্দ্র পর্যন্ত। পাশাপাশি মাঠ দখলে রাখতে চষে বেড়াচ্ছেন। তবে অন্য প্রার্থীরাও ছাড় দিতে নারাজ। তা ছাড়া গত কয়েক বছরে দলীয় কোন্দলের কারণে নেতাকর্মীদের মাঝে বিভক্তি প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। ছাত্রলীগ ও যুবলীগে প্রকাশ্য কোন্দলে মাঝে মধ্যেই সংঘাতের ঘটনাও ঘটছে। এমনকি জাতীয় শোক দিবসেও ছাত্রলীগের দু’গ্রুপে সংঘর্ষ ঘটেছে। বহিষ্কৃত হয়েছেন কয়েকজন। তারপরও নেতৃত্ব মতি শিউলীর কব্জায়। যদিও এখানকার কোন্দল অনেক পুরনো। তারপরও একজন নারী হয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব দখল করায় বিরোধীরা এখনো মেনে নিতে পারেনি।
চিলমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী সরকারের (বীর বিক্রম) চিলমারীসহ বিভিন্ন এলাকায় জনপ্রিয়তা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে শওকত আলী সরকার (বীর বিক্রম) বলেন, ‘নির্বাচনী এলাকায় আমার ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকে মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে ছিলাম। ব্যাপক উন্নয়নের অংশীদার আমি। তাই দলীয় মনোনয়ন পেলে আমার বিজয় সুনিশ্চিত।’
অপরদিকে মতি শিউলী বলেন, ‘আমাদের সরকার নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী। তৃণমুল থেকে উঠে এসে আমি উলিপুর উপজেলার আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সভাপতি। একমাত্র আমিই নির্বাচনমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছি। নিরন্তরভাবে মাঠে পড়ে থেকে মানুষের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়ে কাজ করছি। সরকারের উন্নয়নমূলক কাজে সহযোগিতা করছি। প্রচার করছি সরকারের উন্নয়ন ও ভালো কাজের। তাই আশা করি মনোনয়ন পাব।’
দলের কোন্দল সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করার সুযোগ নেই। মনোনয়ন পেলে সবাই দলের প্রার্থীর পক্ষেই একাট্টা হয়ে কাজ করবেন।’ তিনি আরো জানান, বারবার জাতীয় পার্টিকে আসনটি ছেড়ে দেয়ার কারণে নেতাকর্মীদের ধরে রাখা কঠিন হয়ে গেছে। সরকারে থেকেও বিরোধী দলের মতো মনে হয়। তাই নেত্রীর কাছে দলের পক্ষ থেকে আসনটি দাবি করা হবে।
উলিপুরের রাজনীতিতে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির অধিকারী অধ্যক্ষ নাসিমা বানু এক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর তার স্বামী অধ্যাপক এম এ মতিন একটা গ্রুপকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এবার দলের মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট আশাবাদী। এম এ মতিন বলেন, ‘মাঈদুল ইসলাম উলিপুরের উন্নয়নের প্রধান প্রতিবন্ধকতা। এই প্রতিবন্ধকতা অবসানের জন্য উলিপুরবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তিনি জনপ্রতিনিধি হয়ে জনগণের হক নষ্ট করেছেন। দাম্ভিকতা দেখিয়ে জনগণকে দাবিয়ে রেখে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করেছেন। তাই সুযোগ পেলে এই অসৎ ও অথর্ব নেতৃত্বকে হটিয়ে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই।’
বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে জেলা বিএনপির সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য তাসভিরুল ইসলাম ছাড়াও ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল খালেক মনোনয়ন চাইবেন। তবে তাসভিরুল ইসলামের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি। উলিপুর উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী জয়লাভ করায় সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন তিনি। তার ওপর তার আপন ভাই ও বর্তমান জাতীয় পার্টির এমপি মাঈদুল ইসলাম মুকুলের গণবিচ্ছিন্নতা তার জন্য প্লাস পয়েন্ট হতে পারে। মাঈদুল ইসলাম মনোনয়ন পেলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কতটা আন্তরিক হয়ে কাজ করবেনÑ তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাসভিরুল ইসলাম কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবেন। ব্যক্তিগতভাবে গত বন্যায় বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়ে তাসভিরুল ইসলাম সবার দৃষ্টি কাড়েন। রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠা শিল্পপতি তাসভিরুল ইসলাম অথবা সাবেক মন্ত্রী একেএম মাঈদুল ইসলাম মুকুল যে দল থেকেই প্রার্থী হোক না কেন ভোটের রাজনীতিতে ফ্যাক্টর তারা। তাদের পারিবারিক ভোট ব্যাংক রয়েছে। এ ছাড়া তাদের শিল্প-কলকারখানায় স্থানীয় অনেকের চাকরি দেয়ায় জনসমর্থন রয়েছে।
সাবেক মন্ত্রী মাঈদুল ইসলাম মুকুল বলেন, ‘২০০৮ সালে এক লাখ ৮৯ হাজার ভোট পেয়ে বিজয়ী হই। আমাকে এলাকার সবাই চেনে এবং ভালোবাসে। দীর্ঘদিন জনপ্রতিনিধি হিসেবে যতটুকু কাজ করা প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশি করেছি। আশা করি সেই বিবেচনায় মানুষ আমাকে আবারো ভোট দিয়ে বিজয়ী করবে। দলের সিনিয়র হিসেবে আশাবাদী দল আমাকে মনোনয়ন দেবে। আর জোটগতভাবে নির্বাচন হলে বিজয় নিশ্চিত। বর্তমানে দলের সাংগঠনিক অবস্থা মোটামুটি ভালো। আমার শরীরটা ভালো নেই তাই এলাকায় খুব একটা যেতে পারছি না। একটু সুস্থ হলে এলাকায় গণসংযোগে নামব।
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন