১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। লাখো মানুষের সঙ্গে রেসকোর্স ময়দানে যান ঢাকা কলেজ থেকে সদ্য স্নাতক শেষ করা টগবগে তরুণ আব্দুস সাত্তারও। বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণ শুনে রাজনীতিবিমুখ সাত্তারের শরীরের রক্ত টগবগ করে উঠে। দেশ স্বাধীনের শপথ নেন। অস্ত্র হাতে সাত্তার ছুটে যান যুদ্ধের ময়দানে।
দেশ স্বাধীন হল। সাত্তার বিজয়ীর বেশে ফিরলেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। স্বাধীন দেশে শুরু হল সাত্তারের আরেক যুদ্ধ, জীবনযুদ্ধ। দেশকে শত্রুমুক্ত করার যুদ্ধে জিতলেও জীবনযুদ্ধে আর জিততে পারেননি সাত্তার। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর অকুতোভয় যোদ্ধা সাত্তারের হাতে এখন ভিক্ষার ঝুলি।
নগরীর বাদশা মিয়া রোড, মোহাম্মদ আলী রোড, গোলপাহাড় কিংবা জিইসি মোড়ে গেলে দেখা মেলে সাত্তারের। ব্যস্ত এই শহরের ব্যস্ত নাগরিকদের ছুটে চলা কখনো কখনো এই এলাকায় এসে একবার থেমে যায়, যানজটে আটকা পড়া বিলাসী গাড়ির জানালাও কখনো কখনো একটু ফাঁক হয়।
ব্যস্ত নাগরিকরা দেখেন, বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এক দীর্ঘকায় মানুষ দীর্ঘ এক লাঠিতে ভর দিয়ে ভিক্ষার ঝুলি হাতে দাঁড়িয়েছেন তাদের সামনে। চাহনি, অভিব্যক্তি আর ভাষায় ‘দুইটা টাকার’ জন্য কাতর মিনতি।
সাত্তারের বয়স এখন ৭০। তবে ক্ষুধা আর যাপিত জীবনের যন্ত্রণার ছাপ পড়েছে মুখের বলিরেখায়। পাঞ্জাবির সঙ্গে লুঙ্গি, মাথায় টুপি, সাদা শ্মশ্রুমন্ডিত মানুষটিকে দেখে মনে হয় বয়স আশির কোঠা পেরিয়েছে। প্রায় আড়াই দশক ধরে ভিক্ষা করে চলা মানুষটিকে সেই এলাকায় চেনেন অনেকেই। এভাবেই ভিক্ষা করে কাটে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তারের। ছবি: বাংলানিউজতাদের সূত্রেই বৃহস্পতিবার (১৪ ডিসেম্বর) বাংলানিউজের সঙ্গে দেখা সাত্তারের। ফুটপাতে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর প্রথমে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। রাজি করানোর পর মেলে ধরলেন যুদ্ধদিনের স্মৃতি।
সাত্তার মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার বয়রা গ্রামের মৃত সুলতান আহমেদের ছেলে। জাহাজের সারেং ছিলেন বাবা। তিন বছর বয়সে মা এবং সাত বছর বয়সে বাবাকে হারান সাত্তার। এক চাচা ছিলেন, সম্পদ আত্মসাতের জন্য তিনি সাত্তারকে ঘর থেকে বের করে দেন। প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র সাত্তার এক কাপড়ে চলে যান ঢাকায়। সেখানে এক রেলস্টেশনে বিত্তশালী নিঃসন্তান এক নারী সাত্তারকে আশ্রয় দেন। মোহাম্মদপুর বয়েজ হাইস্কুল থেকে মেট্রিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯৬৮ সালে বিএ পাশ করেন সাত্তার।
‘শেখের ছেলের কামাল আমার এক বছরের জুনিয়র ছিল। আমাদের কলেজে মিজানুর রহমান চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ এসেছিলেন। আমি তাদের সঙ্গে মিছিল করেছি। কিন্তু আমি কোনদিন রাজনীতি করিনি। শেখ সাহেবের সাতই মার্চের ভাষণ শুনেই আমি সিদ্ধান্ত নিই যুদ্ধে যাব। ’এভাবেই ভিক্ষা করে কাটে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তারের। ছবি: বাংলানিউজ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল টাঙ্গাইলের মধুপুরের গড়পাহাড় হয়ে ভারতের মেঘালয়ে পৌঁছান সাত্তারসহ ১৩ যুবক, যাদের মধ্যে কয়েকজন ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। ভারতের সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন এস কে সিংয়ের কাছে ১ মাস ১৬দিন প্রশিক্ষণ শেষে আবারো মধুপুর দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেন সাত্তারসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা। মধুপুরে এসে দেখা হয় বীর যোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে।
‘আমরা কাদের সিদ্দিকী সাহেবের কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দিইনি। আমরা ছিলাম ১১ নম্বর সেক্টরে। আমাদের ইউনিট কমান্ডার ছিলেন খোকা ভাই। আমাদের টিম যুদ্ধ করে মধুপুর থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করি। এরপর আমরা ১৩ জন ঢাকার আশুলিয়ায় চলে আসি। আমার হাতে থাকত রাশিয়ার একটি এসএলআর, ১৮ রাউন্ড গুলি। আশুলিয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ক্যাম্পে আমরা হামলা করি। সেখানে আমাদের দুজন যোদ্ধা মন্টু ভাই আর নাজমুল শহীদ হন। ’১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। আশুলিয়া থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায় পৌঁছান সাত্তারসহ সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধারা। এরপর শুরু হয় সাত্তারের আরেক যুদ্ধ।এভাবেই ভিক্ষা করেছেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তারের। ছবি: বাংলানিউজমুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই সাত্তারের পালক মা মারা যান। যুদ্ধ শেষে ফেরার পর পালক মায়ের স্বজনরা সাত্তারকে আর ঘরে জায়গা দেননি। ১৯৭৭ সালে টঙ্গীতে একটি ফেব্রিক্স কোম্পানিতে চাকরি নেন সাত্তার। ১১ বছর পর ৮৮ সালে ঢাকায় এক মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন তিনি। প্রাণে বেঁচে গেলেও চাকরি হারান।
‘চাকরি হারানোর পর অনেকের কাছে গেছিলাম। কেউ চাকরি দেয়নাই। হেমায়েতউল্লাহ আওরঙ্গ, একসাথে যুদ্ধ করছিলাম। তার কাছেও গেছিলাম, পাত্তাও দেয়নাই। তোফায়েল সাহেবের কাছে একবার গেছিলাম। উনিও কিছু করতে পারেন নাই। আমি তো এতিম। তিনকূলে কেউ নাই। বিয়েও করিনাই। ৯২ কি ৯৩ সালে চট্টগ্রামে চলে আসি। অনেকটা অভিমানেই চট্টগ্রামে চলে আসেন সাত্তার। সেই থেকে নগরীর দামপাড়ায় গরীবউল্লাহ শাহ’র মাজারের কাছে ফুটপাতে অথবা গরম বিবির মাজারে ঠাঁই এই মুক্তিযোদ্ধার। পথচারী, দোকান-হোটেল থেকে চেয়েচিন্তে খেতে খেতে এখন হাতে ভিক্ষার ঝুলি। দিনে ১২৫ টাকার ওষুধ লাগে তাঁর। ভিক্ষা করে ২০০ টাকার মতো জোগাড় করতে পারলে দিন চলে যায়, এমনটাই জানালেন তিনি।
যুদ্ধ করে যে দেশটাকে স্বাধীন করেছেন, সেই দেশ কি দিয়েছে এই মানুষটিকে?
তাঁর জবাব, ‘আমি যুদ্ধ করেছি কিছু পাবার জন্য নয়। আমার চোখের সামনে অনেকে লুটপাট করেছে। চাইলে আমিও পারতাম। করিনি। সেজন্য কারো কাছে আমার ঠাঁই হয়নি। ’
ব্যস্ত রাস্তায় একটু থামলেই পাঁচ-দশ টাকা পাওয়ার আশায় গাড়ির কাছে যান সাত্তার। ছবি: সোহেল সরওয়ার বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন সাত্তার, ‘আই লাভ মাই কান্ট্রি ভেরি মাচ। নেভার আই ক্যান বিট্রে উইথ হার। ’
দুই মাস আগে ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন ‘পে ইট ফরওয়ার্ড বাংলাদেশ’র প্রতিষ্ঠাতা লেখক বাদল সৈয়দকে এই ভিক্ষুক মুক্তিযোদ্ধার ছবি তুলে ম্যাসেঞ্জারে পাঠান একজন। বাদল সৈয়দ সংগঠনের সদস্য ও মেডিকেল এলাকার ওষুধ ব্যবসায়ী কুতুবের মাধ্যমে সাত্তারকে খুঁজে নেন। সিঙ্গাপুর প্রবাসী একজনের মাধ্যমে প্রতিমাসে সাত্তারকে তিন হাজার টাকা করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
বাদল সৈয়দ বাংলানিউজকে বলেন, সাত্তার সাহেবের মুখে সব শুনে আমি নিজেই লজ্জায় পড়ে যাই। যে মানুষটা মুক্তিযুদ্ধ করে আমাদের এই দেশ দিয়েছেন, তাকে পেটের দায়ে ভিক্ষা করতে হবে, এর চেয়ে লজ্জার আর কি থাকতে পারে! আমি উনার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে ভাতার জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। আমি সবাইকে এই অসহায় মুক্তিযোদ্ধার পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ করছি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন