আজ ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এইদিনে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের নয় মাসের যুদ্ধের অবসান ঘটে।
যুদ্ধের নয় মান ঢাকায় বসবাস করতেন তখনকার মেডিকেল কলেজের ছাত্রী এবং বর্তমানে অধ্যাপক নাজমুন নাহার। বিজয়ের সে দিনটি তিনি দেখেছেন। কেমন ছিল বিজয়ের মুহূর্ত?
বিবিসি বাংলার সাথে এসব নিয়ে কথা হয় অধ্যাপক নাজমুন নাহারের সাথে। তিনি বলেন, তখন আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নশিপ করছিলাম। আমরা খুব একটা রাস্তা ঘাটে বের হতে পারতাম না। হাসপাতালের গাড়ি দিয়ে যাতায়াত করতাম। আমার বাসা ছিল খুব সংকটপূর্ণ জায়গায়, ঠিক মেডিকেলের পেছনে শহীদ মিনারের সাথে বকশিবাজার এলাকায়। ৯ মাস রাস্তায় হাঁটতে বের হতে পারিনি। গাড়িতেই যাওয়া-আসা করেছি।
তিনি বলেন, ১৬ ডিসেম্বরের আগের ক’দিন যখন ঘন ঘন প্লেন এর আসা যাওয়া হচ্ছে। আমরা উৎসাহিত হয়েছিলাম, বিজয়ের দিকে যাচ্ছি। আমি আমার বাসায় গিয়ে ইচ্ছে করেছিল প্লেনগুলোকে ওয়েলকাম জানাতে। তারপর ১৬ ডিসেম্বর আমার মনে আছে, আমি ও আমার ভাই গাড়ি নিয়ে বের হই। আমরা ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়াই, সাথে আমার কয়েকজন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের বন্ধু ছিল। উনারা কখনো হাসপাতাল থেকে বের হতেন না। আমার ভাইয়ের বড় ভাইয়ের বন্ধুকে দেখেছি, আমাদের বাসায় আসতে। তার কাঁধে রিভলবার উস্কখুস্ক অবস্থায় থাকত। সে এসে আমাকে বলেছে, তাড়াতাড়ি তাকে খেতে দেওয়ার জন্য। এইমাত্র এসেছে ঢাকায়। ৯ মাসের মধ্যে সেদিন ১৬ ডিসেম্বর আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে দৌঁড়ে শহীদ মিনারে গিয়েছি।
বিজয়ের খবর শুনে যখন রাস্তায় বেরিয়ে ছিলেন তখন ঢাকা শহরের অবস্থা কেমন ছিল?
নাজমুন নাহার বলেন, আমাদের মা-বাবা মানা করে দিয়েছিল যার ফলে আমরা সেদিন বেশি দূর যেতে পারিনি। আমরা ঢাকা মেডিকেল থেকে হলি ফ্যামিলি পর্যন্ত শাহবাগের মোড় দিয়ে যাওয়া আসা করছিলাম। তখন কিন্তু কিছু ট্যাংক, ইন্ডিয়ান আর্মি আর জিপে করে ঘুরছে, এগুলো দেখেছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধা যারা ছিলেন তারা খুশির চোটে পতাকা ওড়াচ্ছে- এটা রাস্তায় দেখেছি ।
তখন এ ৯ মাস অনেকটা অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলেন। ঢাকা শহরে যারা ছিলেন অনেকেই সীমিতভাবে চলাফেরা করেছেন। বন্দীদশায় অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে যখন মুক্তি পেলেন তখন আপনার কেমন মনে হলো? কখনো কি ভেবেছিলেন এত দ্রুত এটার অবসান ঘটবে?
এমন প্রশ্নের জবাবে নাজমুন নাহার বলেন, এত দ্রুত অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত হব কখনো বুঝতে পারিনি। ঢাকা মেডিকেলের পিছনে রেডিও চালিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে খবর শুনতাম, বাইরে যেন আওয়াজ না যায় সে জন্য। আমরা পরের দিকে ঢাকায় বসে ভেবেছি বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।
যখন ভারতীয় বাহিনী ঢাকা শহরের ওপরে বিমান আক্রমণ শুরু করেছিল, তখন অনেকেই খুশি হয়েছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হবে ভেবে। আবার অনেকে শঙ্কায় ছিল শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ কোনদিকে মোড় নেয়, এ প্রসঙ্গে নাজমুন নাহার বলেন, যখন ইন্ডিয়ান আর্মির প্লেন আমাদের এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করছিল তখন আমরা ছাদে দাঁড়িয়ে দেখতে পারছিলাম। পিজি হাসপাতালে তখন আমি চাকরি করতাম। শাহবাগের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন দেখতাম তখন আমাদের বড় প্রফেসর যারা ছিলেন তারা খুশি হয়েছেন দেশ স্বাধীন হবে এটা নিশ্চিত জেনে।
১৬ তারিখ সকালবেলা যখন ঘুম থেকে উঠলেন তখন কি মনে হচ্ছিল, দেশ স্বাধীন হচ্ছে বা হয়ে গেছে?
নাজমুন নাহার বলেন, আমরা ১৫ তারিখ রাতে কিছুটা বুঝতে পেরেছিলাম দেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে। সেদিন ১৬ তারিখই নিজেদের গাড়ি নিয়ে আমি ও আমার ভাই বের হয়েছি।
৪৭/৪৮ বছর আগের কথা, এখন যদি পেছনের দিকে তাকান তখন বাংলাদেশের বিজয়ের সে মূহুর্তটা আপনার কাছে কেমন মনে হয়? কী অনুভতি হয়?
এমন প্রশ্নের জবাবে নাজমুন নাহার বলেন, সে সময় যেগুলো দেখেছি তা এখনো আমার মনে আছে। প্রতিদিন আমরা যারা ঢাকায় নিজ চোখে যুদ্ধ দেখেছিলাম তারাও মুক্তিযোদ্ধা। যারা যুদ্ধ করতে গেছে তারাও মুক্তিযোদ্ধা। সেদিনের সেগুলো যদি লিখে রাখতাম খুব ভালো স্মৃতি থাকত। এখন আর মনে নেই তারপরেও আমি চেষ্টা করছি কিছু কিছু পয়েন্ট লিখে রাখার।
সূত্র – বিবিসি বাংলা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন