শিক্ষাখাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টদের ৩৯টি সুপারিশ দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব সুপারিশে প্রশ্নপত্র ফাঁস, নোট বা গাইড, কোচিং বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ, এমপিওভুক্তি, নিয়োগ ও বদলিসহ বিভিন্ন দুর্নীতির উৎস এবং তা বন্ধের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে গঠিত ‘শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানিক টিম’র অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ উল্লেখ করা হয়েছে। বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) দুদকের সচিব ড. মো. শামসুল আরেফিনের স্বাক্ষর শেষে এসব সুপারিশ মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে পাঠানো হয়।
উল্লেখ্য,‘শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানিক টিম’ এর প্রধান ছিলেন দুদকের পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন ও টিমের সদস্য ছিলেন সহকারী পরিচালক মো. হাফিজুর রহমান ।
প্রশ্নপত্র ফাঁস
পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে আটটি সুপারিশ করেছে দুদক। তাদের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে ‘অদ্ভুত অন্ধকার’ গ্রাস করতে যাচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মকে। পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমেই রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে কিশোরদের প্রথম পরিচয়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে সেখানেই তাদের পরিচিতি হচ্ছে পঙ্কিল দুর্নীতির সঙ্গে। পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস দুর্নীতির নতুন সংযোজন।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ সরকারি প্রেস (বিজি প্রেস), ট্রেজারি এবং পরীক্ষা কেন্দ্র। এছাড়া, এসব প্রতিষ্ঠানের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে কোচিং সেন্টার, প্রতারক শিক্ষক ও বিভিন্ন অপরাধী চক্র।
এ খাতে সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটিতে মেধাবী, সৎ এবং মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষক বাছাই করা; প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটিতে একজন ইংরেজি অনুবাদক নিয়োগ; প্রশ্নপত্র প্রণয়ন থেকে বিতরণে সংশ্লিষ্টদের অঙ্গীকারনামা নেওয়া, যাতে উল্লেখ থাকবে- তাদের সন্তান কিংবা পোষ্য সংশ্লিষ্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন না; প্রশ্নপত্র প্রণয়ন সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত মডারেটরসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কঠোর নজরদারিতে রাখা; ডবল লক সংবলিত বাক্সে প্রশ্নপত্র পাঠানো। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রশ্নপত্র কেন্দ্রে পাঠানো,প্রশ্ন খোলা হবে জেলা প্রশাসকের ও উপজেলা কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে; পরীক্ষা কেন্দ্রের সংখ্যা যতদূর সম্ভব কমিয়ে আনা; প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত অপরাধীদের বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষা আইন, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা করা যেতে পারে এবং শিক্ষা সংক্রান্ত সব কাজ অনলাইন সার্ভিসের আওতায় নিয়ে আসা।
কোচিং এবং নোট-গাইড বাণিজ্য
কোচিং ও নোট-গাইড বাণিজ্য বন্ধে আটটি সুপারিশ করেছে দুদক। আর এ খাতে দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে- শ্রেণি কক্ষে ঠিকমতো পাঠদান না করা, পাঠ্য পুস্তক, কোচিং মালিক এবং কতিপয় শিক্ষকের অবৈধভাবে স্বল্প সময়ে সম্পদ অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা, শিক্ষা কার্যক্রম মনিটরিংয়ের অভাব, অভিভাবকদের অসচেতনতা ইত্যাদি।
সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে-শ্রেণিকক্ষে পাঠদান নিশ্চিত করতে মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা মনিটরিং কমিটি গঠন, সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বদলির নীতিমালা অনুসারে বদলি নিশ্চিত করা, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকরা স্ব-স্ব বিষয়ের বাইরে কোনও ক্লাস নিতে পারবেন না, পরীক্ষায় বহু নির্বাচনি প্রশ্নপত্র সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া এবং এর বদলে বর্ণনামূলক, সৃজনশীল এবং বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, সরকার প্রণীত কোচিং নীতিমালার বাইরে যেসব শিক্ষক কোচিং করাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা, কোচিং সেন্টার বন্ধ করা, ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই সব নোট-গাইড প্রকাশনা সংস্থায় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করা এবং শিক্ষক, অভিভাবক ও স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির মধ্যে নিয়মিত মাসিক সভার আয়োজন করা।
এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়ম বহির্ভূত নিয়োগ, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মনগড়া বিভিন্ন খাত সৃষ্টি করে অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ বিভিন্ন অনিয়ম বন্ধে দুদকের পক্ষ থেকে পাঁচটি সুপারিশ করা হয়েছে। এই পাঁচটি সুপারিশ হলো- জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে মন্ত্রণলায়ের নির্দেশ অনুসারে প্রচলিত সব নিয়মাবলী অনুসরণ করে প্রতি বছর নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পিএসসি’র আদলে কমিশন গঠন করা প্রয়োজন; জাল সার্টিফিকেটে যারা চাকুরি নেয়, তাদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ ও নিয়োগের সময় আরও সতর্ক থাকা; মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের নিয়মিত বদলী ও পদায়ন করা; নতুন স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নীতিমালার যথাযথ অনুসরণ এবং শিক্ষকদের পেনশন প্রাপ্তিতে তাদের আবেদনের সঙ্গে সঙ্গেই তাদের পেনশন প্রাপ্তির দিন-ক্ষণ জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ, কোনও অবস্থাতেই সিরিয়াল ভঙ্গ না করা।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)
প্রতি বছর ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় নতুন বই। এই কাজে বেশ কিছু স্তরে দুর্নীতি হয়। আর এসব দুর্নীতির উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে-পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের টেন্ডার প্রক্রিয়া, বিভিন্ন কমিটি গঠন, পাঠ্য বইয়ের পাণ্ডলিপি কতিপয় প্রকাশকের কাছে অননুমোদিতভাবে সরবরাহ, অবৈধ কোচিং বাণিজ্য প্রসারের জন্য বইয়ে তথ্য সংক্ষিপ্তকরণ, স্বনামে-বেনামে টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ ইত্যাদি।
পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে পাঁচটি সুপারিশ করেছে দুদক। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-এনসিটিবি’র সব টেন্ডারে ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়া অনুসরণ করা, লেখক কমিটি, শিক্ষা উন্নয়ন কমিটি ও টেকনিক্যাল কমিটিতে মেধাবী ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ, শিক্ষাক্রম ও পাণ্ডুলিপি প্রণয়নের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন, বইয়ের পাণ্ডুলিপি এনসিটিবি প্রেস থেকে নোট-গাইড প্রকাশকদের কাছে যেন না যায়, সেটা নিশ্চিত করা এবং পাঠ্যপুস্তকে তথ্য চরমভাবে সংকুচিত করা হয়েছে, তাই সব পাঠ্যবইয়ে সমাধানসহ নমুনা প্রশ্ন সংযোজন করা প্রয়োজন।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর
অতিরিক্ত ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাসহ আটটি বিষয়ে সুপারিশ করেছে দুদক। এতে বলা হয়েছে, ই-টেন্ডারিং এর মাধ্যমে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা, নির্মাণ কাজ মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে স্থানীয় শিক্ষক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নাগরিক কমিটি গঠন,যে সব কর্মকর্তা নামে-বেনামে ঠিকাদারী কাজের সঙ্গে জড়িত, তাদের তালিকা তৈরি করে বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ ফৌজদারি মামলা দায়ের করা, নির্মাণ কাজে মন্ত্রণালয় থেকে মনিটরিং টুলস প্রয়োগ করা, প্রয়োজনে দুদকের সহযোগিতা গ্রহণ করা, মেরামত কাজের বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে যে সব প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো মেরামত বা সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে, সে সব প্রতিষ্ঠান প্রধানের প্রত্যয়নপত্র ছাড়া বিল পরিশোধ করা যাবে না মর্মে সার্কুলার জারি, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের অভ্যন্তরীণ মনিটরিং যেমন পরিদর্শন, অডিটিং ও রিপোর্টিং কার্যকর করা এবং জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা বা তার ইউনিট মনিটরিং কার্যক্রম সমন্বয় করতে পারেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়
এ বিষয়ে দুদকের পর্যবেক্ষণ বলা হয়েছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কোন পথে পরিচালিত হবে, তার নিয়ন্ত্রক শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই মন্ত্রণালয়ের ঈর্ষণীয় সাফল্য থাকলেও বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস, কোচিং বাণিজ্যের প্রসার, নোট-গাইডের ব্যাপক প্রচলন, শিক্ষক বদলি ও পদায়নসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন পর্যায়ে নেতিবাচক আলোচনায় মন্ত্রণালয়ের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি দমন কমিশন এর আইন ও সরকার কর্তৃক প্রণীত জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে শুদ্ধাচার বিকাশে ছয়টি সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয় নির্দেশমালা ২০১৪ অনুসরণ করে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কার্য সম্পাদন নিষ্পত্তিকরণ- নথি নিষ্পত্তি যথাযথ উপায়ে সম্পন্ন করা, যারা নথি আটকে রেখে দুর্নীতির পথ সৃষ্টি করে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠান প্রধান বা গ্রেড-৩ থেকে গ্রেড-১ পর্যন্ত পদগুলো ছাড়া অন্যান্য পদের বদলি ও পদায়ন সংশ্লিষ্ট অধিদফতর বা বিভাগীয় কার্যালয়ের ওপর অর্পণ করা যেতে পারে, এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় বদলি ও পদায়ন নীতিমালার আলোকে এসব কার্যক্রম মনিটরিং করা যেতে পারে; বিভিন্ন প্রকল্পের গাড়ি অবৈধভাবে ব্যবহার বন্ধে মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেওয়া;
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত প্রকল্পগুলোর বিভিন্ন ক্রয়, গাড়ি ব্যবহার, অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ, প্রশিক্ষণের নামে অর্থ ব্যয়ে অনিয়মের যে সব অভিযোগ রয়েছে, তা দূরীকরণের উদ্যোগ প্রয়োজন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুসারে সনদপত্রের শর্তপূরণে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং শিক্ষা সংক্রান্ত সব কার্যক্রম বন্ধ করা।
দুদক সচিব স্বাক্ষরিত চিঠিতে কমিশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি প্রতিরোধে গৃহীত সুপারিশগুলোর বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
কমিশনের সুপারিশ বিষয়ে দুদক সচিব ড. মো. শামসুল আরেফিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিক্ষাকে কোনোভাবেই বাণিজ্য হিসেবে দেখতে চায় না দুদক। বিগত ছয় মাস শিক্ষা নিয়ে কাজ করেছে কমিশন। টোটাল প্রশাসনিক সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমাধানের জন্য এ সুপারিশ করা হয়েছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে দুদক সচিব বলেন, ‘আমরা আমাদের সুপারিশগুলো মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। তারা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যদি না করে তাহলে পরবর্তীতে এ ব্যাপারে কী করা হবে কমিশন তা সিদ্ধান্ত নেবে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন