বীরত্বের সঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা পচা মিয়া এখন ভিক্ষার অর্থে সংসার চালাচ্ছেন। ৬ সদস্যের সংসার চলে তার দুঃসহ অভাব অনটনের মধ্যদিয়ে।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক মেজর জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী কর্তৃক তাকে রণাঙ্গণের একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ প্রদান করা হলেও কেন পচা মিয়ার নাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকায় স্থান পায়নি? এমন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা পচা মিয়া নিজেই।
স্বাধীনতার পর কয়েক দফায় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হলেও ভিক্ষুক হিসেবে জীবন-যাপন করা পচা মিয়ার নাম তদবিরের অভাবে কেউ তালিকাভুক্ত করেনি বলে তিনি জানিয়েছেন।
জানা যায়, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের ৫নং শুভপুর ইউনিয়নের মৃত গনু মিয়ার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা মো. পচা মিয়া। ১৯৩৫ সালের ১৫ জুন জন্ম নেয়া পচা মিয়ার বয়স এখন ৮২ বছর। ৩৬ বছর বয়সে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি ২নং সেক্টরে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসেও তিনি পাননি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক মেজর জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী কর্তৃক তাকে রণাঙ্গণের একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ (নং- ৮৩২৬৪) প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান মো. ওয়াহিদুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কুমিল্লা ইউনিটের কমান্ডার সফিউল আহমেদ বাবুল, চৌদ্দগ্রাম উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার বাবু প্রমোদ রঞ্জন চক্রবর্তী, চৌদ্দগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুস সোবহান ভূঁইয়া হাসানসহ বিভিন্ন জনের প্রত্যয়নপত্র, সুপারিশ ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকার পরও স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও তার নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়নি।
তাই তিনি আজও পাননি কোনো ভাতা বা সরকারি সহায়তা। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সপক্ষে কাগজপত্র হাতে নিয়ে জনপ্রতিনিধি, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডসহ সরকারের বিভিন্ন দফতরে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করাসহ ভাতা পাওয়ার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি।
জীবনের শেষ সময়ে এসেও তার এ সংগ্রাম অব্যাহত আছে। বয়সের ভারে ন্যুজ হত-দরিদ্র পচা মিয়া ও তার পরিবার-পরিজনের দিন কাটছে অর্থাভাবে অনাহারে-অর্ধাহারে। তার স্ত্রী বালি বিবি (৬০) নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে এখন অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় শয্যাশায়ী।
৩ সন্তানের মধ্যে ২ জন মেয়ে। একমাত্র ছেলে শ্রমিকের কাজ করে কোনো মতে তার নিজের বউ বাচ্চা নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। সামান্য আয় থেকে বাবা-মাকে দেখারও তার সাধ্য নেই। বড় মেয়ে জোসনা বেগমের বিয়ে হয়েছে একই উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের বসুয়ারা গ্রামে। কিন্তু জোসনার স্বামী আবদুর রাজ্জাক ২য় বিবাহ করে চট্টগ্রামে অবস্থান করায় এখন মেয়ের পরিবার নিয়েও পচা মিয়া দিশেহারা।
সরকার থেকে পাওয়া বয়স্ক ভাতা দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর ওষুধ কেনাও সম্ভব হয় না। দিন ব্যাপী এদিক-ওদিক হাত পেতে যা পাওয়া যায় দিন শেষে তা দিয়েই কোনো মতে চলে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা পচা মিয়ার সংসার। তবে আশার কথা হচ্ছে সম্প্রতি সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই শুরু হলে আবারও আশায় বুক বেধে যাবতীয় কাগজপত্র চৌদ্দগ্রাম উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটির লোকজনের হাতে তুলে দিয়েছেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে আশ্বাসও দিয়েছেন। তবে এখনও গেজেট হিসেবে কাগজপত্র উপজেলায় আসেনি। তাই এখনও উৎকণ্ঠা ও সংশয়ে আছেন তিনি। মৃত্যুর আগে অন্তত পচা মিয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে মরতে চান।
এ বিষয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে পচা মিয়া জাগো নিউজকে জানান, চোখের সামনে কত ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা দেখছি, যারা যুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিয়ে সরকার থেকে অনেক সুবিধা পাচ্ছে, ওসমানী থেকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ পেয়েছি ঠিক, কিন্তু স্বাধীনতার ৪৬ বছরে এসেও আমি স্বীকৃতি পাচ্ছি না। তিনি বলেন, ৭১ সালে দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজী রেখে যুদ্ধ করেছি, তখন হয়তো মরে গেলেও এতো কষ্ট পেতাম না। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মানুষের কাছে হাত পাততে গেলে কেউ কেউ খারাপ আচরণ করে, কেউবা ২/১ টাকা দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
তিনি আরও বলেন, ৭১ সালে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, এখন যুদ্ধ করছি সংসারের ঘানি টানার। জীবনের শেষ সময়ে এসে এখন দেশের কাছে কিছুই চাই না। শুধু নিজেকে একজন গর্বিত মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়ে মরতে চাই, আমি মরে গেলেও আমার স্ত্রী-সন্তানরা যেন সমাজে বলতে পারে আমি একজন গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম।
এ বিষয়ে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল হাসেম জানান, পচা মিয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি এ যাবৎ কেউ যথাযথ প্রক্রিয়ায় আমাদের নজরে না আনায় বিলম্বিত হয়েছে। তবে এ সরকারের আমলেই তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড পদক্ষেপ নিয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন