মাদক বিক্রিতে বাঁধা দেওয়ায় কেরানীগঞ্জের বাছের রনিকে খুন করা হয়। এর পর এক বছর পার হলেও খুনের প্রধান পরিকল্পনাকারী গ্রেপ্তার হননি। নিহতের স্বজন ও স্থানীয়রা বলছেন, মাদক বিক্রিতে বাঁধা দিতে গিয়ে রনি খুন হওয়ার পর তাঁর পরিবার তছনছ হয়ে গেছে, কেবল তাদেরই মূল্য দিতে হচ্ছে। কিন্তু এই ঘটনার পর এলাকায় মাদক বিক্রিও বন্ধ হয়নি, মূল আসামিও গ্রেপ্তার হয়নি।
গত বছরের ৩০ অক্টোবর খুন হন বাছের রনি। তাঁর বয়স ৩৪ বছর। তৈরি পোশাকের ব্যবসা করতেন তিনি। রনি তিন সন্তানের জনক। বাড়ি কেরানীগঞ্জের মডেল টাউন এলাকায়। তাঁর শ্বশুরবাড়ি কেরানীগঞ্জের নবাবচর গ্রামে। গত ৬ অক্টোবর সাগর নামের এক যুবক খুনের দায় স্বীকার করে ঢাকার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সাগর আদালতে বলেছেন, কেরানীগঞ্জের শাক্তা ইউনিয়নের বাসিন্দা রুবেলের নেতৃত্বে রনিকে অপহরণ করে তাঁরা কয়েকজন মিলে খুন করে।
তদন্ত কর্মকর্তা কেরানীগঞ্জ থানার পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আক্কাস মিঞা এবং নিহতের স্বজন ও স্থানীয়রা বলছেন, কেরানীগঞ্জের নবাবচর গ্রামে বাছের রনির শ্বশুরবাড়ি এলাকায় মাদক ব্যবসায় জড়িত রুবেল, হযরত ও ছটাকি বাবুল। এই এলাকার মাদক বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান রনি। এলাকায় মাদক বিক্রেতা হিসেবে পরিচিত কয়েকজনকে মাদক বিক্রি করতে নিষেধও করেন। খুন হওয়ার কয়েকদিন আগে মাদক বিক্রেতা রুবেলের সহযোগী দিপুকে মাদক বিক্রি করতে নিষেধ করে রনি। কিন্তু তারপরেও প্রকাশ্যে তাঁর শ্বশুরবাড়ির সামনের রাস্তায় মাদক বিক্রি অব্যাহত রাখে দীপু। একদিন দীপুকে মারধর করে রনি। এর জের ধরেই মূলত রনিকে খুন করা হয়।
ঘটনার দিন গত ৩০ অক্টোবর রনি সকাল ১১টার দিকে তাঁর শ্বশুরবাড়ি যান। সেখানে থাকা স্ত্রী ডলি আক্তারের সঙ্গে দেখা করে তিনি যখন দুপুরে কেরানীগঞ্জের শিকারীটোলা রাস্তার সামনে আসেন তখন চারজন যুবক তাঁকে জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে রনির মুঠোফোন বন্ধ পেয়ে তাঁর স্ত্রী শ্বশুর আবদুল বারেক সরদারকে ফোন করে জানান, রনি এখন কোথায় আছেন, তিনি জানেন কী না। ছেলের স্ত্রীর এমন ফোন পেয়ে গার্মেন্টস ব্যবসায়ী পিতা রনিকে খুঁজতে থাকেন। যোগাযোগ করেন থানায়। কিন্তু পাঁচ দিন তাঁর হদিস কেউ দিতে পারেনি। অপহরণের পাঁচ দিন পর তাঁর বাবা লোকমুখে শুনতে পান কেরানীগঞ্জের মালঞ্চ হাসপাতালের পাশের কাশবনে এক যুবকের মৃত দেহ পড়ে আছে। তখন তিনি সেখানে গিয়ে দেখেন, ওই লাশ তাঁর ছেলের। এর আগে ২ সেপ্টেম্বর রনির বাবা স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী ও মাদক বিক্রেতাসহ সাতজনের নাম উল্লেখ করে অপহরণ মামলা করেন। এঁদের মধ্যে এক নম্বর আসামি করা হয় রুবেলকে। অপর আসামিরা হলেন হযরত, ছটাকি বাবুল, সাগর, দীপু, বাক্কু ও নাইম।
রনির বাবা আবদুল বারেক সরদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক বছর হয়ে গেল এখনো গ্রেপ্তার হলো না প্রধান আসামি রুবেল। কবে তদন্ত শেষ হবে আর কবে বিচার হবে জানি না। রনির দুই মেয়ে ও এক ছেলের মুখের দিকে চাইতে পারি না। আমি রুবেলসহ সব আসামির ফাঁসি চাই।’ তদন্ত কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই মামলার অভিযোগপত্র খুব শিগগিরই আদালতে দেওয়া হবে।’
কেরানীগঞ্জ থানা সূত্রে জানা গেছে মূল আসামি রুবেলের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ অনেক পুরোনো। খুনের মামলাও আছে তাঁর নামে। রুবেলের বাবার নাম আবদুল গফুর। বাড়ি কেরানীগঞ্জের নবাবচর গ্রামে। রনিকে হত্যার পর থেকে এলাকা ছাড়া রুবেল। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তবে পুলিশের ধারণা রুবেল বিদেশে পালিয়ে গেছে।
হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া হযরত এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। তাঁর বাবার নাম আবু মিয়া। আর খুচরা মাদক ব্যবসায় জড়িত দীপু, বাক্কু ও ছটাকি বাবুল। তদন্ত কর্মকর্তা আক্কাস বলেন, সাগর হলো ভাড়াটে খুনি। একাধিক খুনের মামলার আসামি তিনি। তার বাবার নাম আক্কাস মিয়া। তার বাসা কেরানীগঞ্জের খোলামোড়া মডেল টাউন এলাকায়। রনিকে খুন করার পর প্রায় এক বছর তিনি পালিয়ে থাকেন। পরে গ্রেপ্তার হন। রনির বাবার করা মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন হযরত, নাইম হোসেন, দিপু ও জুম্মন। হযরত জামিনে থাকলেও বাকিরা কারাগারে আছেন। ইতিমধ্যে হত্যার দায় স্বীকার করে আসামিরা জবানবন্দিও দিয়েছেন।
সরেজমিন এলাকা ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রনি খুনের পর প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি কিছুদিন বন্ধ ছিল। পুলিশের তৎপরতাও ছিল। কিন্তু এখন সব আগের মতো। রুবেল ধরা পড়েনি। তার লোকেরা ঠিকই মাদক বিক্রি করছে। হযরতও জামিনে ছাড়া পেয়েছে। ফলে আগের মতোই ব্যবসা চলছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন