কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে এখনও আসছে রোহিঙ্গারানির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে মিয়ানমার চুক্তি সই করেছে দুই দিন আগে। তবে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতার কোনও প্রভাব সীমান্তে দেখা যাচ্ছে না। এখনও পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। নতুন করে সীমান্ত পার হয়ে ঢোকা এসব রোহিঙ্গা জানান, রাখাইনে এখনও রোহিঙ্গাদের ওপর দমন নিপীড়ন ও গুলিবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। জানা গেছে, শুক্র ও শনিবার এই দু’দিনে নতুন আরও ৭০০ বা তারও বেশি রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বসবাসকারী ও পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, মিয়ানমারের রাখাইনে অভিযানের নামে সহিংসতা এখনও বন্ধ হয়নি। কিছু দিন পরপর রাখাইনে অভিযান চালাচ্ছে মিয়ানমারের সেনারা। শুক্রবার সন্ধ্যায়ও রাখাইনে গুলির শব্দ শুনেছেন সীমান্তের কাছে বসবাসীরা। এ কারণে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে এখনও আসছে রোহিঙ্গারা।
নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু সীমান্তে বসবাসকারী যুবক আবছার বলেন, ‘আজ (শনিবার) সকালে ৮ থেকে ১০ জনের মতো রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ তমব্রু সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে। এছাড়াও গতকাল শুক্রবার ঘুমধুম সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করেছে। তবে অন্যান্য সময়ের চেয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পরিমাণ এখন একটু কম।’
কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে এখনও আসছে রোহিঙ্গারাআবছার আরও বলেন, শুক্রবার রাতে ঘুমধুম সীমান্তঘেঁষা তার চিংড়ি প্রজেক্টে যখন অবস্থান করছিলেন, তখন রাখাইনের ঢেঁকিবুনিয়া এলাকার দিকে অনেকক্ষণ ধরে গুলির শব্দ শুনেছেন। তারা ধারণা করছেন, রোহিঙ্গাশূন্য গ্রামগুলোতে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করছে সেনারা যাতে সীমান্তের কাছের এলাকাগুলোয় কোনও রোহিঙ্গা প্রবেশ করতে না পারে। মূলত আতঙ্ক ছড়াতেই এই কাজ করছে তারা।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) পরিচালিত টেকনাফের হারিয়াখালী এলাকায় অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা গণনাকারী কেন্দ্রের কর্মী জসিম উদ্দিন বলেন, ‘রোহিঙ্গারা এখনও অনুপ্রবেশ করেছে। তবে অন্যান্য সময়ের চেয়ে একদম কম। গতকাল শুক্রবার নতুন করে ৭২ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। আজ শনিবারও কিছু রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নভাবে আসছে। তবে এর পরিসংখ্যান এখন নয়, রাতে জানা যাবে। টেকনাফের হারিয়াখালী পয়েন্টের পাশাপাশি শুক্রবার রাতে টেকনাফ উপজেলার শাহপরীরদ্বীপ হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে ৪০-৫০জন রোহিঙ্গা।’
উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘গতকাল শুক্রবার ও আজ শনিবার সকালে অন্তত ৬-৭শতাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। পালংখালী আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত পয়েন্টসহ ইউনিয়নের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে এসব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে।’
অনুপ্রবেশকারী এসব রোহিঙ্গার বরাত দিয়ে গফুর উদ্দিন চৌধুরী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমঝোতার বিষয়টি রোহিঙ্গারা জানে না। একইভাবে যেসব রোহিঙ্গা রাখাইনে অবস্থান করছে এবং সেখানে যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়িত্বপালন করছে তাদের মধ্যে সমঝোতার খবরটি পৌঁছেনি। রোহিঙ্গারা এখনও আসছে এবং সে দেশের সেনাবাহিনীও সম্ভবত অভিযান অব্যাহত রেখেছে।’
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান বলেন, ‘সীমান্ত পেরিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে রোহিঙ্গারা এখনও আসছে। তবে অন্যান্য সময়ের তুলনায় একদম কম। তবে বিচ্ছিন্নভাবে অনুপ্রবেশ করায় আমাদের কাছে সঠিত পরিসংখ্যান নেই। শুক্রবারও উখিয়ার পালংখালী আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে জেনেছি।’
কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে এখনও আসছে রোহিঙ্গারামো. নিকারুজ্জামান আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী নতুন করে ৬ লাখ ২১ হাজার ৬৬জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। এর আগে ২ লাখ ১২ হাজার ৫১৮ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নিয়েছিল। অর্থাৎ নতুন পুরনো মিলিয়ে ৮ লাখ ৩৩ হাজার ৫৮৪ জন রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন।’
টেকনাফ ২নং বিজিবি’র অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘সীমান্ত দিয়ে আগের মতো এখন দলে দলে রোহিঙ্গারা আর আসছে না। তবে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ জনের মতো রোহিঙ্গা নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে আসছে। এই সংখ্যা খুবই নগন্য। নাফনদী ও সমুদ্রপথে নৌকা চলাচলের ওপর কড়া নজরদারি থাকায় এখন বাংলাদেশি নৌকা নিয়ে তারা আসতে পারছেন না। যারা আসছে তারা সে দেশের কিছু মাছ ধরার নৌকা নিয়ে রাতের আঁধারে প্রবেশ করছে। সাবরাংসহ সমুদ্রের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে আসছে তারা।’
দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া শুরুর ব্যাপারে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমঝোতা হয়েছে। স্বাক্ষরিত ওই সমঝোতায় তিন সপ্তাহের মধ্যে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টার দফতরে দু’দেশের মধ্যে এই সমঝোতা স্বাক্ষর হয়। বিকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও সমঝোতা স্বাক্ষরের বিষয়টি জানানো হয়।
এদিকে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক চুক্তি সই হয়। বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী এবং মিয়ানমারের ইউনিয়ন মিনিস্টার উ চ টিন্ট সোয়ে এতে স্বাক্ষর করেন। তিন সপ্তাহের মধ্যে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করে দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে দ্বিপক্ষীয় ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করা হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন