বহুল সমালোচিত তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার প্রয়োগ বন্ধ করেছে পুলিশ। প্রকাশ্য ঘোষণা না দিলেও পুলিশ ৫৭ ধারায় কোনো মামলা দায়ের করছে না। অপরাধের শিকার ব্যক্তিকেও ৫৭ ধারায় মামলা দায়েরে নিরম্নৎসাহিত করছে পুলিশ।
দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সংশিস্নষ্ট ধারায় মামলা নেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সতর্ক করা হয়েছিল। এরপর কার্যত থানায় ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের বন্ধ হয়ে গেছে।
চট্টগ্রামে সংঘটিত সাইবার অপরাধের বিভিন্ন ঘটনার পর দায়ের হওয়া মামলা পর্যালোচনায় ৫৭ ধারার প্রয়োগ বন্ধ হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে।
জানতে চাইলে
হপুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি এসএম মনির-উজ-জামান বলেন, গণমাধ্যমে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ৫৭ ধারার বিরম্নদ্ধে যে একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে তার প্রেক্ষিতে এই ধারায় মামলা নেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ সদর দপ্তরের একটা সতর্কবার্তা আছে। তিনি চট্টগ্রাম রেঞ্জের অধীন ১১ জেলার এসপিকে একটা নির্দেশনা পাঠিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, অপরাধ যদি ৫৭ ধারার আমলযোগ্য হয়, তাহলে অবশ্যই মামলা নেয়া যাবে। কিন্তু মামলা নেয়ার আগে বিষয়টি তাকে অবহিত করতে হবে। তিনি পুলিশ হেডকোয়ার্টারের আইন শাখার সঙ্গে পরামর্শ করবেন। অপরাধের ধরন ও গুরম্নত্ব বিবেচনা করে অনুমতি দিলেই শুধু থানা মামলা নিতে পারবে।
২০১৩ সালে প্রণীত তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ (১) ধারায় বলা হয়েছে, 'কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশস্নীল বা সংশিস্নষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরম্নদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।'
সূত্রমতে, অজামিনযোগ্য এই ধারায় ২০১৬ সালে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে কমপক্ষে ২০টি এবং ২০১৭ সালের প্রথম সাত মাসে প্রায় সমপরিমাণ মামলা হয়। এই মামলার আসামি হয়ে জেল খেটেছেন সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, প্রগতিশীল ঘরানার লেখক থেকে শুরম্ন করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, শিক্ষক পর্যন্ত্ম। ৫৭ ধারায় মামলা নিয়ে আন্ত্মর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ও নাগরিক সমাজের সমালোচনার মধ্যে চলতি বছরের ২ আগস্ট পুলিশ সদর দপ্তর থেকে আইজি একেএম শহীদুল হক স্বাক্ষরিত চার দফা নির্দেশনা (স্মারক নম্বর- ৪৪.০১.০০০০.০২০.২৬.০০৩.২০১৫.১৫৬৩ (৯৮) জারি করা হয়। এতে ৫৭ ধারায় মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন, অভিযোগ সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক হলে তাৎক্ষণিক জিডি করে সত্যতা যাচাই, মামলা দায়েরের আগে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের আইন শাখা থেকে আইনগত মতামত নেয়া এবং কোনো নিরীহ ব্যক্তি যাতে হয়রানির শিকার না হয় সেটা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়।
এই আদেশ জারির পর গত আগস্ট থেকে চট্টগ্রাম নগরীতে ৫৭ ধারায় একটিও মামলা দায়ের হয়নি বলে জানিয়েছেন নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) সালেহ মো. তানভীর। তিনি বলেন, 'যেহেতু আইনটা সংশোধনের পর্যায়ে আছে, আমরা পুলিশ হেডকোয়ার্টারের পরামর্শে আপাতত ৫৭ ধারায় মামলা না নিতে বলেছি। এজন্য গত চার মাসে ৫৭ ধারায় একটি মামলাও হয়নি। আদালতে দায়ের হওয়া একটি মামলা শুধুমাত্র আমরা তদন্ত্ম করছি।'
গত এক বছরে চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানায় ৫৭ ধারায় তিনটি মামলা হওয়ার তথ্যও দিয়েছেন তানভীর।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৫ নভেম্বর নগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আব্দুল জলিল ম-লের নামে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলে প্রতারণা চক্রের এক সদস্যকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। তথ্যপ্রযুক্তি আইনে অপরাধ হলেও এ ঘটনায় ইপিজেড থানায় প্রতারণার মামলা দায়ের হয়েছে।
বিক্রয় ডটকম অনলাইন শপে আইডি খুলে পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা চক্রের দুই হোতা সুমন খন্দকার রিফাত ও সাজ্জাদ নেওয়াজ খানকে গ্রেপ্তার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের বিরম্নদ্ধে ডবলমুরিং থানায় দায়ের করা হয়েছে প্রতারণার মামলা।
গত ১৪ নভেম্বর ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে চট্টগ্রাম থেকে অপহৃত এক শিক্ষিকাকে যশোর থেকে উদ্ধার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তার হওয়া অপহরণকারীর বিরম্নদ্ধে নগরীর ডবলমুরিং থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয়েছে।
মোটরসাইকেল চুরির পর ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করা একটি চক্রের পাঁচজনকে আটকের পর নগরীর বায়েজিদ বোস্ত্মামি থানায় চুরির মামলা দায়ের হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, 'চারটি ঘটনার প্রতিটিই তথ্যপ্রযুক্তি আইনে আমলযোগ্য অপরাধ। কিন্তু ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের নির্দেশে আমরা সাধারণ আইনে মামলা দিয়েছি।'
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন