দেশেই গড়ে উঠেছৈ বিশ্বমানের অনেকগুলো সফটওয়্যার কোম্পানি। দিন দিন এ সংখ্যা বেড়ে চলছে। বিদেশেও বাড়ছে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর কদর।অথচ দেশেই তাদের ‘ভাত নেই’! বহির্বিশ্বের সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোকে প্রধান্য দিচ্ছে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
এতে দেশীয় প্রযুক্তির অনগ্রসরতার পাশাপাশি সাফল্যের মুখ দেখছে না দেশীয় সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান, এমনটিই মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবস্থা অনেকটা এমন- ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’। দেশী সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানগুলোর হাত-পা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রতিযোগিতা করার সুযোগই দিচ্ছে না।
তাদের মতে, দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত আমলাদের মানসিকতার কারণে এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)-এর সদস্য প্রায় এক হাজার। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, আইটি সংশ্লিষ্ট এসব কোম্পানি গত বছর বিদেশ থেকে ৭০০ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে।
এদের মধ্যে একটি কোম্পানি ডেটা সফট। দেশের প্রথম সারির সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি এটি। প্রতিষ্ঠানটির কর্তাস্থানীয় ব্যক্তিদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু কাজ তারা পেয়ে থাকেন, কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নূন্যতমও পান না। অথচ এই প্রতিষ্ঠানটি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে ব্যবসা করে যাচ্ছে দেশের বাইরে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) এম মঞ্জুর মাহমুদ প্রিয়.কমকে বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বাইরে থেকে সফটওয়্যার কেনার জন্য পাগল হয়ে থাকে। তারা লোকাল সফটওয়্যার বাজারের দিকে তাকানই না। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আমলাদের চিন্তা থাকে বাইরে গেলে একটি ট্যুর হয়ে যাবে। সরকার যদি এসব সফটওয়্যার সংক্রান্ত কাজ বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোকে দিত, তবে এই ট্যুরের জন্য আলাদাভাবে টাকা খরচ হতো না, দেশের টাকা দেশেই থাকতো।
মঞ্জুর মাহমুদ বলেন, ‘গত বছর আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কোনো কাজ পাইনি বললেই চলে। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর থেকে আমরা ভালো সাড়া পেয়েছি। তবে পলিসিগত সমস্যার সমাধান হলে এই কাজ পাওয়ার সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেত।’
এ তো গেল একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের কথা। সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগের অধীন পাওয়ার সেলের এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং (ইআরপি) সিস্টেম সরবরাহ ও ইনস্টলেশনের জন্য ইআরপি সরবরাহকারী এবং বাস্তবায়নকারী হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তির ৮ ও ৯ নাম্বার শর্তে বলা হয়, ইআরপি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে বিগত ১০ বছর ধরে প্রতিবছর কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় থাকতে হবে ও কমপক্ষে ১ বিলিয়ন ডলারের তারল্য সম্পদ (লিকুইড অ্যাসেট) থাকতে হবে।
বেসিসের দাবি, বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য জন্য এ ধরনের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে থাকে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে দেশীয় সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানগুলো এই কাজে অংশ নিতে না পারে।
পাওয়ার সেলের উপরোক্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরপরই ওই দুটি শর্তের বিষয়ে প্রতিবাদ জানায় তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)। তাদের দাবি, এটি প্রকৃত পক্ষে বাংলাদেশের কোম্পানিকে রেস্ট্রিকটেড করা নয়, কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানিকে সহায়তা করার জন্য এবং অন্য কোম্পানি যাতে বিট না করতে পারে তার জন্য এই কঠিন শর্ত দেয়া হয়েছে।
বেসিসের দাবি, এমন ধরনের শর্ত বা পদক্ষেপ এর কারণে পিছিয়ে পড়ছে দেশের সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো। কিন্তু এ ধরনের কাজে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগানো গেলে অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি আরও ভালো কিছু করা সম্ভব হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগের এমন বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে কথা হয় বেসিস সভাপতি মোস্তাফা জব্বারের। তার দেয়া তথ্যমতে, পাওয়ার সেলের কর্মকর্তারা মূলত একটি সফটওয়্যার (ওরাকল, স্যাপ,মাইস্পেফিয়ার এই জাতীয়) কিনবেন।
বেসিসের উচ্চপদস্থ এই কর্মকর্তার মতে, ‘এই ধরনের সফটওয়্যারের জন্য কারো ১০ বিলিয়ন ডলারের পার্ফর্মেন্স থাকা দরকার এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সফটওয়্যারগুলোর দাম হয়তো মিলিয়ন ডলার হবে। এরজন্য ১০ বিলিয়ন ডলারের কেনো পারফর্মেন্স থাকতে হবে তা আমাদের বোধগম্য নয়। দ্বিতীয় বিষয় আমি যদি মিলিয়ন ডলারের সফটওয়্যার বিক্রি করি তবে কেনো আমার বিলিয়ন ডলার ক্যাশ থাকতে হবে কেনো এটিরো কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। আমরা যখন এ বিষয়ে প্রতিবাদ করি তখন আমাদের বলা হয় যেসব দেশীয় প্রতিষ্ঠান এই উইআইতে থাকবে তাদের জন্য এই শর্ত প্রযোজ্য না। পরবর্তীতে আমরা খোঁজ নিয়ে দেখলাম তারা সফটওয়্যারটি বাইরে থেকে কিনবে আর বাস্তবায়নের জন্য দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুযোগ দেবে।’
মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এসব টেন্ডারে বিট করতে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সফটওয়্যার সরবরাহ করতে পারতাম তাহলে এই পুরো বিষয়টিই পাওয়ার সেলের জন্য সুবিধাজনক হতো। আমাদের দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একধরনের মানসিকতা কাজ করে যার ফলে এ ধরনের কাজ কর্মগুলো ঘটছে।’
দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বানানো সফটওয়্যার কতটুকু নিরাপদ এমন প্রশ্নের উত্তরে বেসিস সভাপতি বলেন, ‘আমাদের দেশে ১২টি ব্যাংক আমাদের ছেলেমেয়েদের তৈরি সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। এগুলো অনেক ক্ষেত্রে বিদেশি সফটওয়্যারগুলো থেকে অনেক উন্নত। কারণ আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা দেশের প্রেক্ষাপটটি যতো ভালো বোঝে বাইরের কোনো কোম্পানি ততটা ভালো বোঝে না। কারণ তারা সাড়া বিশ্বের জন্য সফটওয়্যার তৈরি করে। কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েরা আমাদের জন্য সফটওয়্যার তৈরি করে।’
তিনি আরও বলেন,‘ সবদিক থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বিদেশিদের উপর নির্ভর করে আমি যদি ডিজিটাল রূপান্তর করি তাহলে সেই রূপান্তর আমাদের দেশের জন্য উপযুক্ত না। আমরা বিদেশি টেকনোলজি ব্যবহার করবো কিন্তু এটি ইমপ্লিমেন্ট করতে হবে আমাদের। এবং আমাদের দেশের মানুষকে দিয়েই এটি পরিবর্তন করাতে হবে। প্রযুক্তি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। প্রযুক্তি কিনে নিয়ে বসে থাকলে হবে না। প্রতিদিন এর সাপোর্ট দরকার এবং সংষ্কার দরকার। পরিবর্তিত পরিস্থির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো দরকার। তা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া যাবে না।’
দেশীয় সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিলে কী সুবিধা পাওয়া যাবে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কোনো কাজ করলে আমরা বাইরের প্রতিষ্ঠান এর তুলনায় ১০ ভাগ কম দামে পাচ্ছি, আমাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে, সাপোর্ট নিজের দেশের পাওয়া যাচ্ছে, আমাদের দেশের প্রশিক্ষত লোকজন অন্যদের যেভাবে প্রশিক্ষণ দিতে পারবে বিদেশিরা কোনোভাবেই তা পারবে না, সহজে বোঝানো যাবে।’
মোস্তফা জব্বারের কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই কথা বললেন দেশের অন্যতম সফটওয়্যার প্রস্তুতকারক লিডস করপোরেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল ওয়াহিদ, ‘বাইরের কোম্পনি থেকে সফটওয়্যার কেনা এক ধরনের জিম্মি হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। বিদেশিরা আমাদের কাজ করে দেয়, তারপর তাদের কাছে আমাদের জিম্মি হয়ে থাকতে হয়। কোনো সফটওয়্যার আপগ্রেড, সাপোর্ট অন্যান্য বিষয়ে তাদের উপর নির্ভর করে থাকতে হয় আমাদের।এই মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে না হলে আমরা টাকা ব্যয় করবো কিন্তু প্রত্যাশিত ফলাফল আমরা পাবো না। তাই দেশের সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশীয় সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা নেয়া প্রয়োজন।'
এ থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে মোস্তফা জব্বার বলেন, ‘এর জন্য আমাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। যারা সফটওয়্যার কেনেন তারা সিপিডিওর আইন মানেন না। এ ছাড়া আইটি ক্রয় সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা এখনো গড়ে ওঠেনি। তবে এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে।’
এ বিষয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক প্রিয়.কমকে বলেন, ‘দেশের অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের জানা নেই দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা কী? সেই সঙ্গে দেশের প্রাইভেট সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বুঝতে হবে সরকারের রিকয়ারমেন্ট কী?দেশীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বুঝতে হবে যে আমরা যদি আমদের দেশীয় সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানগুলোকে না সুযোগ দেই তাহলে তারা তৈরি হবে কীভাবে। সেই সঙ্গে আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বুঝতে হবে যে তাদের দক্ষতা দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে, কারো করুণার পাত্র হওয়া যাবে না।’
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন