রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র ও উসকানিমূলক তৎপরতা রোধে সামাজিক মাধ্যমের ১২০০ সাইটে চলছে নিয়মিত সাইবার টহল। যদিও উন্নত বিশ্ব ভার্চুয়াল জগতে সাইবার টহলের মাধ্যমে বহু আগে থেকেই আভিযানিক ও আগাম তথ্যগত ক্ষেত্রে সাফল্য পেয়ে আসছে। আর ঢাকায় গুলশান হামলার পর সাইবার টহলের আওতায় অসংখ্য সামাজিক মাধ্যমের সাইটকে আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরই মধ্যে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে অভিজ্ঞ গোয়েন্দারা যে ধরনের সাইবার টহল শুরু করেছেন, এর সুফল হিসেবে ভার্চুয়াল জগতের বহু আগাম তথ্য এবং পরিকল্পনা জানা সম্ভব হচ্ছে। গোয়েন্দারা নাশকতা ভেস্তে দিতেও সক্ষম হচ্ছেন।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, নানা কারণে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট নজরদারি করা প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন সাইটের ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ শুরু করেছেন গোয়েন্দারা। নজরদারি করার ফলে আগাম তথ্য হাতে নিয়ে গোয়েন্দারা নাশকতাকারীদের পরিকল্পনা গুঁড়িয়ে দিতে যেমন সক্ষম হচ্ছেন, তেমনি সাম্প্রদায়িক বিষয়ে উসকানিদাতাদের নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধান করতেও পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিশেষ করে রংপুরের ঘটনাটি অনুসন্ধানে ভেতরের প্রায় সব তথ্যই এখন গোয়েন্দাদের হাতে। এ ছাড়া সরকারের বিরুদ্ধে ভার্চুয়াল অপপ্রচারে জড়িতদের চিহ্নিত এবং নির্বাচনকে সামনে রেখে বৈশ্বিক সন্ত্রাস মোকাবিলায় সাইটগুলোর ওপর নজরদারি অব্যাহত আছে।
পুলিশ সদর দফতরের অ্যাডিশনাল ডিআইজি (ইন্টেলিজেন্স ও স্পেশাল অ্যাফেয়ার্স) মো. মনিরুজ্জামান মানবকণ্ঠকে বলেন, গুলশান হামলার পর বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দারা আগাম তথ্যের মাধ্যমে অসংখ্য নাশকতা মোকাবিলায় সক্ষম হয়েছেন, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দারা স্বীকার করেন। এর কারণ হলো এক বছরের বেশি সময়ে ৪০টি বড় অভিযানে জঙ্গি সন্ত্রাস মোকাবিলায় বাংলাদেশ যে সক্ষমতা দেখিয়েছে তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃতি পেয়েছে। যদিও জঙ্গিরা বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে এখনো মাঝে মধ্যে নাশকতার চেষ্টা করে, তবে তাদের যে সংগঠিত হওয়ার পরিকল্পনা তা পুলিশের গোয়েন্দারা এখন আগেই জেনে যাচ্ছেন। এর ফলে জঙ্গিরা আর হামলা করতে পারছে না। তাদের সক্ষমতা ক্রমেই কমে আসছে। তার পরও তাদের ওপর নজরদারি অব্যাহত আছে।
পুলিশের এই চৌকস কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দাদের এ অর্জন দেখে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ প্রশংসা করছে। এমনকি বিদেশে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে কীভাবে ঢাকার গোয়েন্দারা তাদের মেধা, চৌকসতা, দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব কাজে লাগিয়ে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের এ সময়ে নাশকতা প্রতিরোধ করছেন। তিনি বলেন, সাইবার টহলের সুফল পাচ্ছেন বাংলাদেশের গোয়েন্দারা। ভার্চুয়াল জগতে যে টহল জোরদার করা হয়েছে এর মাধ্যমেও অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি অনেক ঘটনা আগাম জেনে প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
দায়িত্বশীল এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, যারা সরকার এবং দেশ নিয়ে উসকানিমূলক তথ্য সামাজিক মাধ্যম, ব্লগ বা বিভিন্ন সাইটে পোস্ট করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। একই সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্র্তারা নজরদারি বৃদ্ধির অংশ হিসেবে বেশ কিছু আইডি চিহ্নিত করেছেন। কোনো কোনো আইডি পরিচালিত হচ্ছে বিদেশ থেকে। এ ধরনের অন্তত ১২০০ সাইটে কঠোর সাইবার পেট্রলিং অব্যাহত আছে। এর বাইরে বন্ধ করা হয়েছে আরো প্রায় ৩০০ সাইট।
নজরদারি করা গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মতে, পুলিশ ও র্যাবের সদস্যরা যেমন করে নিরাপত্তার জন্য টহল দিতে থাকে ঠিক তেমনি হচ্ছে সাইবার পেট্রলিং বা সাইবার টহল। গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার পরে জঙ্গিদের যে ধরনের সামাজিক মাধ্যম এবং অ্যাপসকেন্দ্রিক তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়, তখন থেকেই সাইবার টহলের ওপর জোর দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিটিআরসি। এরই ধারাবাহিকতায় প্রায় দেড় হাজার সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন সাইট ও পেজ নজরদারির আওতায় আনা হয়। বন্ধ করা হয়েছে প্রায় ৩০০টি সাইট। তবে নতুন নামে কোনো কোনো আইডি সামাজিক মাধ্যমে তৎপর হয়েছে। এসব সাইটে অব্যাহত নজরদারি আছে।
জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট, গোয়েন্দা সংস্থা, সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং বিটিআরসির পক্ষে যৌথভাবে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আইডি নিয়ন্ত্রণ করে রাখা হয়েছে। কিছু পেজ ও আইডি উগ্রবাদ, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, উসকানিমূলক পোস্ট দিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে থাকে প্রতিনিয়ত। কিন্তু সাইবার টহল জোরদারের কারণে তাদের বেশিরভাগ তৎপরতা ভেস্তে যাচ্ছে। এ সফলতার মূলে রয়েছে বাংলাদেশে গেটওয়ে লেভেলে সক্ষমতা অর্জন। প্রযুক্তির যুগে যে ঘাটতি ছিল পূরণ হওয়ার ফলেই অনেক ঘটনা আগাম জানা যাচ্ছে। এতে করে নাশকতাকারীদের চক্রান্ত এবং পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে সক্ষম হচ্ছেন সরকারের গোয়েন্দারা।
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. নাজমুল ইসলাম মানবকণ্ঠকে বলেন, উগ্রবাদের মূলে এখন সাইবার জগত। এখান থেকেই উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে তরুণ-যুবকদের। ভার্চুয়াল মাধ্যমে বিভিন্ন অডিও, ভিডিও, পোস্ট, কমেন্ট ও তথ্য আদান প্রদানের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করা হয়। তার পরই তরুণ ও যুবকদের অনুপ্রাণিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হলেও তাদের ঠেলে দেয়া হয় জঙ্গিবাদে। এক পর্যায়ে তাদের দাওয়াত দিয়ে গোপন বৈঠকে মিলিত করা হয়। সেখানেই ব্রেনওয়াশ করে ঠেলে দেয়া অন্ধকার জগতে।
বিভিন্ন সময় নজরদারি করা সাইটগুলোর ওপর আবারো নজরদারি চলছে। এগুলো হলো- আল মুজাহিদীন, হামজা, ভয়েস অব ইসলামী জিহাদ, আনসার আল ইসলাম-১, আনসার আল ইসলাম-২, আনসার আল ইসলাম-৭, আনসার আল ইসলাম-১৩, আনসার উল ইসলাম, আত তামকীন, দাওলাতুল ইসলাম, খিলাফতের সৈনিক, কথিত ইসলামিক স্টেট, মৌমাছি মৌমাছি, সাদাপাতা, জিহাদী জন, নাইক্ষ্যংছড়িবাসী, বান্দরবানবাসী, রক্তাক্ত প্রান্তর, কোরআনের আলো সংসদে জ্বালো, সত্যের পথের সৈনিক, জেরুজালেম ও ইত্তেহাদুল মুজাহিদীন। এ ধরনের অন্তত ১২০০ সাইট আছে যেসব নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, সাইবার টহলের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের নাশকতার ছকের বিভিন্ন তথ্য বেরিয়ে আসছে। এসব সাইটে ক্লোজ গ্রুপে বিভিন্ন সময় জঙ্গিরা ভিআইপি ব্যক্তিসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে হত্যা পরিকল্পনার তথ্য আদান-প্রদান করে। কিন্তু তাদের পরিকল্পনা আগে জেনে যাওয়ায় ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। নিরাপত্তায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে উন্নত বিশ্বের মতোই বাংলাদেশে সাইবার পেট্রলিং আগের চেয়ে কয়েকগুণ বাড়ানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো মনিটরিং করে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য উদ্ধার করছে। কারো কারো আবার স্বাধীনতাবিরোধী ও বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের কানেকশন পাওয়া যায়। যা একই সূত্রে গাঁথা।
পুলিশের এক গবেষণায় দেখা গেছে, জঙ্গিবাদে যারা জড়িয়েছে তাদের ৮২ ভাগই ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। পুলিশের হাতে গ্রেফতার ২৫০ জঙ্গির সঙ্গে কথা বলে এ গবেষণা তৈরি করা হয়। গবেষণা মতে, জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া ৫৬ শতাংশই সাধারণ শিক্ষার্থী ও মাদরাসা থেকে এসেছে ২২ ভাগ শিক্ষার্থী। এদের বিভিন্ন অডিও এবং ভিডিও দেখিয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়।
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন