কোটি কোটি টাকা পাচার করছে নেপালিচক্র # নেপথ্য মদদদাতা ক্ষমতাসীন দলের যুবনেতা # দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ৪শ নেপালি; নেই প্রবেশের কাগজ।
রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে পশ্চিমা দেশগুলোর ধাঁচে ক্যাসিনো বা জুয়ার আখড়া বসিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে নেপালের একটি চক্র। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী এক যুবনেতার ছত্রছায়ায় চলা এসব জুয়া থেকে প্রাপ্ত সব অর্থ দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। নেপালি জুয়াড়িদের এ চক্রটি আইনের হাত থেকে রক্ষা পেতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্নীতিবাজ, লোভী কিছু কর্মকর্তাকেও অর্থের বিনিময়ে হাতের তালুতে বন্দি করে রেখেছে।
জুয়া খেলা ছাড়াও এসব ক্যাসিনো মদ-ইয়াবাসহ বিভিন্নরকম মাদক সেবনের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। চিহ্নিত সন্ত্রাসী, দাগি আসামি এমনকি ভাড়াটে কিলাররাও এখানে নিরাপদ। চাঞ্চল্যকর তথ্য হচ্ছে, দেশের প্রাণকেন্দ্র ঢাকায় লাস ভেগাসের আদলে রয়েছে অন্তত ৫০টি ক্যাসিনো। সবগুলোর নিয়ন্ত্রণই এ চক্রটির হাতে। এ চক্রের পালের গোদা নেপালের দিনেশ শর্মা। তার হাত ধরেই রাজধানীর ক্যাসিনো ব্যবসায় আড়াই শতাধিক এবং অন্য গুরুত্বপূর্ণ জেলা শহরগুলোয় আরও দেড়শ নেপালি এ দেশে এসেছে; যাদের এ দেশে অনুপ্রবেশের বৈধ কোনো কাগজপত্র পর্যন্ত নেই। এরা ক্যাসিনো পরিচালনায় দক্ষ। সরেজমিন ‘সাধারণ মানুষের জন্য নিষিদ্ধ’ এসব ক্যাসিনো ঘুরে এবং সূত্রের মাধ্যমে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
মূলত রেস্টুরেন্ট ব্যবসার আড়ালে বসানো হয়েছে ক্যাসিনোগুলো। এ জুয়ার জালে পড়ে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার অসংখ্য মানুষ পথে বসেছেন। তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। রাজধানীর ক্যাসিনোগুলোর নেপথ্য মদদদাতা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা। নেপালি চক্রের কাছ থেকে তিনিও বাগিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। এ নেতার বিরুদ্ধে একটি গোয়েন্দা সংস্থা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইতৈামধ্যে লিখিত প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে।
ঢাকা মহানগরীতে জুয়া খেলা বন্ধে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তর থেকে রাজধানীর রমনা, লালবাগ, ওয়ারি, মতিঝিল, তেজগাঁও, মিরপুর, গুলশান, উত্তরা, ডিবি উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম, সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে যেসব প্রতিষ্ঠানে জুয়া খেলা হচ্ছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের নাম ঠিকানাও তুলে ধরা হয়। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খোদ ডিএমপি পুলিশ কমিশনারের সে নির্দেশও প্রতিপালিত হয়নি।
ডিএমপি গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সব ধরনের জুয়া খেলার বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে থাকে ঢাকা মহানগর পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অপর এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সব ধরনের জুয়া খেলা নিষিদ্ধ। তার পরও কিছু কিছু ক্লাব আদালতকে ভুল বুঝিয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলার অনুমতি নিয়ে জুয়া খেলা পরিচালনা করে থাকে। ফলে ওইসব ক্লাবে পুলিশি অভিযান পরিচালনা করা অনেক ক্ষেত্রেই দুরূহ হয়ে পড়ে।
জানা গেছে, রাজধানীর পুরানা পল্টনের ৩৭/২ জামান টাওয়ারে চলছে দেশের অন্যতম দুটি বড় ক্যাসিনো। ভবনটির ১৪ তলায় লাস ভেগাসের আদলে গড়ে তোলা হয়েছে পাশাপাশি দুটি ক্যাসিনো। এদের একটিতে গ্যাম্বলিং টেবিল সাজিয়ে চলছে হরেক নামের জুয়া খেলা। অন্যটিতে সারি সারি অসংখ্য ডেস্ক বসিয়ে তাতে স্থাপন করা কম্পিউটারে খেলা হয় অনলাইন ক্যাসিনো গেম। সরকারি অনুমোদন ছাড়াই সেগুলোয় কাজ করছে ১৮ নেপালি। তারা সবাই প্রশিক্ষিত জুয়াড়ি। রেস্টুরেন্ট ব্যবসার কথা বলে প্রায় ৮ মাস আগে জামান টাওয়ারের ১৪ তলায় দুটি হলরুম ভাড়া নেয় নেপালি জুয়াড়ি চক্র। দিন-রাত সচল এই ক্যাসিনোতে প্রায় প্রতিদিন গড়ে ১০ কোটি টাকার জুয়া খেলা হয়। এই খেলা থেকে উপার্জিত টাকা নেপালি চক্র হুন্ডির মাধ্যমে সিঙ্গাপুর, নেপালসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করছে।
১৭ তলাবিশিষ্ট জামান টাওয়ারের লিফটের ১৪ তলায় উঠতেই দেখা মিলবে অবিকল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পোশাক পরা দুই নিরাপত্তারক্ষীর। এ দুজন ছাড়াও ফ্লোরটির বাইরের অংশে সার্বক্ষণিক নজরদারির জন্য রাখা হয়েছে ৪টি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসি টিভি ক্যামেরা)। ভেতর থেকে এগুলো মনিটরিং করা হয়। লিফটের দরজা খুলতেই চোখ পড়বে একটি কাচের দরজা। তাতে ইংরেজিতে লেখা ‘ওয়েলকাম’। হাত পাঁচেক পর আরেকটি হলরুম। ‘ওয়েলকাম’ লেখা একই পরিমাপের আরও একটি গ্লাসডোর পার হওয়ার পর দেখা মিলবে ক্যাসিনোর। তবে ইচ্ছা করলেই যে কেউ প্রবেশ করতে পারবেন না। দুই নিরাপত্তারক্ষীর অন্তত তিনটি প্রশ্নের (কোত্থেকে এসেছেন? কী করেন? কার কাছে যাবেন?) সদুত্তর দিতে পারলে এবং ভেতর থেকে সবুজ সংকেত এলে তবেই মিলবে হলরুমে প্রবেশের অনুমতি। বাইরে থেকে কক্ষ দুটি সাধারণ কোনো অফিস অথবা রেস্টুরেন্ট মনে হবে।
পরিচয় গোপন করে একজন জুয়াড়ির সাহায্যে গত রবিবার রাত ১২টার দিকে জামান টাওয়ারে গিয়ে দেখা গেছে, হলরুম দুটির মেঝেতে লাল রঙের বিদেশি কার্পেট। নানান রঙের বাতি দিয়ে জমকালো সাজে সাজানো হয়েছে। ভেতরে রয়েছে নামাজের কক্ষ ও বিশ্রামাগার। জুয়াড়িদের আপ্যায়নের জন্য হলরুমের একদিকে নানা ধরনের খাবারের আয়োজনও রয়েছে।
কক্ষ দুটির প্রথম সারিতে গড়ে তোলা হয়েছে ব্যাংকসদৃশ টাকা আদান-প্রদানের কাচঘেরা বিশেষ কাউন্টার। পরিপাটি পোশাক পরা কয়েকজন কর্মকর্তা বসে আছেন কাউন্টারের পেছনে। জুয়াড়িরা টাকার বান্ডিল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন সেই কাউন্টারের দিকে। কর্মকর্তাদের কাছ থেকে নগদ টাকা ভাঙিয়ে কিনে নিচ্ছেন তারা এক ধরনের প্লাস্টিকের কয়েন (চিপস)। প্রতিটি চিপসের মূল্য ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা।
একটি হলরুমের মাঝখানে মখমল কাপড়ে মোড়ানো ৮টি গ্যাম্বলিং টেবিল রাখা। সেগুলোর চারপাশে ৭টি করে অভিজাত চেয়ারের সারি। কোনোটিই খালি নেই। টেবিলের অপর প্রান্তে আছেন ক্লাবের প্রশিক্ষিত জুয়াড়িরা। দক্ষ হাতে টেবিলের ওপর তাস ছড়িয়ে দিচ্ছেন তারা। পছন্দসই কয়েকটি তাস তুলে নিয়ে নম্বর মেলাচ্ছেন জুয়াড়িরা। এর পর সেগুলো টেবিলে রাখছেন। একসঙ্গে ১০ থেকে ১৫ জন জুয়াড়ি তাস তুললেও জিতছেন হাতেগোনা দু-একজন। এভাবে কিছুক্ষণ খেলার পর চিপস শেষ হয়ে গেলে আবারও সেই কাউন্টারে টাকা ভাঙিয়ে নতুন চিপস নিয়ে আসছেন হেরে যাওয়া জুয়াড়িরা। টেবিলে সেই চিপস সাজিয়ে হরদম চলছে বাক্কারাট, রুলেট, পন্টুন, ফ্লাশ, বিট, ডিলার, কার্ডসøট, ব্লাকজ্যাক নামের জুয়া খেলা। জুয়াড়িদের অনেকে বিদেশি মদভর্তি গ্লাস হাতে নিয়ে বসছেন জুয়ার টেবিলে। মদের নেশায় বুঁদ হয়ে জুয়া খেলায় মেতে উঠছেন তারা। চেয়ারে বসা জুয়াড়িদের পেছনে ভিড় করে আছেন কয়েকজন দর্শক; খেলা দেখছেন। টেবিলের অদূরে লম্বা দুটি সোফাসেট পাতা। তারা চেয়ার খালি হওয়ার অপেক্ষায় থাকা জুয়াড়ি।
অন্য হলরুমে গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি কম্পিউটারের সামনে বসে অনলাইনে পোকার (জুজু খেলা) খেলায় মশগুল জুয়াড়িরা। প্রতিটি কম্পিউটারের সামনে একজন করে জুয়াড়ি। হংকং, চায়না, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ক্যাসিনোর সঙ্গে সংযোগ হয়ে তারা জুয়া খেলছিলেন। জিততেই হৈ-হুল্লোড় করছিলেন কয়েক জুয়াড়ি। যাদের অধিকাংশই রোজ বাড়ি ফেরেন নিঃস্ব হয়ে।
জানা গেছে, ক্যাসিনো দুটির নিয়ন্ত্রণ এখন দিনেশ শর্মা ও রাজকুমার নামে দুই নেপালির হাতে। তারা গ্যাম্বলিংয়ের জগতে ডন হিসেবেই পরিচিত। এদের পার্টনার দেলোয়ার নামে এক বাংলাদেশি। এ ছাড়া শক্তিশালী এই চক্রের অন্যতম সদস্য হিসেবে রয়েছেন বাবা, বল্লভ, বিজয় নামে তিন জুয়াড়ি। তারা নেপালের নাগরিক। এই চক্রটিই মূলত নিয়ন্ত্রণ করছে ঢাকার ক্যাসিনো বাণিজ্য। তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসা প্রশিক্ষিত চারশরও বেশি নেপালি জুয়াড়ি অনুমতি ছাড়াই দেশের বিভিন্ন নামিদামি রেস্টুরেন্ট ও ক্লাবভিত্তিক ক্যাসিনোয় কাজ করছেন।
আরও জানা গেছে, এই চক্রের সদস্যরা জনবহুল এলাকা টার্গেট করে প্রথমে রেস্ট্ররেন্ট বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো একটি ভবনের এক বা একাধিক ফ্লোর বা কক্ষ ভাড়া নেয়। ধীরে ধীরে সেই ব্যবসার অন্তরালে গড়ে তোলে ক্যাসিনোর র্যাকেট। জমজমাট হতেই তারা মোটা টাকার বিনিময়ে অন্য কারো কাছে সেটি হস্তান্তর করে নতুন ভবন টার্গেট করে। একই পদ্ধতিতে সেখানে গড়ে তোলে লাস ভেগাসের আদলে বিশাল জুয়ার আখড়া। এভাবে তারা রাজধানীতেই অর্ধশতাধিক ক্যাসিনো গড়ে তুলেছে।
প্রসঙ্গত, বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করেও নেপালি এই জুয়াড়ি চক্রের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
সূত্র জানায়, এই পুরো চক্রটিকে ছায়া দিয়ে রাখেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা। তিনিই জুয়া বাণিজ্যের মূল চাবিকাঠি। জুয়াড়িদের নিয়ে তার এই র্যাকেট পুরো রাজধানীজুড়ে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন