আধুনিক সমাজে মানুষের জীবনের গতি দিন দিন বেড়েই চলেছে। বেড়ে চলেছে স্বপ্ন দেখা মানুষের সংখ্যা, স্বপ্নেরও সংখ্যা। স্বপ্নের মতো করে মানুষ জীবনকে দ্রুত সম্পন্ন করতে চায়। এই চাহিদা থেকেই জীবন পরিচালিত করতে যা যা মানুষের প্রয়োজন তার সব কিছু দ্রুত করতে বিশ্বজুড়ে চলছে নিরলস প্রচেষ্টা। জীবনকে আরো বেগবান দেখতে তৈরি হচ্ছে দ্রুতগতির ইন্টারনেট, দ্রুতগতির ট্রেন, দ্রুতগতির বাস, দ্রুতগতির বিমান, জাহাজ, নৌকা, স্টিমার ও লঞ্চ। তৈরি হচ্ছে দ্রুতগতির বন্দর, ব্রিজ, কালভার্ট, সেতু, রাস্তা ও পথঘাট। কেননা মানুষের হাতে সময় খুবই কম। এই কম সময়ে মানুষ দ্রুত পৌঁছাতে চায় সফলতার শীর্ষে। ১০ ঘণ্টার কাজ এখন মানুষ এক ঘণ্টায় করতে চায়। ১০ দিনের পথকে মানুষ এক দিনে নিয়ে আসতে চায়। ১০ বছরের রোজগারকে ১০ দিনে নিতে চায়। ১০ বছরের অর্জিত সম্মানের সমান সম্মান এখন মানুষ ১০ মিনিটেই পেতে চায়। সেজন্য মানুষের হাতে এখন সময় খুবই কম কাজ অনেক বেশি। পথে প্রান্তরে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে কারো সাথে আলাপ করা কিংবা কারো সুখ-দুঃখের কথা শোনার মতো সময় কোথায়? নিজেকে নিয়েই সবাই ব্যস্ত। কে কার আগে পৌঁছবে জীবনের চরম সাফল্যে, চলছে তারই প্রতিযোগিতা। অসম এই প্রতিযোগিতায় নেমে মানুষ হারিয়ে ফেলেছে হিতাহিত জ্ঞান, ন্যায়-অন্যায় বোধ। বিসর্জন দিয়েছে বিচার-বিবেক, ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ, সীমা-পরিসীমা। সততা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মতো অমূল্য সম্পদ পায়ে ঠেলে মূল্যহীন বস্তুকে কাছে টানার অদম্য স্পৃহা মানুষকে তৈরি করছে আত্মঘাতী রূপে। সে কারণে দিন দিন বেড়ে চলেছে অনাচার, অপ্রীতি ও অকল্যাণ। মানুষ পরাজিত হচ্ছে অসত্যের কাছে। মানবপ্রেম, দেশপ্রেম এখন তথাকথিত সেকেলে।
আকাশছোঁয়ার ইচ্ছা নিয়ে জীবনের গতি যখন প্রতিনিয়ত বাড়ছে তখন মেগাসিটি ঢাকার অলিগলি রাস্তাঘাটের গতি ক্রমেই কমে আসছে। নগরজীবনে বসবাস করা সদাব্যস্ত মানুষ ছুটে চলা স্বপ্নকে মোকাবেলা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ঢাকা সিটির নতুন-পুরনো সব পথঘাটে। নিরুপায় স্বল্পপরিসরের অল্প পরিমাণের এই পথঘাট প্রায় প্রতিদিনই ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে উন্নয়নের সিজারিয়ানে। সিজারিয়ানের সেই ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া পথঘাটের গতি অস্বাভাবিকভাবে যে কমে যাচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। ঢাকা সিটির রাস্তাঘাটে ছুটে চলা যানবাহনের গড় গতি এখন ঘণ্টায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটারেরও কম। জীবনের গতি যেখানে হাজার কিলোমিটার, সেখানে বাহনের গতি মাত্র সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার। এমন অসম গতিতে বাহনে বসে জীবনের উপলব্ধি কতটা অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
নাগরিক জীবনের গতির সাথে ঢাকার রাস্তার গতি সমানুপাত করার নিমিত্তে নানাবিধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা রয়েছে। সেসব পরিকল্পনার একটি হলো উড়াল সেতু। সুন্দর সুন্দর নকশা নিয়ে উড়াল সেতু পাখা মেলেছে রাস্তার ওপর। দৃষ্টিনন্দন নয়নাভিরাম উড়াল সেতু গ্রামগঞ্জ থেকে ঢাকায় বেড়াতে আসা মানুষের মন কেড়েছে নিমেষেই। পাবলিক বাসে চড়ে উড়াল সেতুর নিচে জ্যামে আটকা পড়ে দর্শনার্থী ও কৌতূহলী সরল মানুষের সুযোগ হয় উড়াল সেতুকে কাছ থেকে দীর্ঘক্ষণ ধরে ছুঁয়ে দেখার। গ্রামের মানুষ এসব সেতু দেখে আর মনে মনে ভাবে, এত বড় বড় সেতু! চোখের সামনে এ দেশের কত উন্নতি ভাবাই যায় না। এসব সরলমনা মানুষের মাথায় আসে না যে, সেতুর নিচে রাস্তা (এই উড়াল সেতুর কারণে) কতটা ঘিঞ্জি অন্ধকার আর সঙ্কীর্ণ হয়েছে। ঢাকা দেখতে আসা ওইসব মানুষের মাথায় এটা কখনোই কাজ করে না যে, এই উড়াল সেতুর সুবাদে ৩ ঘণ্টার জ্যামে আটকা পড়া লোকজনের ১ ঘণ্টা সময়েরও সাশ্রয় হয়নি; বরং উড়াল সেতুর কারণে সূর্যের আলো না পড়ায় নিচের রাস্তা বৃষ্টির পানিতে একবার ভিজলে তা শুকাতে অপেক্ষা করতে হয় কয়েক দিন। বৃষ্টিভেজা এই স্যাঁতসেঁতে রাস্তা কর্দমাক্ত হয়ে গাড়ির গতি আরো স্থবির করে তোলে। তখন পাবলিক বাস আর রিকশায় যাতায়াত করা কর্মজীবী মানুষদের ক্ষোভ, ঘৃণা আর হতাশা আছড়ে পড়ে ধাক্কা খায় উড়াল সেতুর কংক্রিটে। কী লাভ হলো উড়াল সেতু দিয়ে? যে সেতু দিয়ে ৫ শতাংশ গাড়ি আর ৩ শতাংশ মানুষও চলাচল করে না সেই সেতুর জন্য ব্যয় করা হাজার হাজার কোটি টাকা কারা নিয়ে গেল? এসব সেতু তৈরির কাজ করে কার কার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো? যাদের হলো, তাদের কী একবারের জন্যও ভাবা উচিত ছিল না যে, তারা যেটা করতে যাচ্ছে সেই উড়াল সেতু দিয়ে ঢাকাবাসীর যানজট সমস্যার কোনো সমাধানই আসবে না? টাকা আর ক্ষমতার কাছে দেশপ্রেম, মানবপ্রেম সত্যিই কি তথাকথিত সেকেলে হয়ে গেল?
রাষ্ট্রীয় সম্পদ জনগণের সম্পদ। চোখে ধুলা দিয়ে এই সম্পদ লুটপাট করার জন্য বহু লোক ওঁৎ পেতে থাকতে পারে। ওঁৎ পাতা লোকদের ব্যাপারে সতর্ক থাকা দেশপ্রেমিক ক্ষমতাবান রাজা-বাদশাদের কাজ। ভুলভাল বুঝিয়ে রাজার মাথা নষ্ট করে দিতে পারে, এমন লোকদের প্রতিরোধ করা মন্ত্রীদের কাজ। উড়াল সেতুর কার্যকারিতা দেখে মনে হতে পারে রাজা ও মন্ত্রী উভয়কেই ভুলভাল বোঝানো হয়েছে অথবা রাজা ও মন্ত্রী ইচ্ছে করেই এমন ভুলের শিকার হয়েছেন। উড়াল সেতুর পরিকল্পনা যারা এঁকেছিলেন, তাদের বুদ্ধিতে কেন আসেনি যে উড়াল সেতুর পিলারগুলো সেতুর নিচের রাস্তার অর্ধেকটা খেয়ে ফেলবে। কেন পঁচানব্বই শতাংশ মানুষের পেশা ও কর্মকাণ্ডকে পর্যবেক্ষণ না করে উড়াল সেতুর নকশা তৈরি হলো? কেন ভাবা হলো না রাস্তার পাশে গড়ে ওঠা দোকানপাট, অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছাতে এক বা দেড় কিলোমিটার পথ যেতে নিশ্চয়ই কেউ চার-পাঁচ কিলোমিটার পথের উড়াল সেতু দিয়ে ঘুরে আসবেন না? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। যারা এই নকশা অনুমোদন দিলেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও নেই। সেজন্যই হয়তো উড়াল সেতু ঢাকার শোপিস হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেভাবেই থাকবে হয়তো আরো বহুকাল কিন্তু সাধারণ মানুষ নিজেদের প্রয়োজনেই উড়াল সেতু পরিত্যাগ করে সাবেক রাস্তাগুলো ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে থাকবে অনন্তকাল।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন