হাজারীবাগ খাল দুই পাড়ের বসতবাড়ির আবর্জনা ও পয়োবর্জ্য এসে মিশছে খালের পানিতে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ
ঢাকা মহানগর এলাকায় ৫৮টি খাল চিহ্নিত করেছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। এর মধ্যে ৩৭টি খালের অংশবিশেষ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (রাজউক) তিনটি সরকারি ও সাতটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল এবং ২৪৮ জন ব্যক্তি দখল করে নিয়েছে। ফলে খালগুলোর প্রবাহ আর স্বাভাবিক নেই।
জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২২টি খালের মধ্যে একমাত্র ধোলাইখালের একটা অংশ (সূত্রাপুর লোহারপুল থেকে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত) ও মেরাদিয়া খাল সচল আছে। বাকি সবগুলো খালের জায়গায় এখন রাস্তা। প্রতিবেদনে এমনটা বলা হলেও নন্দীপাড়া খাল এখনো সচল আছে। প্রবাহ আছে কুতুবখালী খালেও।
জেলা প্রশাসন তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, যে খালগুলো এখনো টিকে আছে সেগুলোর অধিকাংশ ময়লা-আবর্জনার চাপে স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখতে পারছে না। দ্রুত উদ্ধার না করলে সেগুলোও হারিয়ে যাবে।
ঢাকার জেলা প্রশাসন খালগুলোর বর্তমান অবস্থা নিয়ে সরেজমিন প্রতিবেদনটি তৈরি করে গত বছর। জানতে চাইলে ঢাকার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেদনে খালগুলোর বর্তমান অবস্থা, খালের মালিকানা কার, অবৈধ দখলদার কারা, খালের কতটুকু অংশ বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে, খালের কোন কোন জায়গায় আবর্জনা, কোন খাল সচল আর কোন খাল অচল সব তথ্য যুক্ত করা হয়েছে। খাল যাতে উদ্ধার করা যায় সে জন্য প্রতিবেদনটি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, খাল উদ্ধারের ব্যাপারে জেলা প্রশাসনও ঢাকা ওয়াসা, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে।
মিরপুর সার্কেলের বাউনিয়া খালের একাংশ ভরাট করে ফেলেছে রাজউক। একইভাবে আবদুল্লাহপুর খাল এবং দিয়াবাড়ি খালের কিছু অংশও ভরাট করেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, দিয়াবাড়ি খালের ভরাট অংশ রাজউকের উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পে ঢুকে গেছে।
খাল দখল করার কথা স্বীকারও করেছেন রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারিনি এগুলো খাল। ওয়াসা অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে আমাদের বলে আসছিল। তবে সেখানে বালু ভরাট করা হয়েছে। এখন ওয়াসার সঙ্গে এ ব্যাপারে আপস হয়েছে। আমরা আবার নতুন করে খাল খনন করে দিচ্ছি।’
এ ছাড়া দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার জিরানী (নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী) খাল দখল করে জেলা পরিষদ মার্কেট গড়ে তুলেছে।
দ্বিগুণ খাল চালু থাকলেও খালের গোড়ান-চাটবাড়ি অংশে মাহবুব উল্লাহ নামের এক ব্যক্তি আননামী ড্রিমস পার্কের সাইনবোর্ড টানিয়ে দখল করেছে। আর গোড়ান-চাটবাড়ি অংশে রাধাকৃষ্ণ মন্দির কর্তৃপক্ষ খাল দখল করেছে বলে জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
রামচন্দ্রপুর খালের জায়গা দখল করেছে বেশ কটি আবাসন প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো নবীনগর হাউজিং, জেমকন সিটি, মোহাম্মদী হাউজিং, রাজধানী উদ্যান।
জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তর সিটি করপোরেশনের বড় চারটি খাল বা খালের অংশবিশেষ বালু ফেলে ভরাট করেছে বসুন্ধরা গ্রুপ। খালগুলো হলো ভাটারা, ডুমনী, বোয়ালিয়া ও জোয়ারসাহারা-কাঠালদিয়া খাল। এর মধ্য ডুমনী খালটি পুরোপুরি অচল।
বোয়ালিয়া খালের আরেক দখলদার বাংলাদেশ পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতি। ৩০০ ফুট রাস্তার সেতু থেকে খিলক্ষেত ইছাপুরা রাস্তার সেতু পর্যন্ত দুই পাশ দখল করেছে তারা। জেলা প্রশাসন বসুন্ধরা ও পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতিকে নোটিশ দেওয়ার সুপারিশ করেছে।
ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. মেসবাহুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘খালের দায়িত্ব ওয়াসা ও জেলা প্রশাসনের। খালের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তারপরও মেয়র মহোদয় সমন্বয়কের দায়িত্ব পাওয়ার পর খাল উদ্ধারের প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমরা যুক্ত হয়েছি। বৈঠক করছি।’
খাল উদ্ধার প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী ফরাজী শাহাবউদ্দীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দক্ষিণ সিটির কয়েকটি খাল বেদখল রয়েছে। তার তালিকা আমাদের কাছে আছে। এসব খাল উদ্ধারের জন্য জেলা প্রশাসন ও ওয়াসার সঙ্গে বৈঠক হয়েছে।’
সব খালের মালিক জেলা প্রশাসন। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ২৬টি খাল বুঝে নিয়েছি। সেগুলো আমরা দেখভাল করছি। এর বাইরের খালগুলো আমরা এখনো বুঝে নিইনি।’
প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বক্তব্যে খাল নিয়ে ঠেলাঠেলির চিত্র স্পষ্ট। এ অবস্থায় করণীয় কী জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ঢাকার সব খালের মালিকানা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে দিয়ে দিতে হবে। কারণ জনপ্রতিনিধির কাছে খালের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব না থাকলে সহজে বর্তমান অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটবে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন