২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেছিল ফ্যাসিবাদি শেখ হাসিনার সরকার। অপরদিকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবীতে প্রায় সব রাজনৈতিক দল রাজপথে আন্দোলনে। সারা দেশ অচল বিরোধী দলের কর্মসূচিতে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদি সরকার তখন মরিয়া আন্দোলন দমন ও একতরফা নির্বাচন আয়োজনে। নির্বাচনের আগেই ১৫৪ আসনে বিজয়ী শেখ হাসিনার মনোনীতরা। সরকার গঠন করতে প্রয়োজন ছিল ১৫১ আসন। অথচ, নির্বাচনের প্রার্থী বাঁছাই পূর্বেই শেখ হাসিনা ১৫৪ জন বিজয়ী। কারণ অন্য কোন দলের কেউ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। নির্বাচনের নামে এই প্রহসনের বিরুদ্ধে রাজপথে বিরোধী দলগুলো। অপরদিকে আন্দোলন দমনে তখন র্যাব, পুলিশ, ডিবিসহ আইন শৃঙ্খলারক্ষাকরী অন্যান্য রাষ্ট্রীয় বাহিনী গুলোকে ব্যবহার করছেন শেখ হাসিনা। জনগনের টাকায় পরিচালিত রাষ্ট্রীয় বাহিনী গুলোকে লেলিয়ে দেওয়া হয় জনগনের বিরুদ্ধে। টার্গেট করে শুরু হয় ধরে নিয়ে গুম অথবা বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা। আমাদের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে ওই নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার গুম-খুনের রাজনীতির শিকার ছাত্রদল নেতা সেলিম রেজা পিন্টুর ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে আজ।
২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাস। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে দেশব্যাপি আন্দোলন তুঙ্গে। রাজধানী থেকে পুরো দেশ বিচ্ছিন্ন। এমন এক পরিস্থিতিতে ১১ ডিসেম্বর (২০১৩) রাতে ঢাকার মিরপুরের একটি বাসা ঘিরে ফেলে সাদা পোশাকে পুলিশ। সবার সঙ্গেই আগ্নেয়াস্ত্র। অস্ত্রধারীরা এসেছিলেন সিলভার রঙের মাইক্রোবাস নিয়ে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিচয়পত্র ছিল তাদের সঙ্গে।
রাত প্রায় ১টা বাজে তখন। মিরপুর-১২ নম্বরের ৯ নম্বর রোডের ৫ নম্বর বাড়িটির তৃতীয় তলায় উঠে পড়েন ডিবি পরিচয়ধারী লোকেরা। মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে সজোরে দরজার কড়া নাড়তে থাকেন ডিবির সদস্যরা।
ভেতর থেকে পরিচয় জানতে চাওয়া হয়, 'আপনার কারা?'
বাইরে থেকে জবাব, 'আমরা প্রশাসনের লোক। দরজা খোলেন'।
ওই বাড়িতে অসুস্থ ছাত্রদল নেতা সেলিম রেজা পিন্টু অবস্থান করছিলেন। এটা তাঁর ভাইয়ের বাড়ি। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুম বা বিচারবহির্র্ভূত হত্যা থেকে রেহাই পেতেই নিজের বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন ভাইয়ের বাসায়। শেষ পর্যন্ত রক্ষা হয়নি তাঁর।
সেই রাতেই ডিবির লোকেরা কালো কাঁচের একটি সিলভার রঙের মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় সূত্রাপুর থানা ছাত্রদল সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুকে। এরপর থেকে আর সন্ধান মেলেনি এই ছাত্রদল নেতার।
ওই বছর রাজধানীর প্রতিশ্রুতিশীল অনেক ছাত্র নেতাকে গুম করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও র্যাব। গুম হওয়া সেই সব তরুণদের খোঁজ আজও মেলেনি। গুম হওয়া তরুণদের ফিরে আসার অপেক্ষায় আছেন স্বজনরা। পরিবারের সদস্যরা পথ চেয়ে থাকেন। এই বুঝি আসছে তাদের আপন লোকটি। এমনি পথ চেয়ে থাকতে থাকতে পুত্র শোকে মারা গেছেন অনেকের বৃদ্ধ বাবা-মা।
পিন্টুর পরিবারের আকুতি, প্রধানমন্ত্রী আপনি পিন্টুকে ফেরত দেন:
ভয়াবহ সেই রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে গণমাধ্যমের কাছে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন সূত্রাপুর থানা ছাত্রদল সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুর বড় বোন রেহেনা বানু মুন্নি।
রেহেনা বানু মুন্নি জানান, যেদিন পিন্টুকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, সেদিন খুব অসুস্থ ছিলেন তাঁর ভাই।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি আরো বলেন, পিন্টু ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী। সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি। রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন সব সময়। ফ্যাসিবাদি সরকারের পুলিশ তাড়িয়ে বেড়াত তাঁকে। পুলিশ ও র্যাবের ভয়ে পিন্টু পালিয়ে আরেক ভাইয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। সেই ডিবি পরিচয়ে বাসায় মধ্যরাতে হাজির হলেন একদল অস্ত্রধারী। পরিচয় জানতে চাইলে তারা জবাব দিলেন-‘আমরা প্রশাসনের লোক। দরজা খোলেন’।
দরজা খোলার পরও আমার আরেক ভাই মিন্টু তাদেরকে প্রশ্ন করেন ‘আপনারা কারা’?
তারা আবারো বললেন, ‘আমরা সরকারি প্রশাসনের লোক। আমাদের কাছে সব পরিচয়পত্র আছে। সেলিম রেজা পিন্টু কোথায়?’
‘আমার ভাই (পিন্টু) তখন খুব অসুস্থ ছিল। লুঙ্গি পরা ছিল। সেই অবস্থাতেই তারা আমার ভাইকে নিয়ে যায়। স্যান্ডেলও পরতে দেয়নি। আরেক ভাই মিন্টু প্রশ্ন করে আপনারা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? তারা বলেন, আপনাদের চিন্তার কিছুই নাই। আমরা সরকারি প্রশাসনের লোক। পরে আপনাদের সাথে আবার দেখা হবে। নিয়ে যাচ্ছি, সমস্যা নাই। আপনাদের ভয়ের কিছুই নাই। এরপর থেকে তো আর তার কোনো খোঁজ নাই’।
অঝোরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সাত বছর ধরে ভাইয়ের খোঁজ করা হতভাগ্য এই বোন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আরো বলেন, ' প্রধানমন্ত্রী আপনি আমার ভাইকে বের করে দেন! ভাইটাকে আপনারা ফিরাইয়া দেন। আমার ভাইকে কারা নিসে? আপনি এটা তদন্ত করে বের করেন। এই দেশের নাগরিক সে। সে কোথায় আছে? সে বেঁচে আছে না মরে গেছে। মাটির উপর আছে, না মাটির নিচে আছে?’
পুত্রশোকে বাবার মৃত্যু:
প্রিয় পুত্রের খোঁজে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে যায়নি বাবা। সেলিম রেজা পিন্টুর বাবা সোলাইমান রেজা। ডিবি পরিচয়ে তুলে নেয়ার পর ছেলের খোঁজে ঘুরে বেড়িয়েছেন গোয়েন্দা দফতরে। আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী গুলোর এক দফতর থেকে আরেক দফতরে গেছেন। ফেরত চেয়েছেন পুত্রকে। কোথায়ও যাওয়া বাদ রাখেননি। স্থানীয় থানায়ও গেছেন প্রিয় পুত্রের খোঁজে বারবার।
পিন্টুর সন্ধানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের কাছে ধরনা কোনো ফল পাননি হতভাগ্য পিতা।
পুত্রশোকে একসময় মুহ্যমান এই বৃদ্ধ বাবা আর ছেলের মুখ দেখতে পেলেন না। গুম হওয়া ছেলের শোকে অনেক দিন অসুস্থ থাকার পর ২০২০ সালের ২২ এপ্রিল মারা যান তিনি।
সেলিম রেজা পিন্টুর বোন মুন্নি জানান, রাজধানীর সুত্রাপুর এলাকায় নিজ বাসভবনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তার বাবা। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর।
গুমে জড়িত কারা?
কুখ্যাত ওয়ান-ইলেভেনের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে 'গুম' সংস্কৃতি ঝেঁকে বসে। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় মরিয়া শেখ হাসিনা। তাঁর শাসনামলে গুমের সংস্কৃতি উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যায়। গুম হওয়া নেতা-কর্মীদের অধিকাংশই বিএনপিসহ ১৯-দলীয় জোটের শরীক দল গুলোর নেতা-কর্মী।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা পরবর্তীতে যে তথ্য দিয়েছেন, তা বিশ্লেষণ করা জানা গেছে যে এসব গুমের সাথে সরাসরি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জড়িত। কোনো কোনো গুমের ঘটনায় বাহিনীর নির্ধারিত পোশাক পরে আসলেও, কিছু ঘটনায় সাধারণ পোশাকেই গুম করা হয়েছে। প্রকাশ্যে এসব গুমের জড়িতদের অত্যাধুনিক অস্ত্র ও পরিচয়পত্র বহন করতে দেখা গেছে। তবে, গুমের পর বরাবরের মতোই বেমালামু অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত বাহিনীর দায়িত্বরত কর্মকর্তারা।
শেখ হাসিনার পুরো শাসন আমল জুড়েই বাংলাদেশে গুম বা বলপূর্বক অন্তর্ধান জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক, উদ্বেগ আর নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে।
এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছেন যে, বিশেষ বাহিনী র্যাব, ডিবি পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে সাদা পোশাকে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের তুলে নেওয়া হচ্ছে; কিন্তু প্রায়শ সংশ্লিষ্ট বাহিনী তাদের গ্রেফতার বা আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে থানা এসব ঘটনায় কোনো অভিযোগ নেয় না। স্বজনরা জিডি করতে গেলেও কোনো বিশেষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম, যারা ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তাদের নাম উল্লেখ করে জিডি করা যায় না।
রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গুম হওয়া এসব মানুষের বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য কোনো তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। ফলে এতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, বিরোধী দলের নেতা-কর্মী ও বিরোধী মতকে দমন করতে খোদ রাষ্ট্রই এসব বাহিনীকে ব্যবহার করে দিনের পর দিন গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপকর্মে লিপ্ত।
আওয়ামী লীগপন্থী মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০০৭ সাল থেকে ২০২০ সালের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন। গুম হওয়াদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে পাওয়া গেছে ৭৮ জনের লাশ।
এছাড়া, ৮৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন ফেরত এসেছেন। কিন্তু, বাদবাকিদের সন্ধান মেলেনি আজও।
গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের গড়া সংগঠন 'মায়ের ডাক’ এর তথ্য মতে, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের এ পর্যন্ত ৫৩৮ জন নিখোঁজ হয়েছেন। তবে অনেক দিন পর ৩০০ জন ফিরে এসেছেন। ৬৮ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও ১৭০ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ:
২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর গুম হওয়া থেকে সব ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য আন্তর্জাতিক সনদ জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রটেকশন অব অল পারসন্স অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়্যারেন্স এই আন্তর্জাতিক সনদ কার্যকর হয়। তাতে ৩০ আগস্টকে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস ঘোষণা করা হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। যার ফলে গুমের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয় এবং কাউকে গুম করে দেওয়া মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃতি পায়। See Less
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন