এন আই অ্যাক্টে দায়ের করা একটি মামলায় আদালতে সাজাপ্রাপ্ত পলাতক এক আসামিকে গ্রেফতারের পর ‘ঘুষের বিনিময়ে’ ছেড়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে বনানী থানা পুলিশের বিরুদ্ধে। বাদীর উপস্থিতিতে ওই আসামিকে গ্রেফতার করা হলেও তাকে আদালতে না পাঠিয়ে মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, এমন অভিযোগ করেছেন এ মামলার বাদী। তবে বাদীর এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে বনানী থানা।
শনিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ১২টায় বাদী মোমেনা আক্তার বিথীর সহায়তায় রাজধানীর বনানীর দুই নম্বর সড়কের চার নম্বর বাসার একটি ফ্ল্যাট থেকে সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি মাহমুদুল হাসান শুভ ওরফে মাহমুদুলকে গ্রেফতার করে বনানী থানা পুলিশ। এটি শুভ’র শ্বশুরের বাসা। গ্রেফতারের পর শুভকে বাদীর সামনেই বনানী থানা হাজতে রাখা হয়। রবিবার (২০ সেপ্টেম্বর) সকালে তাকে আদালতে পাঠানো হবে বলে জানায় পুলিশ। কিন্তু তাকে আদালতে না পাঠিয়ে ছেড়ে দেয় বনানী থানা পুলিশ। আসামিকে ছেড়ে দেওয়ার পর আসামির বাবা মোফাজ্জল হোসেন বাদী মোমেনা আক্তার বিথীকে মোবাইল ফোনে বলেন, ‘বনানী থানায় নয় লাখ টাকা দিয়ে তিনি তার ছেলেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছেন। পুলিশ কেনা তার ওয়ান- টু ব্যাপার।’
বাদী মোমেনা আক্তার বিথী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাহমুদুল হাসান শুভ’র গ্রামের বাড়ি জামালপুরের মুক্তাগাছায়। রাজধানীর একটি ফাইভ স্টার হোটেলে সে চাকরি করতো। এক আত্মীয়ের মাধ্যমে তার সঙ্গে আমাদের পরিবরের পরিচয় হয়। তার বাবাও একটি বাহিনীর অবসর প্রাপ্ত কর্মকর্তা। শুভ তার গ্রামের বাড়িতে খামাড় করবে বলে আমাদের কাছ থেকে ৬০ লাখ টাকা নেয়। আমি আরেক আত্মীয়ের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা লোন নিয়ে ২০১৯ সালের মে মাসে তাকে মোট ৬০ লাখ টাকা ক্যাশ দেই। কিন্তু সেই টাকা সে ফেরত দেয়নি। আমাকে ঘুরাতে থাকে। পরবর্তীতে সে তার ঠিকানা পরিবর্তন করে আত্মগোপনে চলে যায়। এরপর আমি তাকে খুঁজে বের করি। সে আমাকে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের একটি চেক দেয়। কিন্তু টাকা তুলতে গিয়ে দেখি তার ব্যাংকে কোনও টাকা নাই। ২০১৯ সালের ২ জুলাই চেক ডিসঅনার হয়। এরপর আমি তাকে ৭ জুলাই উকিল নোটিশ দেই। তার জবাবের পর ২০ আগস্ট আমি ঢাকার আদালতে এনআই অ্যাক্টে মামলা করি। সে টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জামিন নিয়ে পালিয়ে যায়। আদালত তাকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ৬০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়। এরপর থেকে সে প্রায় একবছর ধরে পলাতক। বহু কষ্টে আমি ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে তার খোঁজ পাই। এরপর বনানী থানা থেকে পুলিশ নিয়ে গিয়ে তার শ্বশুরের বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করাই। সেই আসামিকে বনানী থানা পুলিশ কোর্টে না পাঠিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।’
শুভকে গ্রেফতারের পর বনানী থানা পুলিশ ২০ সেপ্টেম্বর তাকে কোর্টে পাঠানোর কথা বললেও ওইদিনই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কোর্টে না পাঠিয়ে কেন আসামিকে ছেড়ে দেওয়া হলো, বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরে আজম মিয়ার কাছে তা জানতে চান বাদী মোমেনা আক্তার বিথী। তবে বনানী থানার ওসি তার ফোন রিসিভ করেনি। বাদী বিথী বলেন, ‘আমি ওসিকে অনেকবার ফোন দিয়েছি। মেসেজ করেছি, কোনোটিরই তিনি জবাব দেননি। এরপর আমি রবিবার দুপুরে থানায় লোক পাঠাই, তারাও গিয়ে দেখেন— আসামি থানায় নেই। আসামির বাবা আমাকে ফোনে গালিগালাজ করেছেন। তিনি বলেছেন, ৯ লাখ টাকা দিয়ে থানা থেকে তার ছেলেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছেন।’
আসামি ছেড়ে দেওয়ার পর বাদী মোমেনা আক্তার বিথীর সঙ্গে কয়েক দফায় কথা বলেছেন বনানী থানার পুলিশ কর্মকর্তারা। রবিবার (২০ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় ছয়টার দিকে বনানী থানার পরিদর্শক (অপারেশনস) ফাইয়ান ওয়ালিউল্লাহ মোমেনা আক্তারকে ফোন দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে সামনা-সামনি কথা বলতে চান বলে তাকে বনানীর আড়ংয়ের আউট লেটের পাশে যেতে বলেন। মোমেনা আক্তার সেখানে যান। যাওয়ার পর তারা সেখানে কথা বলেন। এই পুলিশ কর্মকর্তা তাদের দোষ স্বীকার করে বাদীর কাছে ক্ষমা চান। এসময় বনানী থানার ওসি নূরে আযম মিয়ার সঙ্গে হোয়াটসআপে মোমেনা আক্তারকে কথা বলিয়ে দেন পরিদর্শক ফাইয়ান ওয়ালিউল্লাহ। মোমেনা আক্তার বলেন, ‘ওসি আমাকে ফোনে বলেন, সোমবার ভোর ছয়টার মধ্যে আসামি শুভকে গ্রেফতার করিয়ে দেবেন। একটু সময় চান তারা।’
তবে সোমবার (২১ সেপ্টেম্বর) পুলিশ আর শুভকে গ্রেফতার করেনি। সোমবার সকালে আসামি শুভ নিজেই গিয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। ৩০ লাখ টাকা আদালতে জমা দিয়ে জামিন নেন।
বনানী থানা থেকে শুভকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন তার বাবা মোফাজ্জল হোসেন। এই প্রতিবেদক তাকে এবিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তার ছেলেকে শনিবার রাতে গ্রেফতার করা হয়েছিল, পরবর্তীতে থানা থেকে তাকে তিনি ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন।’ যখন তাকে পাল্ট প্রশ্ন করা হয়, সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে গ্রেফতারের পরতো পুলিশ থানা থেকে ছাড়তে পারে না, কীভাবে নিয়ে আসলেন তাকে, তখন তিনি তার কথা পাল্টে বলেন, ‘ছেলে অসুস্থ ছিল। তাই নিয়ে এসেছি। পুলিশ হেফাজতেই ছিল।’
তবে মোফাজ্জল হোসেনের এ কথার সত্যতা মেলেনি। কারণ, কোনও আসামিকে পুলিশ গ্রেফতার করলে আইনানুযায়ী তাকে আদালতে পুলিশ সোপর্দ করার কথা। তবে শুভকে বনানী থানা পুলিশ আদালতে নেয়নি। শুভ নিজেই আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন। জামিন নিয়েছেন।
এবিষয়ে অভিযুক্ত বনানী থানার পরিদর্শক ফাইয়ান ওয়ালিউল্লাহর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি নাইট করেছি, ঘুমাচ্ছি।’ তবে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেননি।
ঘটনাটি বনানী থানার সব পুলিশ সদস্যরাই জানেন। পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ সোহেল রানার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়টি ওসি (অপারেশনস) জানেন। তিনি এবিষয়ে আর কিছু বলতে চাননি।’
বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আযম মিয়ার কাছে এবিষয়ে জানার জন্য কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেনি। শুভকে গ্রেফতারে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বনানী থানার এসআই শরীফুল। তার কাছে এবিষয়ে জানতে চাইলে, তিনিও কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি। তিনি থানার ওসির সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
এদিকে মামলার বাদী বাধ্য হয়ে এই ঘটনাটি পুলিশের ঊধ্বতন কর্মকর্তা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েছেন। মামলার বাদী মোমেনা আক্তার বিথীর বিরুদ্ধে আসামি শুভর বাবা মোফাজ্জল হোসেনও পাল্টা অভিযোগ করেছেন। পেশায় ঠিকাদার মোমেনা আক্তার কোনও টাকা পাবেন না বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘মোমেনা আক্তারের সঙ্গে আমার পরিচয় প্রথম। সে আমার ছেলের নামে মামলা দিয়ে আমার টাকা-পয়সা আত্মসাৎ করতে চায়। আমাদের কাছে সে কোনও টাকা পাবে না। আমার ছেলে ইনোসেন্ট। আমার ছেলের চেকে জাল স্বাক্ষর দিয়ে মোমেনা মামলা করেছে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন