শায়লা কিংবা কাকের গল্প (••বিয়ের গল্প••)

লিখেছেন লিখেছেন আবরার আদিব ১৫ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৯:১১:০৮ রাত



শায়লার যখন মাত্র চার বছর বয়স তখন থেকেই তার বউ সাজার খুব শখ। সুযোগ পেলেই মায়ের ওড়না হয়ে যায় শায়লার শাড়ি। মায়ের লিপস্টিক, আইলাইনার, কাজল চারিদিকে ছড়িয়ে বসে পড়তো সাজতে। মা দেখতে পেলেই বিপদ। বিকট চিৎকার দিয়ে উঠতো। শায়লা অবশ্য শক্ত মেয়ে সেও পাল্টা জবাব দিত, 'কেন বউ সাজা কি দোষ? তুমি কি বিয়ে করনি?' মেয়ের পাকা কথায় হয়তো সে হয়তো ফিক করে হেসে ফেলতো। কিন্তু পরক্ষণেই কঠিন মুখ করে বলত, 'যাও পড়তে বস। তুমি আর বাচ্চা নেই। তুমি এখন স্কুলে পড়। এসব খেলার বয়স আর তোমার নেই।' শায়লা বুঝতো না সে কি বড় হয়ে গেছে? তবে কি তার আসলেই বউ হবার আর দেরী নেই?

শায়লার এসব কর্মকান্ডে যে সবচেয়ে বেশী মজা পেত সে শায়লার বড়বোন শারমিন। এরকম পরিস্থিতিতে তার ত্রাণকর্তা হত শারমিন। তাকে কোলে নিয়ে বলত, 'চল তোকে পরীর মত করে সাজিয়ে দেই। এখন তো পেত্নীর মত মুখ করে রেখেছিস।' শারমিনের সাথে শায়লার এ জন্যই হয়তো অনেক বেশী ভাব। শারমিন হাসিমুখে শায়লাকে সাজাতে বসে-

'এই আপু, এত হাসবা না' শায়লা গম্ভীর মুখে বলে।

শারমিন অবাক চোখে বলে, 'কেন বল তো?'

শায়লা আগের মতই গম্ভীর মুখে বলে, 'যত বেশী হাসি, তত বেশী কান্না।'

শারমিন এবার শায়লার গাল টিপে বলে, 'তুই তো দেখি বাচ্চা ফিলোসোফার হয়ে যাচ্ছিস। এসব কথা যে তোকে কে বল?'

শায়লার কথা কিন্তু সত্যি হয়ে গেল। হঠাৎ করেই তার বোন বদলে গেছে। কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ঘরের এক কোণে বসে শুধু ফুঁপিয়ে কেঁদে যায় দিনরাত। বাসার হাওয়া যেন হঠাৎ বদলে গেছে। কেমন থমথমে। শায়লার সাথে কেউ ঠিক মত কথা বলে না। শায়লার এ ব্যাপার খুব বিরক্তি লাগে? একদিন বউ সাজতে বসেছিল সে। তার মা দেখে এবার আর কোনো ধমক দেয়নি। ঠাস ঠাস করে গালে দু'টো চড় বসিয়ে দিয়েছে। শায়লা কিন্তু তখন কাঁদে নি। চোখে তার তখনো কাজল।

বিকেল সময়টা শায়লার খুব পছন্দের। এই সময়টা সে ছাদে বেড়াতে যায়। রাস্তার পাশের বৈদ্যুতিক তারে প্রতি বিকালে যেন কাকদের মেলা বসে। শায়লা প্রতিদিন কাকগুলো গুণে ফেলে। কাকের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। এখন পর্যন্ত সে চুরাশিটি কাক হিসাব করেছে। সে এখন একশ' কাকের অপেক্ষায় আছে। কাকগুলো কিন্তু শায়লার মতই সাহসী। তাদের ভয় দেখালেও তাদের জায়গা থেকে নড়ে যায় না। ঝিম ধরে বসে থাকে। আজ তিনদিন অবশ্য তার ছাদে যাওয়া হচ্ছে না। আপুকে ছাড়া মা কোনোভাবেই ছাদে যেতে দিবে না। শারমিনের আশপাশে দিয়ে সে ঘোরাঘুরি করলো খানিক। কোনো সাড়া শব্দ নেই। তার শরীরটা খারাপ। বারে বারে বমি হচ্ছে। মায়ের কাছে চড় খাওয়ার পর তো তার কাছে আবদার করার প্রশ্নই আসে না।

শায়লা আজ সাহস করে একাই ছাদে চলে এসেছে। দরজা খোলা ছিল। এক দৌড়ে সে তাই সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সে চলে আসলো। ছাদে এসেই মন খারাপ হয়ে গেলো। কাকের সংখ্যা কমে গেছে আজ। মাত্র পঞ্চাশটা!

'এই তুই একা এসেছিস ছাদে?' পেছন থেকে কে যেন বলল। শায়লা পিছনে ফিরে দেখে জহুরা আন্টি। তাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। সবসময় মুখের ভিতরে পান থাকে তার। সবাইকেই তুই করে বলা তার অভ্যাস। শায়লার এই জন্যই এই মহিলাকে খুব অপছন্দ।

জহুরা আন্টি আবার বলল, 'তোর বোন কই? সে আসে নাই?'

শায়লা বলল, 'আপু আসেনি। তার শরীর খারাপ।'

জহুরা আন্টি নিচু স্বরে এবার বলল, 'তোর বোন নাকি পেট বাঁধায় ফেলছে।'

'পেট বাঁধাবে কেন? পেট কি বাঁধানোর জিনিস? আপনি এত বড় হয়েছেন এই সহজ ব্যপার বোঝেন না!' শায়লা গটগট করে বলল।

'তুই তো দেখি মহা বিচ্ছু। তোর বোনের যে পেটে বাচ্চা এইটা জানিস না?' জহুরা আন্টি একথা বলেই হেলতে-দুলতে চলে গেল। শায়লা বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো।

ছাদ থেকে সে তখনি ছুটে আসলো তার বোনের কাছে। সে শারমিনের কাছে জিজ্ঞাসা করল, 'জহুরা আন্টি বলল তোমার নাকি বাবু হবে? তোমার তো বিয়েই হয়নি! এই মহিলা এত মিথ্যা কথা বলে কেন?' শারমিন তাকে জড়িয়ে হঠাৎ করেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। শায়লা বুঝতে পারছে না কন্নার রহস্য কি। তার পরদিন থেকেই বাসায় লোকজনের আনাগোণা বেড়ে গেল। গম্ভীর মুখে তাদের সাথে তার বাবা-মা কিসব আলোচনা করে। শায়লাকে এসব থেকে দূরে রাখা হয়। তবে শায়লা বুঝতে পারে বড় কিছু হতে যাচ্ছে। তার মা অবশেষে তাকে বলল। তার আপুর বিয়ে হতে যাচ্ছে। মায়ের মুখ মলিন দেখালেও শায়লা তীব্র উত্তেজনা বোধ করতে শুরু করল। সে বিকালেই ছাদে গিয়ে সবগুলো কাককে বিয়ের দাওয়াত দিয়ে আসলো। ককদের অবশ্য ভাবের কোনো পরিবর্তন হল না। তারা আগের মতই ঝিম ধরে থাকলো।

বিয়ের দিন অবশ্য শায়লার মন খারাপ হয়ে গেল। সবার বিয়েতে কত মজা হয়। মানুষজনে বাসা ভর্তি সাথে উচ্চস্বরে গান বাজতে থাকে। এখানে কিছু হচ্ছে না। সামান্য কিছু তাদের আত্মীয় এসেছে। তারাও কেমন যেন মন মরা। তবে তার মন ভালো গেলো কিছুক্ষণ পরেই। পার্লার থেকে দু'জন মেয়ে সাজাতে এসেছে তার আপুকে। শায়লাকে সাজিয়ে দিল তারা। এত সুন্দর করে আগে কেউ তাকে সাজিয়ে দেয়নি। তবে তার আপুকে আজ সত্যি পরীর মত লাগছে। সে হা হয়ে তাকিয়ে দেখে তার পরী আপুকে!

'কি রে পাগলী, ওমন করে কি দেখিস?' শারমিন হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করে। অনেকদিন পর আজ শারমিন হাসছে।

'তোমাকে আজ পরীদের চেয়ে বেশী সুন্দর লাগছে, আপু। আমার বিয়েতেও কিন্তু আমি তোমার মত করে সাজব!' শায়লার কথায় আশেপাশের সবাই একটু হাসে।

বরপক্ষের আসার কথা দুপুরে। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। কেউ আসে না। বাবাকে চিৎকার করে মোবাইলে কথা বলতে শোনে শায়লা। এমন ভাবে তাকে কথা বলতে কখনো দেখেনি শায়লা। তার ভয় হয় খারাপ কিছুই হয়তো হচ্ছে। যারা এসেছিল তারা আসতে আসতে যেতে থাকে। আপুকে জড়িয়ে হু হু করে কাঁদতে দেখে শায়লা। আজ কিন্তু আপু কাদছে না। পাথরের মত শক্ত হয়ে বসে আছে শায়লাও মনে মনে চাচ্ছে আপু যেন আজ না কাঁদে। তাহলে এত্ত সুন্দর সাজ একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে যে! সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আপু এবার শীতল কন্ঠে মাকে বলল, 'মা সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তোমরা অ্যাবরশনের ব্যবস্থা কর।' মা কান্না থামিয়ে অবাক চোখে তার দিকে তাকালো। তারপর আবার কান্না শুরু করল। শায়লা এই শব্দের মানে জানে না। কিন্তু কঠিন কিছু নিশ্চই। শারমিন এবার শায়লার দিকে তাকিয়ে বলে, 'এই ছাদে যাবি?'

ছাদে এসেই শায়লার মন আবার ভালো হয়ে গেল। আজ অসংখ্য কাক। সে হয়তো গুণে সব শেষ করতে পারবে না। শারমিন ছাদের কিনারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শারমিন ছাদ থেকে ঝাপ দিল। সাথে সাথেই সব কাক একসাথে উড়ে গেল। শারমিনের রক্তাক্ত লাশের চাইতে এই কাকগুলোই শায়লাকে অনেক বেশী অবাক করল। সে অবাক চোখে রক্তিম আকাশে কাকদের উড়ে যাওয়া দেখতে থাকলো!

বিষয়: বিয়ের গল্প

২১৭১ বার পঠিত, ২৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

162924
১৫ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ১১:২১
চোথাবাজ লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ . দারুন্স
১৬ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ১২:২৩
117257
আবরার আদিব লিখেছেন : মন্ত্যবের জন্য ধন্যবাদ! Happy
162947
১৬ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ১২:১৩
সকাল সন্ধ্যা লিখেছেন : কিভাবেন এমন করে ভাবেন? ভাবনাগুলি সবার দিরস্টি আকরশ্নের দাবিদার।ধন্যবাদ।
১৬ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ১২:২৯
117259
আবরার আদিব লিখেছেন : ভাবনাগুলো এসে যায়। এমন ঘটনা তো আমাদের অচেনা না! প্রতিনিয়তই ঘটে যাচ্ছে।
163051
১৬ জানুয়ারি ২০১৪ সকাল ১০:৩১
১৬ জানুয়ারি ২০১৪ সকাল ১১:১৪
117369
আবরার আদিব লিখেছেন : Worried Worried Worried
163073
১৬ জানুয়ারি ২০১৪ সকাল ১১:১৪
আলোকিত ভোর লিখেছেন : Sad Sad Sad
১৬ জানুয়ারি ২০১৪ সকাল ১১:২৭
117375
আবরার আদিব লিখেছেন : Yawn Yawn Yawn
163094
১৬ জানুয়ারি ২০১৪ দুপুর ১২:০৮
রাইয়ান লিখেছেন : ভালো লেগেছে লেখাটি, অনেক ধন্যবাদ । Sad Sad Happy
১৬ জানুয়ারি ২০১৪ দুপুর ১২:২৫
117386
আবরার আদিব লিখেছেন : আপনার মন্ত্যবের জন্য ধন্যবাদ। শুভকামনা থাকল!
163097
১৬ জানুয়ারি ২০১৪ দুপুর ১২:১৯
শুকনোপাতা লিখেছেন : খুব সুন্দর গল্প। বাস্তবতা কেবল হাসতে শেখায় না,হাসির আড়ালের কান্নাটা কেও বুঝতে শেখায়।
১৬ জানুয়ারি ২০১৪ দুপুর ১২:২৬
117388
আবরার আদিব লিখেছেন : বাস্তবতায় হয়তো হাসির চেয়ে কান্নার পরিমান অনেক বেশী!
163363
১৬ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ১১:৫২
সূর্যের পাশে হারিকেন লিখেছেন : Sad Sad Not Listening Not Listening
গল্প কিন্তু খুব সুন্দর হইছে Music Music
১৭ জানুয়ারি ২০১৪ সকাল ১১:৩৪
117753
আবরার আদিব লিখেছেন : কান চেপে ধরে রেখে কি হবে আর ভাই! এটাই তো বাস্তব! Worried Worried Worried

মন্ত্যবের জন্য ধন্যবাদ!
163389
১৭ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ১২:৪৭
বৃত্তের বাইরে লিখেছেন : ভালো লাগলো আপনার ভাবনাগুলো Good Luck Rose
১৭ জানুয়ারি ২০১৪ সকাল ১১:৩৪
117754
আবরার আদিব লিখেছেন : আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ!
165921
২২ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ০৮:২৯
মোঃজুলফিকার আলী লিখেছেন : অনেক সুন্দর। পড়ে ভাল লাগলো। ধন্যবাদ।
২৩ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ০৮:৩৮
120547
আবরার আদিব লিখেছেন : আপনার মন্তব্যের জন্য ভালোলাগা! Angel Angel Angel
১০
166479
২৩ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ১০:০৬
প্রবাসী আব্দুল্লাহ শাহীন লিখেছেন : ভালো লাগলো , অনেক ধন্যবাদ Rose Rose
২৩ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ১০:২৫
120603
আবরার আদিব লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ প্রবাসী ভাই! Happy Happy Happy
১১
176097
১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ০৫:৩৬
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ১১:০২
130238
আবরার আদিব লিখেছেন : আপনার লেখা পড়ে মজা পেলাম! তবে একটি লেখা যারা লেখেছে তাদের খানা-খাদ্য আরো উন্নত হওয়া দরকার ছিল।
১২
181882
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০৩:৫০
নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা লিখেছেন : বেশ ভালো লাগলো। বাস্তবতা মাঝে মাঝে কত যে নির্মম হয়। অনেক ধন্যবাদ ও শুভ কামনা রইলো।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File