@বাবা আদমের অভিশাপ ও রাজা বল্লাল সেন@

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ২৪ জুন, ২০১৭, ১২:৪৩:২৩ দুপুর

@বাবা আদমের অভিশাপ ও রাজা বল্লাল সেন@

পিতার মৃত্যুর পর ১১৫৮ সালে বল্লাল সেন আরোহণ করেন বাংলার সিংহাসনে। তিনি ছিলেন গোড়া হিন্দু। ধর্মের মধ্যে ব্ৰাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য প্রভৃতি কৌলিন্যের প্রথা বাংলাদেশে তিনিই প্রবর্তন করেন প্রথম। তার শাষন আমলে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব বিনষ্ট হয় । সমগ্ৰ অঞ্চল থেকে ক্ৰমান্বয়ে বিলুপ্তি ঘটে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের। এই অঞ্চল যে এক সময বৌদ্ধ শাসন ছিল; জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, সাহিত্যে তারা অনেক উৎকর্ষ লাভ করেছিল আজকের বিক্রমপুর দেখলে তা অনুধাবন করা যায় না। বল্লাল সেনের সক্রিয় সমর্থনে এবং সহযোগিতায় পূর্ণজাগরণ ঘটেছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। আর সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্তি ঘটেছিল বৌদ্ধদের। শুধু বঙ্গদেশে নয়, নেপাল ভুটান, আরাকান ও ব্ৰহ্মদেশে তিনি হিন্দুধর্ম প্রচারের ব্যবস্থা করেন। সে সব দেশের হিন্দু অধিবাসীদের মধ্যে অধিকাংশই বল্লাল সেনের হিন্দু ধর্ম প্রচারের সক্রিয় সহযোগিতার ফল। তিনি নিজে যেমন ছিলেন বীর, তেমনি ছিলেন বিদ্বান। ‘দান সাগর” ও “অদ্ভুত সাগর’ নামে রচিত সংস্কৃত গ্রন্থদ্বয় তার গভীর পান্ডিত্যের পরিচায়ক।

শোনা যায়, ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। কিংবদন্তি অনুযায়ী তার মাতার উপর বিরাগ হয়ে তার পিতা গৰ্ভবতী রানীকে প্রাসাদ থেকে বিতড়িত করেন। সাতরিয়ে কিংবা অন্য কোনোভাবে রানী নদী অতিক্রম করে আশ্ৰয় নেন এপারের গভীর জঙ্গলে । সেখানেই জন্ম হয় বল্লাল সেনের। কালে কালে প্রাকৃতিক নিয়মে বর্ধিত হয় তার বয়সী। নিষ্ঠার সাথে নানা বিদ্যা আয়ত্তে মনোনিবেশে করেন। তিনি। খ্যাতিলাভ করেন যৌবনে । তার যশাগাথা কানে যায় তার পিতার। কৃতী পুত্ৰকে দেখতে আগ্রহ জাগে রাজার মনে। বল্লাল সেনকে যখন তার পিতার সামনে হাজির করা হয় তখন তিনি সুদৰ্শন পুত্রের সৌম্য চেহারা ও বলিষ্ঠ দেহ দেখে হন মুগ্ধ। পিতৃস্নেহে আলিঙ্গণ করেন তাকে। রাজ্যের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন আজন্ম অবহেলিত বুদ্ধিদীপ্ত পুত্ৰ বল্লাল সেনকে।

পরবর্তীকালে রাজা হয়ে বল্লাল সেন তার শৈশব-যৌবনের লীলাক্ষেত্রে এক মন্দির প্ৰতিষ্ঠা করেন। তার নাম দেওয়া হয় ঢাকেশ্বরী মন্দির। অনেকের মতে শৈশবে খেলা করার সময় ওই স্থানে তিনি একটা দুৰ্গা মূর্তি ঢাকা অবস্থায় পেয়েছিলেন। সেজন্য মন্দিরটির নাম দিয়েছিলেন ঢাকা-ঈশ্বরী’ অর্থাৎ “লুক্কায়িত দেবী মন্দির। আবার অনেকের মতে স্থানটার নাম যেহেতু ঢাকা ছিল তাই ঢাকার অধিকত্রী অর্থাৎ ঢাকাশ্বরী নাম দেওয়া হয় ।

তার বিক্রমে হিন্দুদের প্রচন্ড প্রভাব তখন সমগ্র রাজ্যে। বৌদ্ধরা আত্মপরিচয়হারা। বিদেশাগত কয়েকজন মুসলমানের অধিবাস ছিল বিক্রমপুরে। কিন্তু স্বাধীনভাবে ধর্মপালন করার অধিকার ছিল না তাদের । নামাজের জন্য আজান দিতে পারতো না। গরু জবাই করলে রাজার কৃপাণের তলায় পেতে দিতে হতো নিজের মাথা। তাই কোনো রকমে গোপনে পালন করতো মুসলমানরা ধর্ম কর্ম।

রাজধানী রামপালের কিছু দূরে আবদুল্লাহপুর গ্রাম। নাম দেখে মনে হয় এই গ্রামে কিছু সংখ্যক মুসলমানের বাস ছিল। দলবদ্ধ হয়েই হয়তো থাকতো তারা। এই গ্রামের একজন মুসলমান অধিবাসীর নাম ছিল সোলায়মান। সোলায়মানের কোনো সন্তান ছিল না। বড় মনোকষ্টে ভুগতো সে। খোদার কাছে দিনরাত কায়মনবাক্যে মাগতো দোয়া, কান্নাকাটি করতো। কিন্তু আশা নিরাশাই রয়ে যায়।

একদিন এক ফকির আসে সোলায়মানের বাড়িতে। খোদার অস্তে দিতে বলে কিছু ভিক্ষা। সোলায়মান মনঃক্ষুন্ন হয়ে রুক্ষ্ম মেজাজে বলে--আর খোদার অস্তে বলো না। খোদার নামে যথেষ্ট করেছি। কিন্তু খোদা আমার দিকে মুখ তুলে চাইলো না। দিলো না একটা ছেলে । খোদার নামে আমি আর ভিক্ষা দেবো না।

ফকির আরো কাছে এসে, আরো অন্তরঙ্গভাবে বললো-কে বলেছে খোদা তোমার বাসনা পূরণ করেনি ? অচিরেই তোমার একটা ছেলে হবে।

---সত্যি?

--মিথ্যে বলবো কেন ?

—তোমার কথা যদি সত্যি হয় তবে তোমাকে পুরস্কার দেবো।

—তোমাকে পুরস্কার দিতে হবে না। আল্লাহর নামে একটা গরু কোরবানী করলেই হবে ।

--আমি তাই করবো, বাবা। আপনি আমার জন্য খোদার কাছে দোয়া করুন।

-করছি। কিন্তু তোমার ওয়াদার কথা মনে থাকে যেন।

ফকির বিদায় নিলো। দেখা গেলো, কিছুদিন পরে সত্যিই সোলায়মানের স্ত্রীর কোল আলো ক'রে ভূমিষ্ঠ হলো এক সুন্দর ফুটফুটে ছেলে। আনন্দ ধরে না সোলায়মানের মনে। কী করবে ভেবে পায় না।

মনে পড়লো তার ফকিরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা। কিন্তু উপায় ?

গরু কুরবানী করলে তার ঘাড়ে তো মাথা থাকবে না। প্রতিবেশী হিন্দুরা যাবে ক্ষেপে। তারা খবর

পৌছে দেবে রাজার কানে। তখন ছেলেকে মানুষ করবে কে ? কিন্তু ওয়াদা পালন না করলে তার ছেলের যদি কিছু হয় ?

চিন্তা করতে পারে না সোলায়মান। শেষ পর্যন্ত প্রতিজ্ঞা পালনে হয় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। একটা উপায় অবশ্য অনেক ভাবনা চিন্তার পর সে বের করে। একটা গরু নিয়ে সবার অলক্ষে সে চলে যায় লোকালয় থেকে দূরে, এক গভীর জঙ্গলে। সঙ্গোপনে গরুটা কুরবানী করে সেখানে। সামান্য কিছু গোস নিজের জন্যে রেখে অবিশিষ্টংশ পুতে ফেলে মাটির তলায়। নিশ্চিন্ত মনে যাত্ৰা করে গ্রাম অভিমুখে।

দুভাগ্য তার। কোথা থেকে একটা চিল এসে ছোঁ। মেরে তার পাত্র থেকে নিয়ে যায় এক টুকরো গোস।

নিলো তো নিলো।

উড়ে গেলো চিলটা সোজা রাজবাড়ির দিকে। প্রাসাদের উপরে যেতেই তার পা থেকে ফসকে গেলো মাংসখণ্ডটি। পড়বি তো পড় এক্কেবারে প্রাসাদের পূজারীর সামনে। তিনি দেখেই চিনলেন মাংসখণ্ডটি গরুর গোস। বিষয়টা জ্ঞাত করানো হলো রাজা বল্লাল সেনকে।

রেগে আগুন হলেন তিনি। চিৎকার করে বললেন,-কোন পাপাচার হিন্দু দেবতাকে হত্যা করেছে ? তাকে খুঁজে বের করো। হাজির করো আমার সামনে। মহাপাতককে শান্তি দেবো। আমি নিজ হাতে ।

গো-হস্তা মহা পাপিষ্ঠকে খুঁজে বের করার জন্য রাজ আজ্ঞাবাহীরা ছড়িয়ে পড়লো। চারিদিকে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তারা দেখতে পেলো, গভীর জঙ্গলে শেয়ালেরা একটা জন্তুর হাড়গোড় নিয়ে টানাটানি করছে। তাদের বুঝতে অসুবিধা হলো না, এই হাড়ই সেই গরুর হাড়। কিন্তু কে করলো এই কান্ড ?

চলে এলো তারা নিকটবতী লোকালয়ে। আবদুল্লাহপুরে এসে লোকমুখে শুনে অনুমান করলো, এটা ওই সদ্যজাত পুত্রের পিতা সোলায়মানেরই কাজ। গ্রামের অনেকেই ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছিল ফকিরের কেরামতির কথা।

খবরগীররা সংবাদ পৌঁছে দিলো রাজা বল্লাল সেনের কাছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আদেশ দিলেন,-ওই ব্যক্তিকে আগামীকাল ধরে আনবে। হাজির করবে। আমার দরবারে। সাথে নিয়ে আসবে তার সাধের ছেলেটিকে। যার কারণে এই মহাপাপ, দেবতা হত্যা, সেই শিশুকেই করা হবে দ্বিখন্ডিত। সেই পাপিষ্ঠ শিশুকে দুনিয়ার আলো-বাতাস থেকে করতে হবে চির বঞ্চিত ।

মানুষের হিতৈষীর অভাব হয় না। কেমন করে রাজার আদেশ গোপনভাবে পৌছে গেলো অভাগা সোলায়মানের কানে। ভয়ে জান শুকিয়ে গেলো তার । রাতটা মাত্র বাকি । কেমন করে রক্ষা করবে তার প্রাণের ধনকে ?

অযথা সময় নষ্ট না ক’রে কাউকে কিছু না বলে গভীর রাতের গহীন আঁধারে স্ত্রীপুত্ৰ নিয়ে গা ঢাকা দিলো সোলায়মান। রাতের মধ্যেই যেতে চাইলো সে বল্লাল সেনের রাজ্যের বাইরে। বিক্রমপুরের তখন পথ-ঘাট ছিল না। নৌকাই একমাত্র সম্বল। সে পথেই যাত্রা করলো সোলায়মান।

সকাল বেলায় রাজার লোকেরা এসে তাকে পেলো না। কোন পথে, কোন দিকে গিয়েছে। কেউ জানে না। ছুটলো তারা রাজার কাছে। সংবাদ পেয়ে রাজা রাগে অগ্নীশৰ্মা।

আদেশ দিলেন,-যে কোনো উপায়ে তাকে পাকড়াও করতে হবে। আমি নিজ হাতে শাস্তি দিতে চাই সেই পাপিষ্ঠকে ।

নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো রাজার লোকেরা। কিন্তু সন্ধান পেলো না সেই হতভাগ্য দুঃসাহসী মুসলমান পরিবারটির।

পাবে কোথায় ?

সে ইতিমধ্যেই অতিক্রম করেছে বিশাল মেঘনা ; চলতে আরম্ভ করেছে পশ্চিমের দিকে । প্ৰাণভয়ে চলতে চলতে এক সময় ভারতবর্ষের সীমানা অতিক্রম করে সমুদ্রগামী জাহাজে চড়ে পৌঁছে গেছে পবিত্র মক্কা শরীফে।

বিধর্মিদের দেশে অবস্থান করার সাধ তার মিটে গেছে। এসেছিলও সে পশ্চিমের কোনো মুসলিম দেশ থেকে।

দৈবক্রমে একদিন তার সাক্ষাৎ হলো বাবা আদম নামক একজন কামেল দরবেশের সাথে। অকপটে তার কাছে ব্যক্ত করলো সুলায়মান সবকিছু।

আনুপূর্বিক বৃত্তান্ত শুনে অবাক হলেন বাবা আদম। এমন দেশও পৃথিবীতে আছে ? রাজা যে ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন, মানুষ কেন পারবে না স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম করতে?

ঠিক আছে, আমি যাবো সেই দেশে। শিক্ষা দেবো অত্যাচারী রাজাকে । আদায় করবো মানুষের স্বাধীনতা । নির্ভয় চিত্তে মানুষের ধর্ম পালনের অধিকার করবো আদায়।

কয়েকশত অনুসারী নিয়ে বাবা আদম যাত্রা করলেন ভারতবর্ষ অভিমুখে । বহু দিন ধরে দুস্তর পথে বহু বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে অবশেষে পৌছলেন তিনি বিক্রমপুরের উপকণ্ঠে। রাজা বল্লাল সেনের প্রাসাদের অনতিদূরে গাড়লেন আস্তানা। প্রথমে স্থাপন করলেন একটা মসজিদ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় উচ্চস্বরে আজান দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। আরম্ভ করলেন জামাতে নামাজ পড়া।

বিচলিত হলেন রাজা বল্লাল সেন। তার আমলে বৌদ্ধদের প্রাদুর্ভাব গিয়েছিল কমে। মুসলমানদের অধিবাস ছিল না বললেই চলে। ধর্ম, কৃষ্টি, শিক্ষা, সংস্কৃতিতে একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল হিন্দুদের। মুসলমান বসতি অবাধে গড়ে উঠলে সেটা হবে নতুন বিপদ।

তাই দরবেশ বাবা আদম ও তার সহস্রাধিক অনুসারীর কার্যকলাপ মনে প্ৰাণে গ্রহণ করতে পারলেন না রাজা বল্লাল সেন।

কিছুদিন পরে দেখা দিলো। নতুন উপসর্গ। দরবেশের অনুগামীরা জবেহ করতে আরম্ভ করলেন এ-অঞ্চলে সহজ প্ৰাপ্য গরু-ছাগল । এত লোকের খাদ্য গোপন স্থানে পাক করা সম্ভব ছিল না। আরববাসীরা মাছ খাওয়াতেও ছিল না অভ্যস্ত। ফলে সহজলভ্য বিশালদেহী গরুই জবেহ হতে লাগলো প্রত্যহ। আরবীয় পাকের খুসরু ছড়াতে লাগলো বাতাসে বাতাসে।

ব্যাপারটা অসহ্য হয়ে উঠলো। রাজা বল্লাল সেনের কাছে। কিন্তু শত শত আরবীয় বীর সেনানীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে সাহস পাচ্ছিলেন না তিনি। দেশে দেশে আরব মুসলমান বীর সোনানীদের বিজয় অভিযানের কথা তার জানা ছিল।

প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে গিয়ে পরাজিত হলে শুধু ধর্ম নয়, তার রাজ্য নিয়েও টান পড়বে। তাই দরবেশের বিরুদ্ধে অস্ত্ৰধারণ করতে তিনি সাহস পাচ্ছিলেন না। আবার নির্বিবাদে সহ্য করাও ছিল কষ্টসাধ্য। প্রজাদের নিকট হতে হচ্ছিল তাকে ছোট হীনবল । তার দুঃসাহস আর ধর্মানুরাগ দেখে এসেছে প্রজাবৃন্দ। তারই কারণে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সরে পড়েছে বিক্রমপুর থেকে।

দেশে আনুষ্ঠানিক ধর্মানুষ্ঠান পরিচালনা করার উপযোগী ব্ৰাহ্মণ না থাকায় তিনি কনৌজ রাজ্য থেকে কয়েকজন শিক্ষিত ব্ৰাহ্মণ আমদানি করেছিলেন। পূজা পার্বনের পৌরহিত্যে এবং হিন্দুধর্ম পুনর্জাগরণে ব্ৰাহ্মণদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পূর্ণ অধিকার দিয়েছিলেন তিনি। ধন-সম্পদ, মান-সম্মানে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি কনৌজ থেকে আগত ব্ৰাহ্মণদের। সংস্কার করেছিলেন হিন্দু জাতীয়তাবাদের। কঠোরভাবে চালু করেছিলেন জাতিভেদ প্রথা। সেই গোড়া হিন্দুরাজা বল্লাল সেন কেমন করে সহ্য করবেন আরব থেকে আগত মুসলমানদের গৰ্হিত কার্যকলাপ ?

---রাজা বল্লাল সেন শেষ পর্যন্ত সহ্য করলেন না । তার কয়েকজন শক্তিমান সাহসী দূতকে পাঠালেন দরবেশের কাছে।

----তাকে বলা হলো--হিন্দুরা দেবতাজ্ঞানে পূজা করে গরুকে । গরু হিন্দুদের দেবতা। গো-হত্যা নিষিদ্ধ সেন রাজত্বে। আপনি রাজআজ্ঞা ভঙ্গ করছেন। অবাধে গো-হত্যা করছেন। এই অনাচার বন্ধ করতে হবে।

দরবেশ ধীর স্থিরভাবে বললেন-কোনো পশু মানুষের উপাস্য হতে পারেনা। আদর-যত্ন করা, প্রতিপালন করা আর পূজা করা এক কথা নয়। একমাত্র স্রষ্টাই মানুষের উপাস্য। অন্য সকল প্রাণী-মানুষের তাবেদারে। মানুষের কল্যাণের জন্যই তাদের সৃষ্টি। গরুর গোস উপাদেয় খাদ্য । হালালও বটে। কেন তবে আমরা গরু জবাই করতে পারবো না ?

—আপনার ধর্ম আর আমাদের ধর্ম এক নয়। আপনাদের ধর্মে যেটা সিদ্ধ, আমাদের ধর্মে সেটা অন্যায়।

আমাদের রাজত্বে অবস্থান করে আপনারা সেই মারাত্মক অন্যায় করতে পারবেন না।

গরু খাওয়ার কোনো অন্যায় নেই।

বললাম তো, গরু আমাদের দেবতা। আমরা গরুকে পূজা করি।

---তোমাদের দেবতাকে খেয়ে যারা হজম করতে পারে তারাই তাহলে বড় দেবতা ।

মুসলমানরা গরুর চাইতে শ্রেষ্ঠ ।

দরবেশের কথা শুনে রাগে রোষে ফেটে পড়লেন রাজা বল্লাল সেনের অন্যতম ব্ৰাহ্মণ প্রতিনিধি। তিনি কৰ্কশ কণ্ঠেই বললেন--আজান দেওয়া আর গরু খাওয়া বন্ধ করতে হবে ।

দরবেশ শান্ত মেজাজে অথচ দৃঢ়তার সাথে বললেন,—করবো না।

--তাহলে আমাদের রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হবে।

--রাজ্য ত্যাগ করার জন্য আমরা আসিনি।

বিনা দোষে সোলায়মানের শিশু পুত্রকে তোমরা হত্যা করতে চেয়েছিলেন। বেচারার ক্ষমতা ছিল না প্ৰতিবাদ করার। হিম্মত ছিল না রুখে দাঁড়ানোর। তাই সে দেশত্যাগ করেছিল।

আমরা অতো দুর্বল নই। খোদা ছাড়া পৃথিবীতে আর কারো কাছে অন্যায় ভাবে আমরা মাথা নত করি না।

তোমাদের রাজাকে--বলবে, আমরা এখানে থাকবো এবং গো-হত্যা করবো। আজানও দেবো ।

দরবেশের জবাব শুনে অপমানিত বোধ করলেন রাজা বল্লাল সেন । তিনি শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত হতে বললেন যুদ্ধের জন্য। সাজ সাজ রাব পড়ে গেলো রাজধানীতে ।

সংবাদ চলে এলো দরবেশের কাছে। তিনিও তার সঙ্গীদের প্রতি আদেশ দিলেন-- তৈরি হও। শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য হও প্রস্তুত। জয়লাভ করলে এদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে ইসলামের ন্যায়নীতি ও সমতা। আর মৃত্যু হলো পাবে শহীদের দরজা।

একটা প্ৰাণী জীবিত থাকতে অন্যায়ের কাছে পরাজয় স্বীকার করবো না। প্রয়োজনবোধে কুরবান করবে নিজেদের জীবন।

প্রস্তুতি গ্ৰহণ করলো দু'পক্ষই। মুসলমানেদের রণ কৌশলের বিশ্বজোড়া খ্যাতি জানা ছিল রাজা বল্লাল সেনের। তাই জয় পরাজয়ের আশঙ্কা ছিল তার অন্তরে । তাই আগে থেকেই সাবধানতা অবলম্বন, প্রাসাদের আধিবাসীদের উদ্দেশ্যে বিদায়কালে -- বিজয় আমাদের হবেই, কয়েকশত বিদেশিকে পরাজিত করা আমার বাহিনীর পক্ষে কঠিন কিছু নয়। তবু সাবধানের মার নেই। আমরা যদি পরাজিত হই, তবে তোমরা অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দিয়ে সবাই আত্মাহুতি দেবে। মুসলমানেরা যেন তোমাদের দেহ স্পর্শ করার সুযোগ না পায়। ওরা ভয়ানক হিংস্র। নির্বিবাদে পুরুষদের হত্যা করবে। হয়তো মেয়েদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে বিয়ে করতে চাইবে। সে সুযোগ তাদের দেওয়া যাবে না।

--জয়-পরাজয়ের খবর আমরা জানবো কি করে ?

-আমি একটা পায়রা নিচ্ছি জামার মধ্যে। একান্তই যদি পরাজিত হই। তবে মরার আগে পায়রাটা ছেড়ে দেবো। ওটা ফিরে আসলেই বুঝবে আমরা পরাজিত। দেরী না করে সঙ্গে সঙ্গে সদলবলে ঝাঁপিয়ে পড়বে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে।

অর্থাৎ ১৪৮৩ সালে যেখানে “বাবা আদম মসজিদটি তৈরি করেছিলেন জালালউদ্দীন ফতেহ শাহ, সেখানেই সমবেত করলেন তার বিশাল বাহিনীকে। মুখোমুখি দাঁড়ালো উভয় পক্ষের যোদ্ধাগণ। বাংলার ভাটি অঞ্চলে মুসলিম অভিযানের অগ্রপথিক, ইসলামে নিবেদিত প্ৰাণ বাবা আদমের ভয়লেশহীন অনুসারীরা শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হল সেনের দুর্ধর্ষ সৈন্য বাহিনীর সাথে। আরম্ভ হলো রক্তক্ষয়ী সম্মুখ সমর।

প্রথম দিনে উভয় পক্ষের বিস্তার ক্ষয়-ক্ষতি হলেও নির্ধারিত হলো না জয়-পরাজয় । দিন শেষে ঘোষিত হলো যুদ্ধবিরতি ।

পরদিন আবার শুরু হলো প্রচন্ড যুদ্ধ। কিন্তু দিন শেষে ফলাফল রইলো একই। চললো আরো কয়েকদিন। রাজার দলে প্রত্যেকদিন যোগদান করতে লাগালো নতুন সেনাদল। পূরণ হতে থাকলো মৃত সৈন্যদের শূন্যস্থান। কিন্তু দরবেশের সঙ্গীসংখ্যা কমতে থাকলো ক্ৰমান্বয়ে। পুরণ হবার কোনো উপায় ছিল না। ফলে একদিন নিঃস্ব হলো তাঁর অনুসারীদের সংখ্যা। চূড়ান্ত পরাজয় বরণ করতে হলো মুসলমানদের।

সুর্য তখন ডুবে গেছে। পশ্চিমাঞ্চলে। মাগরিবের নামাজে দাঁড়িয়েছেন বাবা আদম । এমন সময় বিজয়ী বেশে উন্মুক্ত তরবারি হাতে সেখানে হাজির হলেন স্বয়ং রাজা বল্লাল সেন। দেরী সহ্য হলো না তার।

---প্রচন্ড আঘাত হানলেন দরবেশের স্কন্ধাদেশে। কিন্তু ফল হলো না কিছুই। পাগড়ির ঝুলন্ত অংশ পর্যন্ত রইলো অক্ষভ | অবাক হলেন বল্লাল সেন। তরবারি উত্তোলন করলেন আবার । এই সময় নামাজ শেষ হলো বাবা আদমের । সালাম ফিরায়ে আরম্ভ করলেন দীর্ঘ মোনাজাত। মোনাজাত শেষে অনেক কথা কাটাকাটি হলো রাজার সাথে। পরিশেষে তিনি বললেন---খোদার ইচ্ছায় বিধর্মীর হাতেই মুহুর্তে মৃত্যু হবে আমার। কিন্তু তোমার তরবারিতে নয়। এই নাও আমার তরবারি আঘাত হানো। এবার ঠিক কামিয়াব হবে। তবে তুমি বাঁচতে পারবে না। খোদার অভিশাপ নেমে আসবে তোমার উপরে । তোমার পাপে অনেক নিরীহ ব্যক্তি হয়তো প্ৰাণ হারাবে। দম্ভকে খোদা সহ্য করেনা। নিজের ভালো তুমি বুঝলে না।

জায়নামাজের নীচ থেকে তরবারিটা বের করে দিলেন বাবা আদম ।

বললেন---এবার আঘাত হানো ।

যন্ত্র চালিতের মত বাবা আদমের তরবারি হাতে নিলেন রাজা বল্লাল সেন, তরবারি আদমের মাথার উপর উত্তোলন করে বললেন--এতোদিন অনর্থক ভয় করতাম মুসলিম শক্তিকে। অনেক রাজা মোকাবেলা করতে সাহস পাননি মুসলমানদের। কিন্তু আমি দেখলাম, কিছুই না। সাহস করলে, বীরের মতো যুদ্ধ করতে পারলে মুসলমানদের পরাজিত করা কঠিন কিছু নয়।

--রাজা, ভুল করছো। আমরা যোদ্ধা নই। ধর্ম প্রচারক। মুসলিম সৈনিকদের সাথে শক্তি পরীক্ষার সুযোগ তোমার জীবনে হবে না। তার আগেই খোদার অভিশাপ নেমে আসবে তোমার পরিবারে। নির্বাংশ হবে তুমি।

দরবেশের কথা শেষ হতে পারলো না। দাঁড়িয়ে অভিশাপ শোনার ধৈর্য তার ছিল না। দরবেশের তরবারি দিয়েই আঘাত হানলেন তিনি দরবেশের স্কন্ধে। এবার সহজে দ্বিখণ্ডিত হল বাবা আদমের দেহ। আনন্দে আত্মহারা হইয়ে তরবারি দূরে ছুড়ে ফেলে দিলেন রাজা।

এই সময় কোন ফাঁকে তার জামার নীচ থেকে পায়রা বেরিয়ে গিয়েছিল, জানতে পারেননি তিনি। বিজয়ের আনন্দে তখন তিনি আত্মহারা ।

আত্মীয়বর্গ তখন প্রাসাদের ছাদে দাঁড়িয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন দিনশেষে যুদ্ধের খবর শোনার জন্য। সেদিন কোনো দূত যায়নি। পতপত করে হাজির হয়েছিল বল্লাল সেনের নিয়ে যাওয়া সেই বিশেষ পায়রাটা । পায়রা জানতো না, কতো মারাত্মক পরিণতির ভয়াবহ সংবাদ সে পৌঁছে দিয়েছিল প্ৰাসাদের অধিবাসীদের কাছে।

মুহুর্তে মৰ্মভেদী কান্নার রোল উঠলো সমগ্র রাজপ্রাসাদে। বিলাপ করার সময় ছিল না তাদের হাতে। অগ্নিকুণ্ডে শুকনো কাঠ সরবারহ করা হলো। বেশি পরিমাণে ঢেলে দেওয়া হলো কয়েক টিন ঘি। বিজয় উন্মত্ত মুসলিম সেনারা অচিরেই পৌছে যাবে প্রাসাদে। ইজ্জত নষ্ট করা হবে “রণগর্বি, জাত্যাভিমানী’ রাজপরিবারের কুলশীল রমনীদের।

তাই সময় ক্ষেপণ না ক’রে তারা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লো জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে । শেষ হলো সকল গর্ব, চূর্ণ হলো রাজা বল্লাল সেনের দর্প।

হঠাৎ প্রাসাদের দিকে নজর গেল রাজা বল্লাল সেনের। রাতের গহীন আধার ছিন্ন ক’রে প্রাসাদের লেলিহান শিখা দূর থেকে স্পষ্টতর হলো তার দিব্যচক্ষে। অবাক হলেন তিনি। জামার নীচে বুকে হাত দিয়ে দেখলেন, যথাস্থানে নেই পায়রাটা । উম্মাদ হয়ে গেলেন তিনি। দরবেশের অভিশাপের কথা মনে হলো তার। কাউকে কিছু না বলে পাগলের মতো ছুটলেন তিনি প্রাসাদ অভিমুখ। সর্বনাশ হবার আগেই যে-কোনা উপায়ে পৌছতে হবে তাকে রাজ-বাড়িতে। রক্ষা করতে হবে প্ৰাণপ্ৰিয় আত্মীয়বৰ্গকে।

পৌঁছলেন তিনি ঠিকই। কিন্তু সব নিঃশেষ হয়ে গেছে তার আগেই। একজনও বেঁচে নেই আপনজন। মনের দুঃখে সেই জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে ঝাপ দিলেন তিনিও ।

বল্লাল সেনের বড় কুমার লক্ষণ সেন সপরিবারে ছিলেন তখন নদীয়ায়। পরবর্তীকালে বখতিয়ার খিলজীর ভয়ে তিনি প্ৰাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন বিক্রমপুরে। তার পরিবার ব্যতীত নিয়তির অমোঘ বিধানে এইভাবে শেষ হয়েছিল বিক্রমপুরে অবস্থানরত সেন বংশের প্রতিটি অহঙ্কারী সদস্য।

বইঃ ঢাকার ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি- আনিস সিদ্দিকী

বিষয়: বিবিধ

১৩৭৫ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

383423
২৪ জুন ২০১৭ দুপুর ০৩:০১
হতভাগা লিখেছেন : মোগলদের গোড়াপত্তন কি এরপরই শুরু হয়েছিল এই উপমহাদেশে ?
২৪ ডিসেম্বর ২০১৭ দুপুর ০৩:৪৩
317221
গোলাম মাওলা লিখেছেন : হু

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File