বইঃ সিয়াসতনামা( রাষ্ট্র দর্শন)

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০৭:৩৭:৫০ সন্ধ্যা

বইঃ সিয়াসতনামা( রাষ্ট্র দর্শন)

লেখকঃ নিজাম উল মূলক

অনুবাদঃ যাহিদ হোসেন

প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী/ ১৯৬৯

ধন্যবাদঃ কাজি মাহমুদুল হক ভাই

লেখক পরিচয়ঃ

‘সিয়াসতনামার লেখক নিজাম-উল-মুলক (১০১৭—১০৯২) ছিলেন পারস্যবাসী। তুসের নিকটবতী রাকন গ্রামে আঁর জন্ম। তাঁর পুরা নাম আবু আলী আল হাসান ইবনে আলী ইবনে ইসহাক আল তুসী। তিনি আলাপ আরসালান ও মালিক শাহের শাসনকালে প্রধান উজীর ছিলেন এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন কার্যকলাপে সুচিন্তিত নেতৃত্ব দান করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে শুধু সাধারণভাবে কল্যাণকামী সরকারের বিষয় সম্পর্কেই নয়, বিচারালয়, কর আদায়, ব্যবসা-বাণিজ্য, জনসাধারণ ও সৈনিকদের সমস্যাসমূহের সমাধান সম্পর্কে তথ্যপূর্ণ বিশ্লেষণধর্মী বিশদ আলোচনা করেছেন।

নিজাম-উল-মুলককে রাজনীতি ক্ষেত্রে ম্যাকিয়াভেলীর পূর্বসূরী বলা যায়। দুজনের মধ্যে বৈপরীত্য ও সাদৃশ্য উভয়ই রয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যাপারে উভয়ের নীতিই বিশেষভাবে বাস্তবানুগ ও ভাবালুতাবর্জিত ছিল; পার্থক্য হচ্ছে নিজাম-উল-মুলকের নীতি প্রধানত সৰ্বসাধারণের কল্যাণ-অভিসারী ; অপরপক্ষে ম্যাকিয়াভেলীর নীতি রাজা ও রাজতন্ত্রের নিরাপত্তা সম্পর্কে বেশি যত্নবান। সে যাই হােক, নিজাম-উল-মূলকের রাষ্ট্র দর্শনের সঙ্গে পরিচয় যে বর্তমানকালেও আমাদের রাষ্ট্রনীতিমূলক চিন্তাকে সমৃদ্ধ করবে, সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই।

বই আলোচনাঃ

বইটি মুলত সুলতান মালিক শাহর শাষন আমলের শাষন আমলে রাজ্য পরিচালনা বিষয়ক ইতিহাস উঠে এসেছে।

এই গ্রন্থ লিখার প্রেক্ষাপট যানা যায়---- তা এমনিঃ

রাজকীয় গ্রন্থাগারের নকলনবিসের মতে সুলতান মালিক শাহ ৪৮৯ হিঃ সালে (খ্ৰীঃ ১০৮৬) কয়েকজন সম্পভ্রান্ত, বয়োজ্যেষ্ঠ এবং জ্ঞানী ব্যক্তিদের প্রত্যেককে ভিন্নভাবে পরীক্ষা করে দেখতে আদেশ দিলেন যে, “আমাদের সময়ে দেওয়ান, দরবার, রাজপ্ৰাসাদ বা হলকক্ষের কোন কিছু অকেজো পড়ে আছে কিনা—এ সমস্ত জিনিসের কোন কিছু নীতি বা কাৰ্যরীতি আমাদের দ্বারা অবহেলিত হচ্ছে কিনা অথবা আমাদের কাছে অজ্ঞাত রয়ে গেছে। কিনা। আমাদের পূর্ববতী রাজারা পালন করতেন এমন কোন বিধান আমরা অমান্য করছি কিনা, পূর্ববতী রাজাদের আইন ও রীতি কিরূপ ছিল, সেগুলোর সমন্বয়ে আমাদের বিচারকার্য পরিচালনা করার জন্য একটা বিধান তৈরি করা দরকার। সেগুলোর উপর ভিত্তি করেই যেন আমরা এর পরের সব ধর্ম সম্পবিন্ধীয় ও পার্থিব কাৰ্য সমাধা করতে পারি যাতে প্রতিটি কাৰ্যই ন্যায়ভাবে সম্পন্ন হয় এবং অন্যায় প্রথাগুলো সঙ্গে সঙ্গে দূর হয়ে যায়।

যেহেতু ‘আল্লাহ আমাদের যে-কোন রকম বিরূপ শক্তির মোকাবেলা করার ক্ষমতা দিয়েছেন, এরপর (থকে আমাদের কোন কিছুই অসৎ উপায়ে করা উচিত নয় এবং কোন কিছুই আমাদের নজরের বাইরে হওয়া উচিত নয়।”

যাদেরকে সুলতান মালিক শাহ এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে নিজাম-উল-মুলক, শরফুল মূলক ও মজিদুল মুলক সহ অন্যরা ছিলেন।

প্রত্যেকেই নিজ নিজ বক্তব্য সুলতানের কাছে পেশ করেছিলেন। সুলতান শুধু উজির নিজাম-উল-মুলকের বক্তব্য গ্ৰহণ করেছিলেন।

**আর সেই বক্তব্যের লিখিত রুপই এই বই=====

সুলতান মন্তব্য করেছিলেন, “এ অধ্যায়গুলো একদম আমার মনের মত করে লেখা হয়েছে। এটা এত নিখুঁত হয়েছে যে এতে কিছুই সংযোগ করার প্রয়োজন নাই। এটাকে আমি পথ-নির্দেশক হিসাবে গ্রহণ করব এবং এর বিধিগুলো মেনে চলব । তারপর থেকে সুলতান সর্বদাই এ পুস্তকের বিধান অনুসারে চলতেন, পুস্তকের নির্দেশ “অনুযায়ীই তিনি আদেশ দিতেন এবং সন্ধিপত্র লিখতেন।

---এ পুস্তকখানি ৫০টি অধ্যায়ে বিভক্ত।

নিজামুল মুলক প্রথমে পূর্বপ্রস্তুতি ব্যতীতই এ পুস্তকের উনচল্লিশটি অধ্যায় রচনা করে সুলতান মালিক শাহের কাছে পেশ করেন। পরে তিনি এটা সংশোধন করেন এবং তার মনে এ রাজবংশের শক্ৰদের শঙ্কা থাকাতে তিনি আরো এগারটি অধ্যায় সংযুক্ত করে প্রতি অধ্যায়ে সংশ্লিষ্ট বিষয় যুক্ত করে দেন। বিদায়ের সময় তিনি পুস্তকখানি আমার কাছে দিয়ে যান। পরে বাগদাদে যাবার পথে তার প্রতি বাতিনীরা বিদ্রোহ করে তাকে হত্যা করার দরুন আমি আর পুস্তকখানি প্রকাশ করতে সাহস করি নাই। যতক্ষণ পর্যন্ত না বর্তমান সময়ে ন্যায়বিচার ও ইসলাম প্ৰতিষ্ঠা লাভ করেছে।

***বই থেকে দুটি গল্প নিচে দেওয়া হলঃ

***আলী নুস্তিগীনের মাতলামির গল্প

কথিত আছে যে, সুলতান মাহমুদ তাঁর সম্প্রান্তদের ও স্ফর্তিবাজ সঙ্গিদের নিয়ে সারারাত মদ খাচ্ছিলেন। মাহমুদের দুই সেনাপতি আলী নুস্তিগীন ও মহম্মদ আরবিও উপস্থিত ছিলেন এবং তঁরাও মদ খেয়ে মাহমুদের সঙ্গে সারারাত জেগেছিলেন। প্রাতঃরাশের সময় আলী নুস্তিগীন নিদ্রাহীনতা ও বেশি মদ খাওয়ার দরুন খুব অস্থিরতা অনুভব করছিলেন। তিনি বাড়ি যাবার অনুমতি চাইলেন। মাহমুদ বললেন, “এ অবস্থায় দিবালোকে তোমার বাইরে যাওয়া উচিত নয়। এখানেই ভিতরে আসরের নামাজের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে স্থিরমস্তিম্বক হলে যাবে। তোমাকে এ অবস্থায় পরিদর্শক দেখলে বন্দী করে কশাঘাত করবে। তুমি খুব লজ্জা পাবে এবং আমিও তোমাকে সাহায্য করতে খুব অসুবিধায় পড়ব।" আলী নুস্তিগীন ৫০,০০০ সৈন্যের সেনাপতি ছিলেন এবং ঐ সময়ের সবচেয়ে জাদরেল সেনাপতি ছিলেন। এমনকি তাকে এক হাজার সৈন্যের সমতুল্য মনে করা হতো। তাই তিনি ঘূণাক্ষরেও কম্পনা করতে পারলেন না যে, পরিদর্শক ঐরাপ কিছু করতে পারে। তিনি অস্থির হয়ে বললেন, “আমি এই অবস্থায়ই যাচ্ছি।” মাহমুদ বললেন, “তোমার যা ইচ্ছা।” সঙ্গে সঙ্গে তার বিশ্বস্ত অনুচরদের বললেন, ‘তাকে ছেড়ে দাও, সে চলে যাক।” আলী নুস্তিগীন ঘোড়ায় চড়ে অনুচর, ভূত্যের একটা বিরাট দলসহ রওয়ানা হলেন।

ঘটনাক্রমে পরিদর্শক যখন অশ্ববারোহী ও পদাতিক সম্পাবলিত এক শত লোক নিয়ে বাজারের মধ্যস্থলে উপস্থিত, তখন তিনি আলী নুস্তিগীনকে ঐ রূপ মাতাল অবস্থায় দেখে লোকজনকে তঁকে ঘোড়া থেকে নামাতে আদেশ দিলেন। তখন তিনি নিজে ঘোড়া থেকে নেমে নিজ হাতে নিজের দণ্ড দিয়ে আলী নুস্তিগীনকে চল্লিশ কশাঘাত মারলেন। কোনরূপ সম্মান বা শ্ৰদ্ধা না দেখিয়ে তিনি যখন কশাঘাত করছিলেন, তখন নুস্তগীনের সঙ্গিরা ও ভৃত্যগণ তার দিকে তাকিয়ে ছিল। কারো কিছু বলবার সাহস ছিল না। ঐ পরিদর্শকটি একজন তুরস্বকদেশীয় খোজা ছিলেন। বৃদ্ধ ও শ্রদ্ধাস্পদ পরিদর্শকটি বহু দিন কাজ করে অনেক অধিকার সঞ্চয় করে নিয়েছিলেন।

পরিদর্শক চলে যাবার পর সঙ্গিরা আলী নুস্তিগীনকে তার বাড়িতে বহন করে নিয়ে চলল। রাস্তায় তিনি বার বার বলতে থাকলেন, “সুলতানের কথা অমান্য করলে তার শাস্তি এরূপই হয়।” পরের দিন তিনি রাজ-দরবারে উপস্থিত হলে মাহমুদ বললেন, “কিহে, পরিদর্শকের হাত এড়াতে পেরেছিলে ?” আলী নুস্তিগীন পিঠ ফিরিয়ে তার বেত্ৰাঘাত-জর্জরিত স্থানটি মাহমুদকে দেখালেন। মাহমুদ হেসে উঠলেন এবং বললেন, ‘এখন অনুতাপ কর এবং প্ৰতিজ্ঞা করা যে মাতাল অবস্থায় আর বাইরে যাবে না।”

যেহেতু দেশে শাসন ও শৃঙ্খলার আইন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ন্যায়নীতির ধারা উপরোক্ত পথ নিয়েছিল।

*গাজনাইনের রুটিওয়ালাদের কাহিনী

আমি শুনেছি যে, গাজনাইনের রুটিওয়ালারা একবার তাদের দোকান বন্ধ করে রাখে, ফলে রুটির দাম বেড়ে যায় এবং রুটি দুস্তপ্রাপ্য হয়ে যায়। পথিক ও দরিদ্র ব্যক্তিরা নিরুপায় হয়ে সুলতান ইব্রাহীমের নিকটে রুটিওয়ালদের বিরুদ্ধে নালিশ করে। তিনি তখন সকল রুটিওয়ালাকে তার কাছে ডেকে আনতে হুকুম দিলেন এবং তাদের বললেন, “তোমরা কেন রুটি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছ?” তারা তখন বলল, “হুজুর, যে সমস্ত আটা-ময়দা শহরে আসে তার সবই এখন আপনার নিজস্ব রুটিওয়ালা কিনে নিয়ে গুদামজাত করে। সে বলে যে, এটা তার প্রতি হুকুম এবং সে কারণে সে আমাদের এক মণও কিনতে দেয় না। সুলতান তখনই তার নিজস্ব রুটিওয়ালাকে হাতির পায়ের তলে ফেলে মারতে হুকুম দিলেন। সে মরে গেলে তারা তাকে একটা হাতির র্দাতের সাথে বেঁধে সারা শহর প্রদক্ষিণ করে ঘোষণা করে দিল, “কোন রুটিওয়ালা তার দােকান না খুললে আমরা তাকে এরূপ শাস্তিই দিব।” তারা তখন সুলতানের রুটিওয়ালার ভাণ্ডারজাত আটা-ময়দা সকল রুটিওয়ালদের বন্টন করে দিল। মগরেবের নামাজের মধ্যেই প্রতি দোকানে পঞ্চাশ মণের মত রুটি উদ্বত্ত রয়ে গেল এবং সবগুলো কেনার মত প্রচুর খরিদ্দার ছিল না।

বিষয়: বিবিধ

১৪৮৬ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

378072
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ রাত ১০:১৫
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ধন্যবাদ। এই বইটিকে ম্যাকিয়াভেলির "দি প্রিন্স" এর মতই বলা যায়।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File