দূর হোক ফুটবলীয় মৌলবাদ : দুটি গল্প একটি প্রার্থনা

লিখেছেন লিখেছেন আমিন ইউসুফ ০৯ জুলাই, ২০১৪, ০৪:৫৭:১৯ রাত

ব্রাজিলে বিশ্বকাপ খেলা চলছে। কিন্তু তার ঢেউ অযুত নিযুত দূরের দেশগুলোতেও আছড়ে পড়ছে। আর আমাদের মত হুজুগে জাতির কথা তো বলে লাভ নেই। ধানি ক্ষেত বেচে, সঞ্চয়ের ধন বিকিয়ে ভিনদেশি পতাকা উড়ানোর মত বিলাসিতা, সে পতাকা লাগাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার মত নিরবুদ্ধিতা শুধু আমরাই দেখাতে পারি।

১। আজ ব্রাজিল ও জার্মানির মধ্যে প্রথম সেমিফাইনাল। ফেইসবুকে কথা হচ্ছিল এক ছোট ভাইয়ের সাথে। সে সাংবাদিক। সংবাদদাতা নয়, দক্ষ ও যোগ্য সাংবাদিক। ব্রাজিলের সমর্থক। তাই ফেবুতে পোস্ট দিয়েছে ব্রাজিল জিতবে।অনেক আত্মবিশ্বাসী। বললাম, দেখ এই ব্রাজিলের পক্ষে আজ জয় লাভ করা অনেক কঠিন। ব্রাজিলকে শুধু ভাল খেল্লেই হবেনা, জার্মানিকে খারাপ খেলতে হবে। পেলে গারিঞ্চাদের দেখিনি, তবে এটা রোনাল্ডো, রিভালদোদের দল নয়। তার ধারে কাছেও নেই।

সাংবাদিক সাহেব অতি আত্মবিশ্বাসী। আমাকে অনেক উদাহরন দিলেন। ব্রাজিলের হলুদ জার্সির একটা আলাদা শক্তি আছে। তাই মাথা (নেইমার) ও কোমর (সিল্ভা) ভেঙ্গে গেলেও জার্মানির বিরুদ্ধে তারাই জিতবে। তাকে বুঝানো যায়নি এই ব্রাজিল সেই ব্রাজিল নয়। আমি নিজেও ব্রাজিল সমর্থক। তাই বললাম, তোমার কথাই যেন সত্যি হয়। সে দোয়া কামনাও করল।

সাংবাদিককে বললাম, এত আবেগ ভাল নয়। তাকে টলানো যায়নি।

খেলা শুরু হল। ফলাফল নিয়ে বলে লাভ নেই, সবারই জানা।

সাংবাদিক সাহেব বয়সে আমার ছোট হলেও বিদ্যাবুদ্ধিতে অনেক এগিয়ে গেছে। কিন্তু ভালবাসা এমন জিনিস, বিদ্যানকেও সে বোকা বানিয়ে দিতে পারে। যুক্তি মানতে অস্বীকার করাতে বাধ্য করাতে পারে। তবে যেহেতু ভালবাসার বিষয় সেখানে কেউ যুক্তিহীন হলেও তাকে দোষ দেয়া যায়না।

২।

এই তত্ত্বটা প্রথমে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করেন প্রেসিডেন্ট বুশ। নাইন ইলেভেনের পরে এক ভাষণে বলেন, হয় তুমি আমার বন্ধু নয় শত্রু। তবে বুশের ভাষণের আরও বহু আগে থেকেই বাংগালি জাতি এর চর্চা করে আসছে। রাজনীতি তো বিএনপি নয় আওয়ামী লীগ, ক্রিকেট তো পাকিস্তান নয় ভারত, দেশীয় ক্লাব তো আবাহনী নয় মোহামেডান, বিদেশী তো রিয়াল বা বার্সা আর বিশকাপে হয় আর্জেন্টিনা নয় ব্রাজিল। তাও ভাল ছিল যদি নিজের দলের সমর্থনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। বরং নিজের দলের সমর্থনের চেয়েও মুখ্য হয়ে উঠে অপর দলটার নিন্দাজ্ঞান। তাদের তো আর সংসদে নিন্দাবাদ করার সুযোগ নেই, তাই ফেইসবুক বা অন্যান্য মাধ্যমে তারা তাদের এই হিংসাবাদ ছড়াতে থাকে।

নিজেকে একটু পাগল মনে হয়। ব্রাজিল সমর্থন করি কিন্তু মুগ্ধ দৃষ্টিতে মেসির খেলা দেখি। নেইমারের খেলা দেখে পুলকিত হই, মেসির খেলা দেখে হই বিস্মিত। একটা খেলোয়াড় এত ভাল কিভাবে খেলতে পারে! আবার ক্রিশ্চিয়ানো অসম্ভব স্কিল দেখে হাততালি দিতেও আমার হাত দ্বিধা করেনা। মনে প্রানে চাইছিলাম নেইমার কাপটা নিক, কিন্তু এটাও ভাবছিলাম, এত বড় খেলোয়াড় মেসি, তার হাতে একটা বিশ্বকাপ না থাকাটা মানায় না। অনেকেই ভাবে, আমি সুবিধাবাদী। আসলেই কি তাই।

এরই মধ্যে নেইমারের পিঠ ভেঙ্গে দেয়া হল। চারিদিকে নেইমারের জন্য হাহাকার। ম্যারাডোনা থেকে সাবেইলা সবাই দুঃখিত। কিন্তু মন জয় করে গেল দেবব্রত মুখপাধ্যায় নামক এক ব্লগারের নেইমারকে নিয়ে একটি লেখা। দেব সাহেব লিখেছেন উনি একজন কট্টর আরজেনটিনা সমর্থক। বিশ্বাস হচ্ছিলনা। একজন আর্জেন্টিনা সমর্থক কিভাবে চাইতে পারে নেইমারের জন্য হলেও ব্রাজিল কাপ জিতুক। ফেবু প্রোফাইল চেক করলাম। ঠিকই আছে। উনি একজন পাঁড় আর্জেন্টিনা সমর্থকই। শ্রদ্ধায় মনটা ভরে গেল। আমি তাহলে পাগল না। এমন লোক আরও বহু আছে!

৩।

প্রথম গল্পের ঘটনা হল আজ বিকেলের। তারও আগে আজ সকালে বিশ্বকাপ নিয়ে ফেবুতে কথা হয় আরেকজনের সাথে। পেশায় উনি তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। বয়সে আমার বড়, জ্ঞানে আরো বড়। উনি বিশ্বকাপের খেলা দেখেন কিন্তু ব্রাজিলের খেলায় কমেন্ট করেন। ব্রাজিল গোল করা মাত্রই অফসাইড বলে পোস্ট দেন। সবসময় অনুযোগ করতে থাকেন রেফারি না থাকলে ব্রাজিলের পক্ষে কোন ম্যাচই জেতা সম্ভব নয়।

উনি আজ আমার ফেবু দেয়ালে পোস্ট দিয়েছেন। জানেন, ব্রাজিল তো ফাইনালে চলে গিয়েছে। ইতালি উরুগুয়ে ম্যাচে যে রেফারি সুয়ারেজের কামড় দেখেনি তাকে ইচ্ছে করেই ফিফা আজ দায়িত্ব দিয়েছে। ছি ছি ব্রাজিল।

আমার দেয়ালে। একটু অবাক হলাম। ফিফার সম্বন্ধে আমার ধারনা আছে। ফিফা আইসিসি নয়। ফিফার বড় পদে ব্রাজিলের কেউ আছে বলেও জানা নেই আমার।আমি প্রত্যাখ্যান করি। এই রেফারি যদি কম দক্ষতাসম্পন্ন হয় তাহলে তো ব্রাজিলের জন্য ক্ষতিকরও হতে পারে। উনি বলেন না, এটা হবেনা। ব্রাজিল্কে জেতাতেই এমনটা করা হয়েছে। ১৯৩৪/৩৬ বিশ্বকাপের উদাহরন দেন উনি। মুসলিনির ইতালি এভাবেই কাপ নিয়েছিল। তাকে কে বুঝাবে যে এটা ১৯৩৪ নয়, ২০১৪। তখন ফিফা ছিলনা। কোন সিস্টেম ছিলনা।

আমি তার ফেবু প্রফাইল চেক করি ধারনা নেয়ার জন্য। না অন্য কোন ম্যচের ভুল ভ্রান্তি নিয় উনি লেখেন না। ইরান আর্জেন্টিনা ম্যাচে ইরানকে নিশ্চিত পেনাল্টি বঞ্চিত করা হয়েছে রেফারির ভুলে, উনি চুপ ছিলেন। প্রতিটা ম্যাচে ভুল হয়েছে। গ্রুপ পর্যায়ে এক ম্যাচেই মেক্সিকোর দুই বৈধ গোল অফসাইড বলে বাতিল করা হয়েছে।

উনার সাথে খেলা নিয়ে কথা বলার কোন জো পেলামনা। উনি বারবার একই কথা আউরাতে লাগলেন, ব্রাজিল আজ খেলুক বা না খেলুক তাদেরকে ফাইনালে নিবেই ফিফা। কোন তথ্য নেই, যুক্তি নেই, উদাহরন নেই শুধুই মন্তব্য। অনেকটা রচনার ভূমিকা, মুল বক্তব্য, পক্ষে বিপক্ষের যুক্তি উত্থাপন ও খণ্ডন ছাড়াই উপসংহার টানার মত।

কলম্বিয়া ম্যাচে নেইমারের খুনি (স্বপ্নের)কে কোন কার্ড দেয়া হয়নি, সিল্ভাকে কার্ড দিয়ে সেমি ফাইনাল বঞ্চিত করা হয়েছে এটা এদের চোখেই পড়েনা। বলে সিল্ভা তো কার্ড দিয়ে ভুল করেনি। তো কে বলেছে ভুল করেছে, কিন্তু ফিফার যদি এতই ইচ্ছা থাকত, সব রেফারিরা এক জোট হয়ে যদি ব্রাজিল্কে কাপ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকত তাহলে তারা কি কার্ড না দিয়ে এড়িয়ে যেত না?

এটা হল যুক্তি। কিন্তু অন্ধ ভালবাসার মত অন্ধ ঘৃণাও মানুষকে যুক্তিহীন করে তুলে। তাই এর প্রত্যুত্তর আসে, ভাই আপনি অন্ধ ব্রাজিল সমর্থক। তাই যুক্তি দিচ্ছেন। ব্রাজিল্কে ফিফা কাপ দেবেই, আপনি যাই বলেন ভাই।

অন্ধভাবে ভালবাসা খারাপ, কিন্তু অন্ধভাবে ঘৃণা আরও খারাপ। সাংবাদিক সাহেব অন্ধভাবে ভালবাসেন, এই ব্রাজিল দলের দুরবলতা তাই তার চোখে পড়ে নাই। কিন্তু অন্ধ ঘৃণা? সেটা শিক্ষিত মানুষকেও ভুল পথে পরিচালিত করে।

আপনি যখন কাউকে ভালবাসবেন তখন যুক্তি থাকাটা ভাল, আবশ্যক নয়। কারন ভালবাসা ইতিবাচক বিষয়। কিন্তু যখন আপনি কাউকে ঘৃণা করবেন তাহলে তার পেছনে আপনার অবশ্যই যুক্তি থাকতে হবে।



ফুটবল খেলাটাই এমন। রেফারির অজস্র ভুল করার সুযোগ থাকে। প্রতিটা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সাহায্য নেয়ার সুযোগ নেই। তাই কখনও এই দল তার সুফল ভোগ করে তো কখনো অন্য দল।

পছন্দের দলকে ভালবাসুন। সমর্থন দিন। তবে সে ভালবাসা যেন আপনাকে অন্যদলকে ঘৃণা করতে না শেখায়।

ব্রাজিল গো হারা হেরেছে। সমর্থক হিসেবে দুঃখ পেয়েছি। কিন্তু যুক্তিবোধ যে হারাইনি তাতে স্বস্তি পাচ্ছি। শক্তিমত্তায় এগিয়ে থাকায় জার্মানির যে জয় হবে ( ব্যবধান টা ধারনার বাইরে ছিল) সে ধারনাও সঠিক ছিল। আর রেফারিং বা ফিফা নিয়ে আজগুবি গুজবের যে কোন ভিত্তি নেই তাও দেখা গেল।



ব্রাজিল পারেনি। নেইমার, সিল্ভা থাকলেও যে পারত তার নিশ্চিয়তা ছিলনা। নেইমারের বয়স কম। বিশ্বসেরা হওয়ার জন্য সে আরও সুযোগ পাবে। তবে চাইব আর্জেন্টিনা এইবার কাপটা নিক। অন্য কিছু নয়, মেসির জন্য। চারবারের ব্যালন ডি অরের শোকেসে একটা বিশ্বকাপ ট্রফি না থাকলে ফুটবলের জয় হবে কি?

বিষয়: বিবিধ

১২৫৩ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

243056
০৯ জুলাই ২০১৪ সকাল ০৬:১৭
প্যারিস থেকে আমি লিখেছেন : আপনার লেখাটা পড়ে খুব ভালো লেগেছে।
243079
০৯ জুলাই ২০১৪ সকাল ০৮:২০
হতভাগা লিখেছেন : বাংলাদেশের সমর্থকরা তো আবার বেশী মাতাল । আল্লাহই জানে কয়জন সুইসাইড করছে ।
243162
০৯ জুলাই ২০১৪ দুপুর ০২:১০
মোহাম্মদ রিগান লিখেছেন : আপনার কথা শুনে ভাল লাগলো
243182
০৯ জুলাই ২০১৪ দুপুর ০৩:৪৯
আমিন ইউসুফ লিখেছেন : আপনার মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। ভাল থাকুন। সুস্থ থাকুন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File