বাংলাদেশে আমার ৫টি বছর (১)

লিখেছেন লিখেছেন সাদাচোখে ৩০ মার্চ, ২০১৪, ১০:৩১:১৬ রাত

২০০৫ সালের জানুয়ারী মাস। অনেক অনেক বছর পর যত্ন সহকারে বাংলা ভাষায় একটি চেক লিখলাম। চেকের পাতাটি ছিড়ে - আধো ঠান্ডা আধো গরমে ফুরফুরে মেজাজে বাসার পেছনে সোনালী ব্যাংক, পাট গবেষনা ইনস্টিটিউট শাখা, মানিক মিঞা এ্যাভেন্যূউতে গেলাম। সময় তখন আনুমানিক সকাল সাড়ে ১০টার মত হবে।

ব্যাংকে, আমার মত অতি সাধারন বেশ ভূষার ৮/১০ জন কাস্টমার দাঁড়িয়ে ও বসে অপেক্ষা করছিল। ব্যাংকের ম্যানেজার তার কাঁচঘেরা রুমে ও একজন বয়স্ক স্টাফ ক্যাশ কাউন্টারের পাশের চেয়ারে বসে দৈনিক পত্রিকা পড়ছিল। আর ১ জন স্টাফ (সম্ভবতঃ ক্যাশিয়ার) ও ১ জন বেয়ারা লেজার টেবিল সংলগ্ন পেছনের দেয়ালে হেলান দিয়ে নিচু স্বরে গল্প করছিল।

প্রায় ৪/৫ মিনিট হাসি-হাসি মুখে অপেক্ষা করলাম, একটু আধটু শব্দ করলাম। কিন্তু ব্যাংকের কোন স্টাফেরই দৃষ্টি আকর্ষন করতে পারলাম না। বাধ্য হয়ে, ক্যাশ কাউন্টারের পাশে পত্রিকা পড়ুয়া বয়স্ক ভদ্রলোকের সামনে গিয়ে বিনীত স্বরে বললাম, 'এক্সকিউজ মি, আমি একটা চেক ক্যাশ করবো'। ভদ্রলোক ধীরে সুস্থ্যে মাথা তুলে আমার দিকে এমন বিরক্তিভরা এক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন - যেন বা আমি 'চামচিকা' হয়ে ওনার মত 'হাঁতি'কে চিমটি কেটেছি। পরক্ষনে আবার পত্রিকা পড়তে লাগলেন।

কাস্টমারদের মধ্যে একজন দয়া করে এগিয়ে এসে আমাকে জানালেন, 'স্ক্রল দেবার ম্যাডাম সহ অন্যান্য স্টাফরা সমাবেশ এ গিয়েছেন। ওনারা ফিরলেই চেক ক্যাশ করতে পারবো'। আমিও অপরাপর কাস্টমারের ন্যায় অপেক্ষা করতে লাগলাম। অপেক্ষা যেন আর শেষ হচ্ছিল না।

প্রায় দেড় ঘন্টা কিংবা তার ও বেশী সময় পর বিরাট শরীরের এক মহিলার নেতৃত্বে ৪ জন স্টাফ মহা কিচির মিচির ও কল কাকলী মিশ্রিত শব্দে ব্যাংকে ডুকলো। অপরাপর স্টাফদের কাছে অতি আনন্দে সমাবেশ এর বিভিন্ন বিষয়াদি জানালো এবং এর মধ্যে সমাবেশ হতে আনা মিষ্টি পরিবেশনের জন্য বেয়ারাকে আদেশ দিল। অবশেষে কাস্টমার হতে চেক সংগ্রহ ও পেতলের টোকেন দেওয়ার মাধ্যমে ব্যাংকের শুভ কাজ শুরু করলো।

উপস্থিত কাস্টমাররা তাড়াহুড়া করায় আমি স্ক্রল টেবিলের সামনে যে লাইন হল তার পেছনে পড়ে গেলাম। বাধ্য হয়ে আমি যেন নতুন করে দেখছিলাম, কি প্রক্রিয়ায় মানুষ সোনালী ব্যাংক হতে টাকা উত্তোলন করে। যা দেখলাম, কাস্টমার স্ক্রল নিয়ে পাশের টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। একজন লোক এসে একটুক্ষন পর চেক ফেরৎ দেয়। চেক নিয়ে কাস্টমার ক্যাশ কাউন্টারের পাশের বয়স্ক লোকটিকে দেয়। ঐ ভদ্রলোক স্বাক্ষর করে চেকটি ক্যাশ কাউন্টারের টেবিলে দেয়। ক্যাশিয়ার ডেকে নিয়ে কাস্টমারকে টাকা দেয় আর কাস্টমার ক্যাশিয়ারকে ১০/২০ টাকা দিয়ে বিদায় নেয়। আমি নিজ হতে ভাবলাম - এটা সম্ভবতঃ বেতন কিংবা অনুরূপ কোন বিল এর বিপরীতে প্রদেয় চেক এর টাকা - যার জন্য কাস্টমার'রা ব্যাংক চার্জ দিচ্ছে ক্যাশিয়ারকে।

আমি ও যথানিয়মে পিতলের স্ক্রল নিলাম, একটু পর চেক নিয়ে ক্যাশ কাউন্টারের পাশে অবস্থিত বয়স্ক সেই ভদ্রলোকের টেবিলে গিয়ে চেকটি এগিয়ে দিলাম। ভদ্রলোক চেকটি হাতে নিয়ে - কেমন যেন এক দৃষ্টিতে আমার মাথা হতে পা পয্যন্ত তাকালো, তারপর বিশ্রীভাবে জিজ্ঞাসা করলো, 'চেক বই কই'? যেনবা আমি অন্য কারো চেক বই হতে চেক চুরি করে এনেছি।

আমি যথাসম্ভব বিনয়ী হয়ে বললাম, 'বাসায়'।

সাথে সাথে ভদ্রলোক চেকটি টেবিলের এপাড়ে উড়িয়ে দিয়ে চেয়ারে হেলান দিতে দিতে বলল, 'এ চেক ক্যাশ করা যাবেনা।'

আমি ভীষন অবাক হয়ে বললাম, 'কেন'?

ব্যাংকের মধ্যে তখনো আনন্দের আমেজ পুরোপুরি মিইয়ে যায়নি, স্টাফরা তখনো সমাবেশের আলোচনা ও টিকা টিপ্পনী কাটছিল। আমি ঠিক জানিনা - ঐ সময়টা পয্যন্ত ব্যাংকের স্টাফদের এতসব কান্ডকারখানা দেখে আমি ঠিক কতটা বিরক্তি কিংবা কৌতুক বোধ করছিলাম।

ভদ্রলোক পুরো শরীরটাকে আয়েশের মত করে ছেড়ে বলে উঠলো, 'নীল কালিতে লিখা চেক ব্যাংক এ্যকসেপ্ট করে না'।

আমি চেক এর দিকে তাকালাম। দেখলাম তা কালো কালিতে লিখা। আমি চেকটা ওনার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললাম, 'কিন্তু এটা তো আমি কালো কালি দিয়ে লিখেছি। আপনি দেখুন'।

ভদ্রলোক চেকটি হাতে না নিয়ে বললেন - 'না ওটা নীল কালিতে লিখা।'

আমি আবার চেক এর দিকে তাকালাম এবং শতভাগ শিওর হলাম যে আসলেই তা কালো কালিতে লিখা। তারপর হঠাৎ করে নিজেই নিজেকে সন্দেহ করলাম। ত্রিশের কোঠায় কি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে গেল? আমি পাশের টেবিলের স্টাফের দিকে চেক টা এগিয়ে ধরে প্রায় অসহায় স্বরে বললাম - 'দেখুন তো এটা কালো কালি না'?

পাশের টেবিলের স্টাফ চেকটা হাতে না নিয়েই পাশের স্টাফের দিকে তাকিয়ে বললো - 'স্যার, দিয়ে দেন তো'।

ভদ্রলোক বললেন - 'না'।

আর তারপর আমার দিকে তাকিয়ে অনেকটা বিদায় দেবার সুরে বললেন, 'যান, আজকে হবেনা। আপনার চেক বই নিয়ে আসুন'।

আমি হঠাৎ করেই আমার নিয়ন্ত্রন হারালাম। ১৫/১৬ বছর আগের মানুষে পরিনত হলাম যেন। আমার মুখ, হাত ও পা নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল কয়েক সেকেন্ডের জন্য।

সেদিন আমি পুরোপুরি স্বাভাবিক হওয়ার আগেই আমার হাতে টাকা এসেছিল, ব্যাংকের ম্যানেজার ও আরো এক কিংবা দুজন স্টাফ আমার মাথায় ও পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।

এই শাখাটি বন্ধ হয়ে লালমাটিয়ায় স্থানান্তর হবার আগে পয্যন্ত আমি আরো ৩/৪ বার ঐ ব্যাংকে গিয়েছিলাম। যত কাস্টমারই থাকুক না কেন, আমার চেক ক্যাশ হতে কখনো ৫ মিনিট ও অপেক্ষা করতে হয়নি।

বিষয়: বিবিধ

১৩৭১ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

200512
৩০ মার্চ ২০১৪ রাত ১০:৪৪
বুঝিনা লিখেছেন : আমি হঠাৎ করেই আমার নিয়ন্ত্রন হারালাম। ১৫/১৬ বছর আগের মানুষে পরিনত হলাম যেন। আমার মুখ, হাত ও পা নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল কয়েক সেকেন্ডের জন্য।
এই শাখাটি বন্ধ হয়ে লালমাটিয়ায় স্থানান্তর হবার আগে পয্যন্ত আমি আরো ৩/৪ বার ঐ ব্যাংকে গিয়েছিলাম। যত কাস্টমারই থাকুক না কেন, আমার চেক ক্যাশ হতে কখনো ৫ মিনিট ও অপেক্ষা করতে হয়নি। Thumbs Up Thumbs Up Thumbs Up
৩০ মার্চ ২০১৪ রাত ১০:৫৭
150295
সাদাচোখে লিখেছেন : কন্ট্রোলড ডেমোলিশান - এর মত দূর্নীতির বিরুদ্ধে ফাইট করলে বাংলাদেশে কাজ হয়। তবে পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূলে থাকাটা কিংবা রাখতে পারাটা পূর্বশর্ত।
200522
৩০ মার্চ ২০১৪ রাত ১১:১৮
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
৩১ মার্চ ২০১৪ রাত ০৩:৪৯
150328
সাদাচোখে লিখেছেন : পড়ার জন্য আপনাকে ও ধন্যবাদ
200551
৩০ মার্চ ২০১৪ রাত ১১:৫৬
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : সোনালি ব্যাংক সহ সরকারি ব্যাংকগুলির অবষ্থা দেখলে আমারও মাঝে মাঝে এরকম করতে ইচ্ছা করে। কয়েকবার হালকা করেছিও। এই বিষয়ে প্রবাসি মজুমদার ভাই এর অভিজ্ঞতাগুলি পড়ুন।
৩১ মার্চ ২০১৪ রাত ০৩:৫১
150329
সাদাচোখে লিখেছেন : আমি ওনার ধারাবাহিক লিখাটি পড়ছি এবং ভিতরের চিত্র খেয়াল করছিলাম। উনি খুব চমৎকার লিখেন।

একজন কাস্টমার হিসাবে ৮/৯ বছর আগে দেখা আমার সোনালী ব্যাংক ছিল অমন।
201992
০৩ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ১০:৫৮
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : প্রতিদিন এমন সব ঘটনার মুখোমুখি হতে হতে বিরক্ত হয়ে দেশই ছেড়ে দিলাম ভাই। আপনি কতদিন কত জায়গায় প্রতিবাদ করবেন, ন্যায্য অধিকারের জন্য প্রতিবাদ করতে হবেই বা কেন?
আপনার লেখার শুরুটা পড়ে মনে হোল আপনিও আমাদের মত পালিয়েছেন।
০৪ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০৪:১৬
151938
সাদাচোখে লিখেছেন : ঠিক ধরেছেন বোন। ৯/১১ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছিল আমেরিকা ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় যেতে। কিন্তু ওখানে গিয়ে ঐ বয়সে - মনে হল রাজার চেয়ে উজিরের তেজ বেশী। ফলাফল হিসাবে দেশের প্রতি অতি আগ্রহ ও সে জন্য পরিবার সুদ্ধ ফিরে গেলাম স্বদেশে। মাস যেতে না যেতেই পস্তাতে ছিলাম - কেন ফিরলাম?

সব শেষে আবার পোটলা পুটলী গুছিয়ে এলাম ইউরোপে। মুসাফির এই জীবনের পরিসমাপ্তি টানতে এখনো বাকি আছে দক্ষিন আমেরিকা আর আফ্রিকা। দোয়া করবেন - আল্লাহ হায়াত দিলে ও নসীবে রাখলে যেন ঐ দুটো মহাদেশও কয়েক বছর করে থাকতে পারি।
নাগরিক জীবনের ভোগান্তি নিয়ে ভাবলে - আইয়ামে জাহেলিয়াত আর বাংলাদেশ এর মধ্যে লিটারেলী আমি কোন পার্থক্যই যেন পাইনা। বুঝিবা সময় আর স্থান এর পার্থক্য।
255410
১৮ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৮:২৪
বুড়া মিয়া লিখেছেন : আপনারাই ভালো করেছেন দেশ ছেড়ে গিয়ে। আমাদের হয়তো এখানে এভাবে পস্তাতে পস্তাতেই মরতে হবে!
১৯ আগস্ট ২০১৪ রাত ০৩:০৫
199374
সাদাচোখে লিখেছেন : যখন সেক্যুলার মানুষিকতা সম্পন্ন ছিলাম - তখন আপনার কমেন্ট এর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সায় দিতাম।

কিন্তু এখন মনে হয় - একজন মুমিন এর সামনে - যত বেশী অড অবস্থা কিংবা যত বেশী অসহনীয় ও কষ্টকর অবস্থা বিরাজ করবে - তত বেশী ঐ মুমিন এর জন্য বেহেস্তের টিকেট পাওয়া সহজতর হবে।

যেমন চিন্তা করে দেখুন - একজন প্যালেস্টাইনী মুমিন যে ইসরাইলের আক্রমনের নিচে থেকে, অভুক্ত থেকে, সন্তানাদির মিনিমাম নিরাপত্তা দিতে ব্যার্থ হওয়া স্বত্তেও রোজা রেখেছে, নামাজ পড়েছে, আল্লাহর কাছে আলহামদুলিল্লাহ বলেছে ঐ অবস্থায় রাখার জন্য এবং একটা গুলি কিংবা বোমার আঘাতে কোন অন্যায় না করেও, কিংবা নিজ সম্পদ ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য আল্লাহর বিধান মত যুদ্ধ করতে গিয়ে - আল্লাহর দরবারে হাজির হয়েছে এবং কাল বিচার দিবসে পুরুষ্কার হিসাবে ইনশাল্লাহ বেহেস্ত পাবে - সে কি আপনার কিংবা আমার চেয়ে অনেক সাফল্যের অধিকারী নয়?

আমি আলহামদুলিল্লাহ এই পৃথিবীতে ঐ ভদ্রলোকের চেয়ে হাজার গুন নিরাপদ, আরাম আয়াশ ও অভাব মুক্ত আছি। কিন্তু আমার কোন গ্যারান্টি নেই আমি বেহেস্ত পাব কিনা - আল্লাহ আমাকে এক্সেপ্ট করবেন কিনা?

ঠিক অনুরূপ আপনাদের সামনে হাজারটা অবিচার প্রতিনিয়ত হচ্ছে, হাজারটা সমস্যায় আপনার দিনে পতিত হন, আর তারপর ও আল্লাহর পথে সামর্থ্যানুযায়ী কাজ করছেন, নামাজ পড়ছেন, রোজা রাখছেন, দান খয়রাত করছেন এবং সর্বোপরী সংসার ও মেইনটেইন করছেন - তাহলে আপনারা নিশ্চয়ই ভাই আমাদের থেকে বেহেস্তের দুয়ারে পৌছাবার দৌড়ে এগিয়ে আছেন।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে সুযোগ করে দিন - যাতে আমরা নবী রাসুল আঃ সাহাবা রাঃ দের ন্যায় দারিদ্রতা, টারময়েল, অন্যায় অবিচার ইত্যাদি কে একজন ট্রু মুমিন এর মত ফেইস করার সুযোগ পাই - এবং আজকের যুগের রংবেরংয়ের ফেতনা ও ফ্যাসাদ হতে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারি।

ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File