ফারাক্কার বাঁধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং এর ফলাফল

লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ তরফদার ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ১২:১২:১১ দুপুর





আজ থেকে দুশো বছর আগে ব্রিটিশ সরকার পলি সঞ্চয়ের কারণে কলকাতা বন্দরে জাহাজ ভিড়ানোর অসুবিধা লক্ষ্য করছিলেন। কারণ হুগলী-ভাগরথী নদী ক্রমশঃ নাব্যতা হারাচ্ছিল। ১৮৫১ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল অবধি কমপক্ষে পাঁচটি সমীক্ষা করা হয়েছে কিভাবে গঙ্গার পানির এক অংশ ঘুরিয়ে হুগলী-ভাগরথীতে প্রবাহিত করে পলি অপসারণ করা যায়। সমীক্ষায় বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেন যে গঙ্গা/পদ্মার মত বিশাল নদীর গতি বাঁধ দিয়ে বিঘ্নিত করলে নদীর উজান এবং ভাটি উভয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হতে পারে। এ ধরণের নেতিবাচক অভিমত সত্ত্বেও ১৯৫৭ সালে ভারত সরকার ফারাক্কায় গঙ্গার উপর বাঁধ নির্মাণ ও হুগলী-ভাগরথীতে সংযোগ দেয়ার জন্য ফিডার খাল খননের পরিকল্পনা করে। পশ্চিম বঙ্গের তদানীন্তন চীফ ইঞ্জিনিয়ার শ্রী কপিল ভট্টাচার্য এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করে নিম্নরূপ অভিমত প্রকাশ করেন।

(১) গঙ্গা থেকে অপসারিত ৪০,০০০ কিউসেক পানি ফিডার খাল কিম্বা হুগলী-ভাগরথী ধারণ করতে পারবে না।

(২) গঙ্গা এবং ভাগরথীর প্রবাহ রেখার উচ্চতার তারতম্যের কারণে পানি সঞ্চালন কষ্টকর হবে। ফলে গঙ্গা নদী তার স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য অন্য পথ খুঁজবে।

(৩) প্রথমোক্ত কারণের জন্য মুর্শিদাবাদ এবং মালদা জেলা জুড়ে দেখা দিবে জলাবদ্ধতা।

(৪) ব্রক্ষপুত্রের তুলনায় গঙ্গা কম গতি শক্তি সম্পন্ন নদী। এ ধরণের নদীর গতিপথ হয় আঁকা-বাঁকা (meandering)। এক বাঁক থেকে আরেক বাঁকের দূরত্বকে বলে মিয়ান্ডার দৈর্ঘ্য এবং একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে কয়টা বাঁক রয়েছে তাকে বলে মিয়ান্ডার ফ্রিকোয়েন্সি। হঠাৎ করে মৃতপ্রায় হুগলী-ভাগরথীর মধ্য দিয়ে কৃত্রিমভাবে বিপুল পরিমাণে পানি প্রবাহিত করলে হুগলী-ভাগরথী ও উজানে বিহার অবধি সব নদীর মিয়ান্ডার ফ্রিকোয়েন্সির উপর বিরুপ প্রভাব পড়বে। ফলে ঐ সমস্ত নদীতে জলাবদ্ধতা, নদী ভাঙ্গন এবং চর সৃষ্টি তরান্বিত হবে।

(৬) ভাটি অঞ্চলের সকল নদীর নাব্যতা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে।

(৭) শুষ্ক মওসুমে পানি প্রবাহ কম হওয়ার কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন দেখা দিবে।

তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার শ্রী কপিল ভট্ট্রাচার্য্যরে অভিমতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে একে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার অনুরোধ করেন। একই সাথে মার্কিন নদী বিশেষজ্ঞ ড. ইপেনকে সমীক্ষা করার জন্য নিয়োগ দেন। ড. ইপেন সুস্পষ্টভাবে জানান যে ফারাক্কায় বাঁধ দিলে পশ্চিম বঙ্গ এবং বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। কিন্তু ভারত সরকার এসব আমল না দিয়ে শ্রী কপিল ভট্টাচার্য্যকে পাকিস্তানী এজেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করে। শ্রী ভট্টাচার্য্য চীফ ইঞ্জিনিয়ারের পদ থেকে ইস্তফা দেন। দেশীয় ও বিদেশী বিশেষজ্ঞ এবং সর্বপরি গত দেড় শতাব্দীর ভূতত্ত্ববিদ, প্রকৌশলী ও নদী বিশেষজ্ঞদের মতামতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ভারত সরকার নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা (এক্ষেত্রে আবহমান কালের গঙ্গা) ভঙ্গ করার ব্যবস্থা নেন। ১৯৬১ সালে নির্মাণ শুরু হয় ফারাক্কা বাঁধের এবং শেষ হয় ১৯৭১ সালে।

ফারাক্কা বাঁধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ:

(১) বাঁধের দৈর্ঘ্য ২.২৫ কিলোমিটার।

(২) সংযোগ খালের দৈর্ঘ্য ৪৩ কিলোমিটার।

(৩) সংযোগ খালের পানি প্রবাহের ক্ষমতা ৪০,০০০ কিউসেক।

(৪) গেটের সংখ্যা ১০৯টি।

(৫) প্রতি গেটের প্রবাহ ক্ষমতা ৭০৯ কিউসেক।

(৬) হুগলী-ভাগরথীর প্রবেশস্থানে বাঁধের দৈর্ঘ্য ২২৪ মিটার।



ফারাক্কা চুক্তি :


ফারাক্কা নিয়ে ভারতের সাথে পাকিস্তান আমল থেকেই আলোচনা চলে আসছে। ভারত কখনোই এর সমাধানের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় নি। ১৯৭৪ সালের মে মাসে শেখ মুজিবের ভারত সফরকালে ভারত ও বাংলাদেশের গঙ্গার পানি ভাগ নিয়ে একটা ঐক্যমত্যে পৌছলেও উভয় সরকার গঙ্গায় পানি প্রবাহ বৃদ্ধির উপরে জোর দিয়েছিল। বাংলাদেশের প্রস্তাব ছিল গঙ্গার উজানে ছোট ছোট জলাধার নির্মাণ করে এই নদীতে পানি প্রবাহ বাড়ানো। কিন্তু ভারত অদ্ভুত এক প্রস্তাব করে। ব্রহ্মপুত্রের সাথে গঙ্গার ২০০ মেইল লম্বা খাল খুঁড়ে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় দুইটা বাঁধ নির্মাণ করবে ভারত। এতে আমাদের কোন লাভ না থাকায় আমরা তখন রাজি হই নি। কারণ বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে এই খাল খুঁড়লে ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রবাহ বদলে দিলে ভাটি এলাকা স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ইন্দিরা মুজিব চুক্তির সময় বাংলাদেশের একজন সাংবাদিক সাহস করে ইন্দিরা গান্ধীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন দুইটা প্রশ্ন। প্রথম প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন না হয়ে পাকিস্তানের অধীনে থেকে গেলে ফারাক্কা বাঁধ চালু করার সাহস ভারত পেত কি না। এই প্রশ্নের উত্তর ইন্দিরা গান্ধী দেন নি। পরের প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশ অন্য কোন রাষ্ট্র না হয়ে ভারতের প্রদেশ হলে বাংলাদেশের ক্ষতি করে এই বাঁধ ভারত চালু করত কি না। এই প্রশ্নের জবাবও ইন্দিরা গান্ধী দেন নি।

শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কায় পানির প্রবাহের পরিমাণ ৫৫হাজার কিউসেক। এক্ষেত্রে ভারত তার হুগলী বন্দরে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে চায় ৪০ হাজার পানি। ইন্দিরা মুজিব চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালের মে মাসে ৪৯ হাজার কিউসেক পানি পায়। ইন্দিরা মুজিব চুক্তি শেষ হবার পর পরই ভারত একতরফা ভাবে ৪০ হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করে নেয়, আমাদের শত প্রতিবাদেও তারা গা করে নি। ফলে আমাদের উপায় না থাকায় আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাই। জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৬ সালে ইস্তাম্বুলে ইসলামি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে এই ফারাক্কা প্রশ্ন উত্থাপিত হলে মুসলিম দেশগুলির সমর্থন লাভ করে। সেই বছরেই জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলনে ফারাক্কা ইস্যু আবার উত্থাপিত হয়। ভারত এই জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা হবার কারণে এবার বাংলাদেশের আবেদন তেমন সাড়া ফেলে নি। উপায় না পেয়ে বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের ৩১তম অধিবেশনে প্রশ্ন উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে ভারত ঢাকায় এসে এক বৈঠকে বসতে রাজি হয়।

পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে ৫ বছর মেয়াদী যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় সেখানে ভারত আমাদের ৩৭হাজার কিউসেক পানি দিতে রাজি হয়। এ সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পানি চুক্তিতে নেপালকে অন্তর্ভুক্তির দাবি করা হয়। কেননা নেপালে বড় বড় জলাধার নির্মাণ করে শুষ্ক মৌসুমে সেখান থেকে পানি ছেড়ে দিলে আমাদের পানি সমস্যার অনেক সমাধান হতে পারে। কিন্তু ভারত রাজি হয় নি। এর কারণ ভারত আমাদের সাথে এই ফারাক্কা ইস্যুকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সবসময় চাপে রাখতে চাইছে। ১৯৭৫ এ যদি ভারত প্রায় ৫০ হাজার কিউসেক পানি ছেড়ে হুগলী বন্দর ঠিক রাখতে পারে, তবে এখন কেন পারবে না?

এবার দেখা যাক ১৯৯৬ সালের পানি চুক্তির ফলে কি হয়েছে। ৭৭ সালে করা চুক্তিতে বাংলাদেশ যেখানে সর্বনিম্ন পানি পেয়েছিল ৩৪ হাজার কিউসেক, ৯৬ সালে শেখ হাসিনার করা চুক্তিতে সর্বনিম্ন পানি দেবার কথা হয়েছে ২৭হাজার কিউসেক। এই সর্বনিম্ন পানির হিসাব খাতা কলমে থাকলেও বাস্তবে তা আমরা পাচ্ছি না। এই কথা ভারত নিজেও স্বীকার করছে।

এই চুক্তি থেকেই বোঝা যাচ্ছে, চুক্তি হয়েছে যা তাতে আমাদের নয় ভারতের স্বার্থই রক্ষা পেয়েছে।

বিষয়: বিবিধ

২৭৯০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File