ফী-আমানিল্লাহ, সবর করো সব ঠিক হয়ে যাবে, আল্লাহ তা'আলা আমাদের সাহায্য করবেন, ইনশাআল্লাহ!

লিখেছেন লিখেছেন বাংলার দামাল সন্তান ০৯ আগস্ট, ২০১৮, ০৪:৫৭:১৩ বিকাল

অন্যরকম ঈদ: ভিন্নরকম আনন্দ।

প্রিজন ভ্যানের সামান্য ছিদ্রটুকু দিয়ে পরিবারের সদস্যদেরকে আগাম ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে কোর্ট থেকে হাজিরা দিয়ে বিদায় নিলাম, সর্বোচ্চ ১৫ জনের প্রিজনভ্যানের গাডিতে তখন আমরা ৫৪ জন বন্দী, মাথার ঘাম আর চোখের পানি মিলেমিশে একাকার, পাশেই একজন বলেছিলো, আমার ঈদ হবে যেদিন আমি জামিনে মুক্ত হবো, সাথে সাথে আরেকজন অভিজ্ঞ বন্দি কিছুটা আশ্বাসের সুরে ছডিয়ে বলতে থাকলেন যে ভাই জেলখানায় ঈদের খাবার দাবার কিন্তু একে বারে খারাপ না, অন্য জনের বিহ্মুদ্ধ মনোভাব-রাখেন আপনার খাবার দাবার! পরিবেশ তো খুব একটা ইতিবাচক মনে হলোনা, পকেট থেকে পরিবারের সদস্যদের দেয়া তিনটি চিঠি বের করলাম পরপর, এক হাতে গাডির গ্রিল শক্ত করে ধরে আরেক হাতে ঈদের চিঠি গুলো পডার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে লাগলাম, চিঠিতে চোখ বুলালে ধাক্কা খেয়ে পডে যেতে হয়, আবার পডে গেলে অন্যের শরীরে লাগলে তীব্র প্রতিবাদের মুখোমুখি হতে হয়,আরে ভাই দাডিয়ে থাকতেই পারছিনা, আপনি আবার কি এক কাগজ পডায় ব্যস্ত, শক্ত হয়ে দাডান দুই হাতে গাডির গ্রিল ধরুন,ফাঁকে মায়ের চিঠির শুধু শিরোনামটা পডতে পারলাম, আমার প্রিয় খোকন সোনা, আর বাকী লাইন গুলো পডার জন্য নিজেকে শক্ত করেও ধরে রাখতে পারি নাই, যেন কোন বাধই মানতে চায়না, চোখ ঝাপসা হয়ে যেতেই আবার একজন দরদভরা কন্ঠ নিয়ে মাথায় হাত বুলালেন,ভাই কি করবেন ! আপনারা শিহ্মিত মানুষ,সবই তো বুঝেন,আপনাদের আবার দু:খ কিসের!যে পথ আপনারা বেছে নিয়েছেন তাতো খুউব একটা কুসুমাস্তীর্ন নয়, ধৈর্য্য ধরুন আপনারাই জিতবেন, আবেগের মুহুর্তে কেউ স্বান্তনা দিতে চাইলে আমার চোখের পানি কয়েকগুন বৃদ্ধি পায়, হয়েছেও তাই! কান্না যতটাই না চেপে রাখতে চাই ঠিক ততটাই প্রকাশিত হওয়ার প্রতিযোগীতায় লিপ্ত।

অন্যান্য দিনের মতো আজকেও গাডীতে পরিচিত বন্দির সংখ্যাই বেশী,যে চোখের পানি আমার কাছে অসম্ভব আবেগের সেই চোখের পানিই আমার পরিচিত জনের কাছে মারাত্মক দুর্বলতার,তাই আবেগকে পশ্রয় দেয়ার প্রশ্নই উঠেনা আমার পরিচিত জনরা তাদের মাসুদ ভাইকে দুর্বল দেখতে চায়না, তা আমি খুউব ভালো বুঝতে পারি,তাই নিজের প্রয়োজনকে নির্মমভাবে গলাটিপে হত্যা করে পরিচিত জনদের প্রয়োজনটাকেই সমাদৃত করলাম, চোখের পানিকে মুহুর্তেই হাসিতে পরিনত করলাম। মনে পডলো সময়ের বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিকের লেখা একটি উক্তি 'পৃথিবী নাট্যমন্চ আমরা সেখানে রব এক এক জন বড বড অভিনেতা' এ সমস্ত অভিনয়ই মহান মাবুদের একটু সন্তুষ্টি লাভের জন্য.রক্ত ঘাম ও চোখের পানির সম্মিলিত ফসল যদি ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরীতে সামান্যতম ভুমিকাও রাখতে পারে তাতে ঈদের চেয়েই বা কম আনন্দ কিসের!এটা অন্যরকম ঈদ আনন্দ সে আনন্দ প্রকাশের ভাষা আমি শিখতে পারিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ও সাহিত্যের উপর পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করার পরও, ওটা অপ্রকাশিত আনন্দ কিন্তু অসম্ভব উপলব্ধি ও উপভোগের, প্রিজন ভ্যান জেল গেটে পৌছতেই হুডোহুডি করে নামার প্রতিযোগীতা যেনো আমরা বাসায় পৌছে গেছি, একটু স্বাচ্ছন্দে নামার জন্য একেবারে পেছনে দাডিয়ে অপেহ্মা করি, যদিও পরিচিত জনদের একটা বিরাট সম্মান দেখানোর চেষ্টা লহ্ম্য করি-ভাই আপনি আগে নামুন,তবুও তাদেরই আগে নামার সুযোগ করে দিয়ে আত্মতৃপ্তি নিতে ভালো লাগে,জেলখানার মুল ফটকে তল্লাশির এক পর্যায়ে ব্যাগের ভিতর লহ্ম্য করলাম দুটো গোলাপের সাথে দুটো ঈদ কার্ড একটা কার্ডে ছোট করে লেখা-বাবা তুমি মিটিং শেষে বাসায় ফিরলেই সেদিন আমাদের ঈদ,কাঠ পেন্সিলে লেখা, ঘষা মাজাও হয়েছে বেশ কয়েকবার,নামিরা মামনি তখনো জানে যে আমি মিটিংয়েই আছি,মিটিং শেস হলেই বাসায় ফিরবো, কারন সুবিধা ছিল কারাগারে যাওয়ার আগে বাসায় খুউ কমই থাকা হতো ,তখন থেকেই যে বাবার মিটিংটা একটু লম্বা, কারারহ্মীর তল্লাশীর এক পর্যায় কার্ড দুটো দিতে উদ্যত হলে পাশের আরেকজন কারারহ্মীই তাকে বললেন অসুবিধা স্যারকে বলে দিয়ে দেন, নিষিদ্ধ কিছু তো আর না প্রথম কারারহ্মী কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করেই বললো চাকরিটা হারাতে চান? পারলে আপনি স্যারের কাছে নিয়ে যান,ঠিক আছে আমাকে দিন বলে কারারহ্মী হাতে নিয়ে কার্ড দুটো ভাল করে দেখে লেখাটা পডার চেষ্টা করলো কবিতার কয়েকটা লাইন

'কোথায় ঈদের চাঁদ কোথায় ঈদের দিন

মন চুটে যায় ঐ মিসর ফিলিস্তিন

ঘরে ঘরে লাশের মিছিল কাঁদার মানুস নাই

বলতে পারো কেমন করে ঈদের গজল গাই?

জুলুম শোষন অত্যাচার শেষ হবে যে দিন

ঈদের খুশি আসবে ফিরে ঈদ হবে সে দিন।

নিচে ছোট করে লিখা -তোমার অপেহ্মায় আমি.

কারারহ্মী দুজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে কিছুটা হাসির ঝিলিক ছডিয়ে কি বুঝলো -বুঝতে পারলাম না কার্ড দুটো আমার হাতে দিয়ে দিলো বিলম্ব না করে রুমে চলে গেলাম, ঈদ কার্ডটি হাতে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পডলাম,জামা কাপড খুলে একটু ফ্রেশ হওয়ার শক্তি যেনো হারিয়ে ফেললাম।

'তোমারই আমি' প্রেরকের কার্ডটা হাতে নিয়ে কার্ডের বিপরীতে লেখা কবিতার কয়েকটা লাইনে চোখ বুলালাম...

'ঈদের খুশি কোথায় গেল কোথায় ঈদের চাঁগ

চতুর্দিকে ছডিয়ে যেন ক্লান্তি অবসাদ

জালিম শাহীর কয়েদখানায় ঈদের হেলাল বন্দি

কালোর সাথে আলোর কভু হয়না তো ভাই সন্ধি

আধার আলোর চলছে তুমুল যুদ্ধ

চাঁদ সেতারা কার ইশারায় বিনা দোষেই রুদ্ধ

নতুন জামা টুপি আতর গন্ধ

সবই আছে তবুও যেনো স্তব্ধ খুশির ছন্দ

ভাঙতে হবে জেলের তালা আনতে হবেই চাঁদ

চলতে হবে দলতে হবেই পাহাড সমান বাধ।

কবিতার লাইন গুলো পডে মনে হলো আমি নতুন শক্তিতে বলিয়ান মুক্তি আকাশের একজন মুক্ত মানুষ, মনে হল তোমারই আমি" নামের যিনি প্রেরক তিনি আমার মনের অবস্থাটাকে সামনে রেখেই কবিতাটা বাছাই করেছেন। এই তোমার আমি নামক প্রেরক মানুষটা আমাকে বরাবরই কখনো কবিতা কখনো ইসলামের ইতিহাস-কখনো কোরআন হাদীস বা দেশে দেশে ইসলামী আন্দোলনের পতাকাবাহীদের ত্যাগ কুরবানীর বর্ননা তুলে ধরে সাহস যুগিয়েছেন নিরন্তর সেই সাহসে ভর করেই আবার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম ঈদের উপহার গুলো সব ব্যাগ থেকে বের করে সুন্দর করে সাজিয়ে ভালোভাবে দেখলাম, মনেই হলোনা আমি কারাগারে আছি পান্জাবী পেলাম ১০টার মতো, ভিতর থেকেই পেলাম ৫টা,পরিচিত জনরা ভেতরের কিছু অস্বচ্ছল-অসহায় বন্দির জন্য জন্য আরো বেশ কিছু পান্জাবি এবং লুঙ্গি দিয়েছেন।

অসম্ভব আনন্দ নিয়ে সব উপহার প্রয়োজনীয় উপযুক্ত ভাইদের হাতে পৌছে দিয়ে ঈদ জামাতের জন্য অপেহ্মােয় থাকলাম বৃষ্টি হলে ভবনের ভেতর আর না হলে খোলা মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হবে জানলাম,কারাগারে জীবনের প্রথম জামায়াতে অংশ গ্রহন উপলব্ধি আর অনুভুতিটা একে বারেই আলাদা, সাথে অতিরিক্ত আনন্দ যোগ হলো আমীরে জামায়াত মাওলানানমতিউর রহমান নিজামী ভাইয়ের সাথে স্বাহ্মাতের সুযোগ পাওয়া যাবে, সুযোগের সাথে নানান আইনী সীমাবদ্ধতার শঙ্কাও যে একেবারে ছিলনা তা না, আলহামদুলিল্লাহ, সকাল ৯টা জামায়াতের জন্য সকাল ৭টা থেকে সম্পুর্ন প্রস্তুতি নিয়ে ভবনের গেটে অপেহ্মা করতে করতে ভবনের আমাদের অনেক ভাই জটলা হয়ে গেলেন একজন কারারহ্মী আমাকে খানিক সহযোগীতার মানসিকতা নিয়ে কাছে এসে বললেন-বুঝতি পেরেছি কার জন্য অপেহ্মা করছেন, স্যার কে তো একে বারে শেষে নিয়ে আসা হবে আর উনার জন্য সামনের কাতারে ইমাম সাহেবের ঠিক পেছনে জায়গা রাখা হয়েছে, এরই মধ্যে হঠাত একজন ডেপুটি জেলার বেশ কয়েকজন কারা কর্মকর্তা সহ আমীরে জাময়াতকে বের হয়ে আসতে দেখলাম, সাদা ধবধবে পান্জাবী আর কালো ফ্রেমের চশমার সাথে অভিজাত টুপি পরা একজন আল্লাহর দ্বীনের অকুতোভয় সৈনিকের মতো হেটে আসতে দেখে নিজের চোখকে সামলাতে পারিনি, চোখের পানি মুছতে মুছতে সব বাঁধা অতিক্রম করে আমিরে জামায়াতের দিকে এগিয়ে যেতেই আমীরে জামায়াত খানিকটা হাত বাডিয়ে আমাকে উনার বুকে জডিয়ে নিলেন,কান্নার পানির সাথে শব্দটাও কোনভাবেই আর ঢেকে রাখতে পারলামনা, শরীরের সেই পুরনো ঘ্রান আর পরিচিত স্পর্ষ লেগে থাকতেই চাইলাম ওনার বুকের সাথে, আমিরে জামায়াত দৃঢকন্ঠ-কেমন আছো?

এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য বুকের কাছ থেকে মাথাটা তুলে ওনার মুখের দিকে তাকালাম, লহ্ম্য করলাম, আমীরে জামায়াত চশমার ফাঁক দিয়ে আঙ্গুল দিয়ে চোখের পানি মুছচেন, বুঝতে বাকী রইলোনা -স্নেহের পরিমান কোন মাত্রার, আমার চোখের পানি যেনো আর কোনভাবেই বাঁধ মানছেনা, আমীরে জামায়াত আমার মুখটা তুলে কপালে চুমু খেলেন আমি যেনো মুহুর্তেই শিশু হয়ে গেলাম,কান্নার শব্দটা অনেক স্পষ্ট হয়ে গেলো চোখে কান্না আর মুখে আনন্দের বন্যা ৪৪ দিনের রিমান্ডের সব যন্ত্রনা যেনে মুহূর্তেই বিলীন হয়ে গেলো, আমীরে জামায়াত আমার হাতের আঙ্গুল গুলো টিপে টিপে জিজ্ঞেস করলেন সব ঠিক আছে তো তোমার? এই প্রশ্নের সময় লহ্ম্য করলাম দৃঢ কন্ঠের অধিকারী আমীরে জামায়াতের কন্ঠটা খানিকটা কেঁপে কেঁপে ওঠলো, শরীরে একটা ঝাকুনি অনুভব করলাম, কারা কর্মকর্তারা আর সময় নিতে চাইলেন না, তারা অনুরোধ করলেন আমীরে জামায়াতকে স্যার সামনে চলুন, আমীরে জামায়াত তার শরীর থেকে আমাকে আলাদা করতে করতে শুধু বললেন-ফী আমানিল্লাহ.সবর করো সব ঠিক হয়ে যাবে,আল্লাহ তাআলা আমাদের সাহায্য করবেন......... ইনশাআল্লাহ

লেখক-প্রিয় সিপাহসালার ড.শফিকুল ইসলাম মাসুদ

বিষয়: বিবিধ

৮৯৬ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

385756
১১ আগস্ট ২০১৮ রাত ১১:০৩
মনসুর আহামেদ লিখেছেন : ভালো লাগলো /

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File