গজব ও গুজব-নির্ধারক মাপকাঠি

লিখেছেন লিখেছেন রওশন জমির ২৬ মার্চ, ২০১৩, ০৪:১২:০৪ বিকাল

প্রাকৃতিক কিছু বিষয় আছে, যেগুলোর কার্যকারণ সূত্র এখন খুব সহজেই নির্ধারণ করা যায়। আবার প্রত্যক্ষ প্রাকৃতিক কার্যকারণের বাইরেও কিছু ঘটনা ঘটে, যা আমাদের স্বাভাবিক জ্ঞানের পরিসরে অদ্ভূত ও অলৌকিক বলে মনে হয়। কিন্তু এগুলো নিয়ে যখন সরল বিশ্বাসীদের কাছে ব্যবসায়ের ফাঁদ পাতা হয়, তখনই মূলত খারাপ লাগে।

এই তো কয়দিন পূর্বে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দোষী ও মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামী মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী চাঁদে চড়ে গেছেন। আরো রটে যায়, চাঁদে তার প্রতিকৃতি দেখা যাচ্ছে; তার কারণে চাঁদ কেমন যেন বিষণœ। আপামর জনসাধারণ, যাদের বাস্তব জ্ঞান খুব সামান্য, তারা এতে অতি রকমের বিহ্বল হয়ে পড়ে। এর কিছুদিন পরই সিলেটসহ ভারতের অসমে মোটামুটি ধরনের ভূকম্পন অনুভূত হয়। তখন স্বল্পশিক্ষিত ধর্মভক্ত বা ধর্মান্ধ লোকজন বলতে শুরু করে যে, সাঈদীকে ফাঁসির রায় দেওয়ায় এমন কাণ্ডগুলো হচ্ছে। এ হচ্ছে আল্লাহর গজব। হাসিনা সরকার এবার ঠেলা সামলাক। এনিয়ে মোল্লা-মাওলানার সে কি ওয়াজের স্রোতধারা!

এখানে একটি হাদিসের বিবরণ দেওয়া যাক, যাতে এ সমস্ত বিষয়ে প্রাকৃতিক অনিয়মের ব্যাখ্যা তুলে ধরে। হাদিসটি এ-রকম যে, রাসুল সা. এর ঔরসজাত সন্তান ইবরাহিমের মৃত্যু হলে চন্দ্রগ্রহণ হয়। লোকজন তখন বলতে থাকে যে, মুহাম্মদ সা-এর সন্তানের মৃত্যুর কারণে এ চন্দ্রগ্রহণ হয়েছে। রাসুল সা. তা শুনে তখন বলেন যে, এগুলো (চন্দ্রসূর্যগ্রহণ) হল আল্লাহর অসংখ্য নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। কারো জন্ম-মৃত্যুর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

বিজ্ঞানের কল্যাণে এখন আমরা জানতে পেরেছি যে, পৃথিবী এবং চন্দ্রসূর্যের মাঝে কোনো কিছুর আড়াল তৈরি হলেই এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। হ্যাঁ, এই আড়াল তৈরি হওয়ার যে কায়দাকানুন, তা মহান বিশ্বনিয়ন্তার নিয়ন্ত্রিত বা পরিচালিত কৌশলেরই আওতাভুক্ত। তা আদতে অযৌক্তিক বা অধরা কিছু নয়। তাই দেখা যায়, ভূকম্পন-জ্বলোচ্ছাস-চন্দ্রসূর্যগ্রহণ ইত্যাদির খবর আমরা আগেই পেয়ে যাই। জ্বলোচ্ছাস বা ভূকম্পন ইত্যাদি নানা রকমের যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়, তার জন্য দায়ী কে বা কী, তা নিয়ে দু রকমের মতামত বা বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। ধর্মভিত্তিক ব্যক্তিবর্গ এখনো এগুলোকে অন্ধকারের বিষয়আশয় হিসাবে রেখেই কথা বলেন। তাই সহজে এগুলোকে আল্লাহর গজব হিসাবে ঠাউরে ফেলেন। কিন্তু প্রশ্ন হল তা যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে গজবই হবে, তাহলে যারা সরাসরি পাপের সঙ্গে জড়িত, তাদের শাস্তি হয় না কেন?

কোথায় যেন পড়েছিলাম, মহাত্মা গান্ধীর জীবৎকালে ভারতে ভয়ঙ্কর রকমের ভূকম্পন হয়। কোন এলাকায় তা মনে নেই। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তখন গান্ধীজী বলতে থাকেন যে, অস্পৃশ্যতাজনিত পাপের দায়ের এই ভূকম্পন হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন এর প্রতিবাদ করেন। তিনি বলেন, অস্পৃশ্যতার পাপের জন্য যারা দায়ী তারা সবাই উচ্চ কোটির মানুষজন, এর শাস্তি কিন্তু তারা কেউ ভোগ করে নি। বরং যারা অর্স্পশ্যতাজীর্ণ, সেই সব সাধারণ মানুষজনই এতে ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। এ ধরনের সরল ব্যাখ্যা অনুচিত। গান্ধীজী এর পর কিছু বলেন নি। এ ঘটনার সঙ্গে সুর মিলিয়ে নয়, নিজস্ব যুক্তিবোধের নিরিখেই বলতে হয় যে, সাঈদীর রায়ের পর যে ভূকম্পন হয়েছিল, তাতে সিলেট আর আসামের মানুষজনের দোষ কোথায়? এ ভূকম্পন তো সরাসরি শাহবাগে হওয়ার কথা! আর চাঁদে চড়তে হবে কেন? ঘটনা ঘটল এই জমিতে, আর তিনি চলে গেলেন দূরের সেই চাঁদে। কী অদ্ভূত?

এবার আসি সম্প্রতি ঘটিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার টর্নেডোর ব্যাপারে। যতদূর জানি, এলাকাটি কওমি মাদরাসাসহ নানা মাজারে ভরপুর। পীর-ফকিরও অনেক রয়েছে সেখানে। মানুষজন মোটামুটি দীনদার। তাহলে গজব সেখানে নেমে এলো কেন? আর এসব টর্নেডো ঘুরে-ফিরে গ্রামে বা কাঁচা ঘরবাড়ির দিকেই কেন যায়, তাও তো বোঝা দায়! তাই এসব দুর্যোগপূর্ণ ঘটনাকে সহজে কোটাবদ্ধ না করে একটু গভীর ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মনোভাব নিয়েই আলোচনা করা উচিত।

বিজ্ঞানীরাও এর ব্যাখ্যা দেন। তাদের ব্যাখ্যা এ-যাবৎ আবি®কৃত জগৎ-নিয়মের আওতাধীন। সেই ব্যাখ্যার সঙ্গে মানুষের কীর্তি-অপকীর্তির চেয়ে জগৎনিয়মই মূল নিয়ামক হয়ে ওঠে। তবে ধর্মের ব্যাখ্যাকে এখানেও সংযোজন করা যায়। আবার বিজ্ঞানীরা কিন্তু এককথায় বলেন, বর্তমানের আবিষ্কার ও তত্ত্বই শেষ কথা নয়। পরে ভিন্ন রকমের তত্ত্ব/ তথ্য পাওয়া গেলে, তা অন্য রকম হতে বাধ্য। যুক্তির নিরিখে তাদের কথাটা ও ব্যাখ্যাটা ফেলনা নয়। আবার বিজ্ঞানের যে ক্রমোন্বয়ন, তাতে বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যারই সমর্থন বাড়ছে। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মব্যাখ্যা কেমন যেন পিছিয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানীরা ধর্ম দেখে কথা বলেন না। তারা প্রাপ্ত তথ্য ও তত্ত্বের নিরিখে কথা বলেন। কিন্তু ধর্মবিদগণ সব সময় কালের পরম্পরার সঙ্গে মিলিয়ে ব্যাখার সাযুজ্য দাঁড় করান না, করতে পারেন না। তারা যে ব্যাখ্যা দেন, তা কালের নিরিখে প্রায়ই অচল বলে মনে হয়। তাই তাদের উচিৎ, নিজেদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের আপডেটসহ সে অনুসারে কথা বলা। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমিন।

বিষয়: বিবিধ

১১৭১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File