মূল্যস্ফীতি, ভ্যাট-ট্যাক্স, ঘুমন্ত জনগণ ও আমাদের রাজনীতি

লিখেছেন লিখেছেন েনেসাঁ ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৩:৩৬:২২ দুপুর



সম্প্রতি সরকার আমাদের অতীব প্রয়োজনীয় ও অর্থনীতির অন্যতম গুরত্বপূর্ণ উপাদান গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম আরেকদফা ব্যাপক আকারে বাড়িয়েছে। আবার নতুন করে ভ্যাট-ট্যাক্স এর নতুন নীতিমালার মাধ্যমে জনগনের উপর প্রচুর কর চাপানো হয়েছে। সরকারী চাকুরীজীবীদের বেতন আবারও দ্বিগুন করা হয়েছে। অন্যদিকে বিভিন্ন গণমুখী কর্মকান্ডে সহযোগীতাসহ গুরুত্বপুর্ণ খাতগুলোতে ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে। যার প্রত্যক্ষ ফল হল ক্রমবর্ধমান উচ্চ মুল্যস্ফীতি, যার কারনে পাল্লা দিয়ে নতুন করে বাড়া শুরু করেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও নাগরিক সব সেবার মুল্য। অন্যদিকে সরকারের বাংলাদেশ ব্যাংকের উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রনের কারনে এবং নির্দিষ্ট সম্পদের বিপরীতে যখন তখন নতুন নতুন টাকা ছাপানোর ফলে মুদ্রার ব্যাপক অবমূল্যায়ন হচ্ছে আর জনগনের টাকা সরকারের পকেটে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা নীতি কি, কিভাবে কখন বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপে এই নিয়ে সংসদে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা না হওয়ার সুযোগে এবং জনগনের কাছে জবাবদিহিতার অভাবে সরকার উন্নয়নের কথা বলে ব্যাপক মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটাচ্ছে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও মূল্যস্ফীতি ভ্যাট-ট্যাক্স এর থেকেও মারাত্মক রাষ্ট্রীয় শোষণ। মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও মূল্যস্ফীতির মাধ্যমে শেয়ার বাজারের আদলে জনগনের সব টাকা-পয়সা নিয়ে নিচ্ছে সরকার। এইদেশে প্রবাসীদের পাঠানো এত বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্সের সরবরাহ থাকার পরও উন্নয়নের ও আন্তর্জাতিক বাজারের কথা বলে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও মূল্যস্ফীতি কোন মতে গ্রহনযোগ্য নয়। বরং ডলারের বিপরীতে টাকার মুল্য বেড়ে জিনিসপত্রের দাম কমে যাওয়ার কথা। প্রত্যেক সরকারের সীমাহীন দুর্নীতির কারনেই বার বার মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও মূল্যস্ফীতি ঘটছে।

বাংলাদেশের জনগণের আয় বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যে আয় বৈষম্য সাম্প্রতিক সময়ে তাকে আরও তীব্রতর করে দেশকে নীরব দুর্ভিক্ষের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে ক্রমবর্ধমাণ উচ্চ মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও মুল্যস্ফীতি। যার ফলে দেশে বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, দরিদ্র আরও দরিদ্র হচ্ছে, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক মহলের কাছে সম্পদ পুঞ্জীভুত হচ্ছে, দুর্ণীতির বিস্তার ত্বরান্বিত হচ্ছে ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যকার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে জাতীয় অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে আমাদের নাগরিকদের সমুদ্রে সলিল সমাধি হচ্ছে এবং নানাবিধ অপরাধ ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারত ও চীনের বানিজ্য রক্ষ্যাকারী কিছু অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের কথায় দেশের ব্যাপক উন্নতির স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকলে চরম ভুল হবে। বাংলাদেশের ব্যাংকের উচ্চ রিজার্ভ, শহরের লাল-নীল বাতি, কিছু স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, কিছু রাস্তাঘাট-ব্রীজ দেশের উন্নতির চিহ্ন নয়। উন্নতির চিহ্ন হল রাষ্ট্র তার ১০০% নাগরিকের সকল মৌলিক অধিকারগুলো- অন্ন, বস্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবে, জনগনের মধ্যে বৈষম্য দূর করবে, শিল্পায়ন ঘটিয়ে আমদানি কমিয়ে রপ্তানি বাড়াবে, বেকারত্ব দূর করবে, বিদেশে আমাদের শ্রমিক যাবেনা বরং বিদেশি শ্রমিক এদেশে কাজ করবে এবং মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও মূল্যস্ফীতি না হওয়া নিশ্চিত করবে তথা জনগনের সবকিছু মিলে শান্তিতে থাকা্র সব ধরনের ব্যবস্থা করবে। কোন দেশের উন্নতির জন্য জনগনকে উন্নতির ও অর্থনীতির বড় বড় সবক দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই বরং দেশের উন্নতি হলে প্রত্যেকটি জনগণই তার বাক্তিগত জীবনেই এর সুফল পাবে এবং উন্নতি দেখতে পাবে।

মুল্যস্ফীতি মানেই হল দামের সম্প্রসারণ। এই সম্প্রসারণ ‘জিরো সাম গেম’ অর্থাৎ যেখানেই সম্প্রসারণ হচ্ছে সেখানেই সংশ্লিষ্ট একটা গোষ্ঠী স্ফীত হচ্ছে ও বিপরীতে অন্য একটা গোষ্ঠী সংকোচিত হচ্ছে। তাই মূল্যস্ফীতির ফলে বাজার দামের স্ফীতি ঘটছে ও ক্রয়ক্ষমতার সংকোচন ঘটছে। অর্থাৎ মুল্যস্ফীতির ফলে বাজারসংশ্লিষ্ট একটি পক্ষ (উৎপাদক সুফল পাচ্ছে না) ব্যবসায়ী, মজুদদার, দালাল, ফড়িয়ারা প্রচুর লাভবান হচ্ছে এবং অপরদিকে ব্যপক ভোক্তা জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে একজনের অর্থসম্পদ অন্যজনের পকেটে গিয়ে পড়ে সমাজের জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে মানুষ উন্নতির জন্য যতই চেষ্টা করছে আর ততই সরকার নির্দিষ্ট সম্পদের বিপরীতে অতিরিক্ত টাকা ছেপে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটিয়েও সবাইকে পিছিয়ে দিচ্ছে। অথচ সেই তুলনায় ভারত ও চীনের স্বার্থ রক্ষ্যা করতে গিয়ে তারা নতুন নতুন শিল্পায়ন না ঘটিয়ে, নিজেদের প্রয়োজনীয় সকল কিছু উৎপাদন নিশ্চিত করছে না এবং রপ্তানিমুলক সম্পদ বাড়াচ্ছে না।

কিন্তু কথা হল এই উচ্চ মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও মুল্যস্ফীতি নিয়েও কেন জনবিস্ফরন ঘটছে না। এর কারন হচ্ছে বেশিরভাগ মানুষের এই বিষয়ে অজ্ঞতা বা তেমন ধারনা না থাকা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা যার কারনে জনগন এক হতে পারছে না। গত কয়েকদিনে শিক্ষার উপর অতিরিক্ত কর আরোপের ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা ফুঁসে উঠেছে। ভ্যাট-ট্যাক্স এর চেয়েও ভয়ঙ্কর মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও মূল্যস্ফীতি কি তা যদি এই দেশের বেশিরভাগ মানুষ বুঝতো তাহলে হাসিনা-খালেদার ক্ষমতা বদলের ও মানুষ হত্যার রাজনীতির হাতিয়ার না হয়ে সকল ইস্যু বাদ দিয়ে তারা এটাকে নিয়ন্ত্রনের জন্য একটা ফ্ল্যাটফরমে এসে যেত, আর তখনই কেবল আমাদের সবার ভাগ্যের পরিবর্তন হত।

বিশেষজ্ঞরা যা বলেন (রাজনৈতিক ডট কমে প্রকাশিত)

অর্থনীতির উপর উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব নিয়ে কথা বলেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক যিনি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে সামষ্টিক অর্থনীতি পড়াচ্ছেন ড. মাসুদা ইয়াসমিনের সাথে। তার মতে— “আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতির সমস্যাটি একটি কৃত্তিম সমস্যা। অর্থনীতির বিকাশ হলেই যে মুল্যস্ফীতি ঘটবে তা ঠিক নয়। প্রকৃ্ত প্রবৃ্দ্ধির হিশাব করা উচিত মুল্যস্ফীতির সাথে সমন্বয় করেই।” মূল্যস্ফীতির সমাধান প্রশ্নে তিনি বলেন—“দেশে খাদ্যমুল্যস্ফীতিই বেশি প্রকট যার বেশিরভাগই দেশে উৎপাদনকৃত। অথচ উৎপাদক কৃ্ষক যে বেশি দাম পাচ্ছে তা নয়, বরং মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়া ও ব্যবসায়ীদের পকেটেই যাচ্ছে মূল্যস্ফীতির ফলে সৃষ্ট অতিরিক্ত লাভ।” মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে তিনি বলেন—“কৃ্ষক ও চুড়ান্ত দ্রব্যের ভোক্তার মাঝখানে ব্যবধান কমিয়ে আনতে হবে। কৃ্ষকদেরকে বাজারের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। আর এ কাজটি অবশ্যই সরকারকে করতে হবে। অবকাঠামো উন্নয়ন, কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠা, কৃ্ষি তথ্যকেন্দ্র ও বিভিন্ন প্রশিক্ষনের মাধ্যমে কৃ্ষকদেরকে খুব সহজেই সুফলভোগী করা সম্ভব যাতে বাজারে উৎপাদক-ভোক্তার সহজ সম্পর্কটিও স্থাপিত হবে।”

সরকারের প্রচেষ্টা নিয়ে তিনি বলেন—“সরকারের কোন আন্তরিক প্রচেষ্টা আছে বলেই মনে হয় না। কেননা সরকারের সদিচ্ছা থাকলে সহজেই সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব।” বাংলাদেশ ব্যংকের ঘোষিত মুদ্রানীতিও এক্ষেত্রে কিছু করতে পারবে না বলে মনে করেন তিনি। দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির উপর কি প্রভাব পড়তে পারে তা জানতে চাইলে ড. ইয়াসমিন বলেন—“দীর্ঘমেয়াদে এর পরিনতি খুবই খারাপ, খুবই ভয়াবহ। কারণ মুল্যস্ফীতি অর্থনীতিকে অস্থীতিশীল করে দেয়। আর মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলে দেশে আয়বৈষম্য ও সম্পদবৈষম্য চরম আকার ধারণ করবে, জনরোষ বাড়বে। কেননা মূল্যস্ফীতির মানেই হল একটা ক্ষুদ্র শ্রেণী অন্য বৃহৎ শ্রেণীকে বঞ্চিত করে সম্পদ বাড়াচ্ছে যা সুবিধাবঞ্চিতদের হতাশার সাথে পাল্লা দিয়ে দেশে অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে, যা থেকে দেশে নতুন করে জংগীবাদের মত সমস্যারও সৃষ্টি করতে পারে। এককথায় সার্বিকভাবে দেশ একটি অস্থীতিশীল অবস্থার দিকে ধাবিত হবে। ”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. রুশাদ ফরিদীর মতে— “মুল্যস্ফীতি বাড়ছে কথাটির অর্থই হল দেশে বৈষম্য বাড়ছে। অনেক লোকের টাকা অল্প কিছু লোকের কাছে চলে যাচ্ছে। ” তবে তিনি খোদ মুল্যস্ফীতির অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তার দৃষ্টিতে “দেশে প্রকৃ্তপক্ষে ‘স্ট্যাগফ্লাশন’(উৎপাদন কমে গিয়ে যোগান সংকটের ফলে দামস্তরের বৃদ্ধি) চলছে। কেননা জ্বালানি সমস্যার কারণে ভৌত খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে।” তিনি এও মনে করেন যে দেশে বিকাশমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্রয়ক্ষমতা বৃ্দ্ধি ও অত্যধিক চাহিদাও মূল্যস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ।” তার মতে অতিমাত্রার মুল্যস্ফীতি দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা তৈরি করবে।(সংগৃহিত)

বিষয়: বিবিধ

১২৩৬ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

341474
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:২৬
লজিকাল ভাইছা লিখেছেন : দরুন না এটা জয় বাংলা টাক্স, জাতির নাতির হুসকির খরচ ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File